সরকারের পতনের পর তিন দিন দায়িত্বে থাকলেও চতুর্থ দিন ৯ আগস্ট দুপুরে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২তম গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই এক রকমের লাপাত্তা ছিলেন আবদুর রউফ; করেননি অফিস, দেখা যায়নি তাকে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি, এই বারই প্রথম এমন ঘটনা ঘটল। সদ্যবিদায়ী গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের পালিয়ে গেছেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যা, জিয়াউর রহমান হত্যা, এরশাদ পতনের মতো বড় বড় অস্থিতিশীল ঘটনায়ও গভর্নররা নিজ পদে আসীন ছিলেন।
একটি অরাজনৈতিক পদে থাকার পরও কেন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ঢেউয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার মতো গভর্নরকেও পালিয়ে যেতে হলো- এমন প্রশ্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যেভাবে খর্ব করা হয়েছে এবং গভর্নর পদটিকে যেভাবে রাজনৈতিক পদে পরিণত করা হয়েছে তাতে গভর্নরের পালিয়ে যাওয়ায় অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, গভর্নর হিসেবে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড দাম্ভিক। অন্যদের সিদ্ধান্ত কিংবা পরামর্শের তোয়াক্কা পর্যন্ত করতেন না। ডেপুটি গভর্নরদের নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যাংক চালাতেন আবদুর রউফ।
এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রউফ যে কয়টি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার প্রায় সবকটি দেশের অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের শরীয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করতে এবং দুর্নীতি ঢাকতে যা যা করেছেন তা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে নজিরবিহীন।
রিজার্ভের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুলাই মাসে আব্দুর রউফ যখন গভর্নরের দায়িত্ব পান তখন ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলারের উপরে। আর আবদুর রউফ তালুকদার যখন পালিয়ে যান, তখন দেশের রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে গেছে। এ বিশাল সময়ে টাকা লুটপাটের মতো ঘটনা এত হরহামেশা ঘটেছে যে, ব্যাংকখাতে অর্থ লোপাট সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাজস্ব বিভাগের আলোচিত দুর্নীতিবাজ মতিউরের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের ছবিই প্রমাণ করে কোন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে তার সখ্য ছিল।
ব্যাংকখাতে যেসব অনিয়ম চলছে এসবের দায়ভার কোনোভাবেই গভর্নর এড়াতে পারেন না। এটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যায়, গভর্নরের জ্ঞাতসারেই টাকা ছাপিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে সাহায্যের নামে অর্থ লোপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের বড় বড় কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে এস আলম গ্রুপের কর্তাব্যক্তিদের ছিল দহরম-মহরম। গভর্নর নিয়োগের আগে সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা এস আলম গ্রুপের পরামর্শ নিতো। তৎকালীন সরকারই এস আলম গ্রুপের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল।’
ব্যাংক কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ছিলেন এস আলম গ্রুপের কাছের মানুষ। তার নিয়োগের পেছনে এস আলম গ্রুপের বড় প্রভাব ছিল। নিয়োগ পেয়ে এস আলম গ্রুপকে হেন কোনো অবৈধ সুবিধা নেই, যা আব্দুর রউফ দেননি।’