মঙ্গলবার ১ জুলাই ২০২৫ ১৭ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ১ জুলাই ২০২৫
সংবিধান সংস্কার ও ন্যায়পাল
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
প্রকাশ: রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৫:৫২ PM
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান সংরচিত এবং প্রবর্তিত হয় ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে। যারা সংবিধান রচনা করেছিলেন এবং তাতে (প্রবর্তনে) স্বাক্ষর করেছিলেন, তারা স্বাধীন বাংলাদেশের নির্বাচিত সাংসদ কিংবা সংবিধান রচনার জন্য নির্বাচিত আইন পরিষদ সদস্য ছিলেন না। 

পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সংবিধান সর্বমোট সতেরোবার সংশোধিত হয়েছে, আটবার সরাসরি আইন পরিষদ কর্তৃক এবং বাকি নয়বার ঘটনাউত্তর (সামরিক ফরমান কিংবা অধ্যাদেশ দ্বারা ঘোষিত পরিবর্তন) গৃহীত হয়েছে। 

দেশ শাসনে কোন পদ্ধতির (রাষ্ট্রপতি কিংবা সংসদীয় পদ্ধতি) সরকার হবে, দুই সংসদেও মাঝখানে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া ও নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নির্ধারণ নিয়ে দু-দুটি পরস্পরবিরোধী সংশোধন, সরকারের মৌল কাঠামো পরিবর্তন নিয়ে বেশ কয়েকবার সংশোধনী আনা হয়েছে। 

এই প্রেক্ষাপটে প্রধানত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসহ ক্ষমতার ভারসাম্য বিধান, জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের পারস্পরিক সম্পর্ক, নির্বাচন কমিশন, তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্র্বতী সরকার, স্থানীয় সরকার ক্ষমতায়নসংক্রান্ত বিষয়ে সংবিধান পুনর্লিখন প্রয়োজন হবে। 

প্রসঙ্গত যে, বাংলাদেশের সংবিধানে ১১ ভাগ, ১৩টি পরিচ্ছেদ এবং ১৫৩ অনুচ্ছেদ রয়েছে। এই সংবিধান শুরু হয়েছে প্রস্তাবনার মাধ্যমে আর এর সমাপ্তি ঘটেছে ৭টি তফসিলের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৪ জন। ৮ জুলাই ২০১৮ সালের সপ্তদশ সংশোধনীসহ বাংলাদেশের সংবিধান সর্বমোট ১৭ বার সংশোধিত হয়েছে। 

সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন প্রশ্নে পদ্ধতি প্রক্রিয়ায়ও সংস্কার সাধন প্রয়োজন হবে।  অর্থাৎ গণপরিষদ গঠন তথা গণভোটের মাধ্যমে হতে পারে সে ব্যাপারে রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হবে। 

বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর এবং এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত বা তর্ক-বিতর্কের অবকাশ থাকা বা রাখা সমীচীন হবে না। এ যাবৎ ১৭ বার সংবিধান সংশোধিত হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনমত যাচাই বা গণভোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে করা সংগত হলেও তা করা হয়নি।

বেশ কয়েকটি সংশোধনীর ফলে দেশে টেকসই আইনের শাসন বা সরকার পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে বেশ জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এমনকি বেশ কয়েকটি সংশোধনী গ্রহণকালে সংসদেও কার্যবিধিমালা অনুসরণ করার আবশ্যকতা থাকলেও তা করা হয়নি। যে সংসদে সংশোধনীগুলো গ্রহণ করা হয়েছিল সে সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ছিল, সেখানে এমন কিছু সংশোধনী পাস হয়েছে, সেসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারেও তার উল্লেখ ছিল না।

সতেরোবার  সংশোধনের মুখ্য শিরোনাম বা বিষয় তালিকা পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে এসবের উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের মধ্যকার দূরত্ব ও দৌরাত্ম্য।    

সংবিধানের সংশোধনীগুলো- প্রথম সংশোধনী-১৯৭৩, যুদ্ধবন্দি এবং অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিতকরণ। দ্বিতীয় সংশোধনী-১৯৭৩- অভ্যন্তরীণ কিংবা বাহ্যিক গোলযোগে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান। তৃতীয় সংশোধনী-১৯৭৪- সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী ভারতকে বেরুবাড়ী হস্তান্তর। চতুর্থ সংশোধনী-১৯৭৫- সংসদীয় সরকারের পরিবর্তে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা চালু এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি প্রবর্তন। 

পঞ্চম সংশোধনী-১৯৭৯- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের সব কাজের বৈধতা দান প্রসঙ্গে। ষষ্ঠ সংশোধনী-১৯৮১- উপ-রাষ্ট্রপতির পদ থেকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের বিধান নিশ্চিতকরণ। সপ্তম সংশোধনী-১৯৮৬- ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত সামরিক সরকারের সব আদেশের বৈধতা অনুমোদন প্রসঙ্গে। 

অষ্টম সংশোধনী-১৯৮৮- রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি এবং ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের ছয়টি বেঞ্চ স্থাপন। নবম সংশোধনী-১৯৮৯- প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধকরণ, নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ সৃষ্টি এবং প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। দশম সংশোধনী-১৯৯০- সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত ১০টি আসনের মেয়াদ আরও ১০ বছরের জন্য বৃদ্ধিকরণ। 

একাদশ সংশোধনী-১৯৯১- অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের স্বপদে ফিরে যাওয়ার বিধান সংবলিত। দ্বাদশ সংশোধনী-১৯৯১- রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের পরিবর্তে সংসদীয় সরকার পুনঃপ্রবর্তন। ত্রয়োদশ সংশোধনী-১৯৯৬- অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালুকরণ। চতুর্দশ সংশোধনী-২০০৪- সংসদে নারীদের জন্য ৪৫টি সংরক্ষিত আসন বৃদ্ধি এবং প্রধান বিচারপতির অবসর বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছরে উন্নীত। 

পঞ্চদশ সংশোধনী-২০১১- ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতিতে প্রত্যাবর্তন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তকরণ, সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫টি থেকে ৫০-এ বৃদ্ধিকরণ এবং জাতির পিতার স্বীকৃতি ও প্রকৃতি সংরক্ষণে বাধ্যবাধকতা। জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা ও ঘোষণাপত্র তফসিলে যুক্তকরণ। ষোড়শ সংশোধনী-২০১৪- বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে প্রদান প্রসঙ্গে (নোট : ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়)। সপ্তদশ সংশোধনী-২০১৮- জাতীয় সংসদের ৫০টি নারী সংরক্ষিত আসন আরও ২৫ বছরের জন্য বহাল রাখা প্রসঙ্গে।

চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে, হাজার প্রাণের বিনিময়ে সংবিধান সংশোধনের যে সুযোগ ও দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার হবে সুচিন্তিতভাবে (সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম তিনটি শব্দে স্বীকৃত ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ’)-এর সজ্ঞান সম্মতিতে সংবিধান সংশোধন কার্যক্রম গ্রহণ করা। জাতির জন্য এটি একটি অমোঘ ক্রান্তিকাল। এখানে বিফল কিংবা বেপথো হওয়ার সুযোগ নেই।      

রেগুলেটরি সংস্কার : প্রস্তাবিত সংবিধান সংশোধনীর আলোকে স্বাধীন-সার্বভৌম আধুনিক বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক আমলে প্রবর্তিত বহুবিধ আইনকানুন রীতি ও কর্মপদ্ধতি প্রচলিত থাকা (যা কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বাড়ায় এবং পাবলিক সার্ভিস প্রাপ্তির মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে) সমীচীন নয় বিধায় একটি রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন গঠন করে অকার্যকর রুলস রেগুলেশন বাছাই করে বাতিল করা যেতে পারে এবং প্রাসঙ্গিক বিধিবিধানকে যুগোপযোগী করা করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত, ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ড. আকবর আলি খানের নেতৃত্বে গঠিত রেগুলেটরি রিফর্মস কমিটি যে সুপারিশ প্রতিবেদন পেশ করেছিল ২০০৯ সালে নতুন সরকার এসেই পুরো কমিটিকে বাতিল  ও সুপারিশকে অগ্রাহ্য করে।

ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা : বাংলাদেশে সর্ববিধ বিচার বিচেনায় ভোটাধিকার হরণ, জনগণের মৌলিক অধিকার প্রাপ্তিতে পদে পদে প্রতারণা এবং বৈষম্যমূলক আচরণ, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, আয়নাঘরে বন্দি, রাজপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেপরোয়া আচরণ, বিদেশে বিপুল অর্থপাচারের মতো সিন্ডিকেটেড আস্ফালন, পরিবেশ পরিস্থিতিকে উপেক্ষা বরং সর্বত্রগামী দুর্নীতির অগ্রযাত্রায় অর্থনীতির সমূহ সর্বনাশ সাধন, সেবাধর্মী সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির প্রতিকার না পাওয়ার মতো বিষয়গুলো দিন দিন সাধারণ মানুষকে যাতে আরও উদ্বিগ্ন করে না তোলে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কার্যকলাপ জবাবদিহিতার বাইরে চলে যাওয়ার মতো ঘটনার প্রতিকার পেতে সাংবিধানিক ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠানের  আবশ্যিকতা উঠে আসে। ন্যায়পাল সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে, সরকারি প্রতিষ্ঠানকে আনবে জবাবদিহিতার মধ্যে, একজন ন্যায়পাল থাকলে সরকারকে মুখোমুখি হতে হবে না অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতিরও। 

ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান সরকারের প্রশাসনকে করতে পারে শক্তিশালী। কেননা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারণে সরকারের প্রতি আস্থা হারাতে পারে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি সাধারণ মানুষ এই আস্থাহীনতাই জন্ম দেয় সামাজিক অনাচার এবং রাজনৈতিক সহিংসতার। প্রশাসনের অনিয়ম অব্যবস্থা দূর করতে সংবিধানে ১৯৮০ সালে  ন্যায়পালের বিষয়টি সংস্থাপিত  হলেও এখনো ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা বা প্রবর্তিত হয়নি। ন্যায়পালের সহযোগিতায় সরকার বিচার, সংসদ ও নির্বাহী বিভাগে শুদ্ধাচারের অনুশীলন নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে। একই সঙ্গে করদাতাদের সঙ্গে কর আহরণকারী দপ্তরের মতপার্থক্য তথা হয়রানির প্রতিকার করে কর আদান-প্রদান সংস্কৃতিতে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ২০০৫ সালে বাংলাদেশে কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠিত হলেও ২০১১ সালে বিগত সরকার পুরো প্রতিষ্ঠানকেই বাতিল করে দেয়। রাজস্ব আহরণের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ ক্ষেত্রে স্বস্তি ও সেবার পরিবেশ নিশ্চিত করতে কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান পুনঃপ্রবর্তন সংবিধানসম্মত ও সংগত হবে।

লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত