ব্যবসা পরিচালন ব্যয় হ্রাস, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, শিল্প-কারখানায় নিরবিচ্ছিন্ন উৎপাদন অব্যাহত রাখা, সুশাসন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অটোমেশন ও সংষ্কার এবং সহায়ক বাণিজ্য নীতি সহায়তার জন্য সরকারকে আরো উদ্যোগী হওয়ার আহবান জানিয়েছেন ডিসিসিআই আয়োজিত “প্রাইভেট সেক্টর আউটলুক; প্রত্যাশা ও অগ্রাধিকার” শীর্ষক বাণিজ্য সম্মেলনের বক্তারা।
উল্লেখ্য, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত “প্রাইভেট সেক্টর আউটলুক; প্রত্যাশা ও অগ্রাধিকার” শীর্ষক বাণিজ্য সম্মেলন অদ্য ৩০ নভেম্বর, ২০২৪ তারিখে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা জনাব শেখ বশিরউদ্দিন যথাক্রমে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।
বাণিজ্য সম্মেলনের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগামী বছরের শুরুতেই নীিিতি সুদ হার এবং সুদ হার ক্রমান্বয়ে হ্রাসকরণের পাশাপশি সরকারী ব্যয় হ্রাস, বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, পণ্য ব্যবস্থাপনায় চাঁদাবাজি রোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারী বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মার্কিন ডলারে বিনিময় হার কে বাজারে বিদ্যমান হারের কাছাকাছি রাখার উপর জোরারোপ করে তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজীকরণের মাধ্যমে বিশেষকরে এসএমইদের ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসা প্রক্রিয়া সহজতরের লক্ষ্যে সামগ্রিক শুল্ক ব্যবস্থার সংষ্কারের পাশাপাশি ব্যবসা নিবন্ধন ও নবায়ন প্রক্রিয়ায় অটোমেশনের দাবী জানান ঢাকা চেম্বার সভাপতি। পণ্য উৎপাদান অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে শিল্প-কারখানায় নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের উপর জোরারোপ করেন আশরাফ আহমেদ। বাণিজ্যের সাথে নিজেদের সম্পৃক্তকরণের জন্য এখনও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে আমাদের পক্ষে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে ।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গত ১৫ বছরে বিশেষকরে অর্থনৈতিক খাতে যে ধরনের দূর্নীতি হয়েছে, তা অকল্পনীয় এবং সমাজের রন্ধে রন্ধে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে ডিপোজিট নিয়ে চলে গেছে, যার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে বিরল, তবে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার সেটার উত্তরণের প্রচষ্টো অব্যাহত রেখেছে, তবে এক্ষেত্রে কিছুট সময় লাগতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, মূল্যস্ফীতি একটা বড় চ্যালেঞ্জ. তবে রিজার্ভ স্থিতিশীলতা ও সুদের হার সন্তোষজনক পর্যায়ের মাধ্যমে এ অবস্থার উত্তরণ হবে। তিনি জানান, এনবিআর নিয়ে বেসরকাররিখাতের অভিয়োগ রয়েছে, তবে সকল আইনই ব্যবসা সহায়ক হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। উপদেষ্টা জানান, এনবিআরের কার্যক্রমে অটোমেশন করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে ট্যাক্স পলিসি ও ট্যাক্স এ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে আলাদা করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে বেসরকারিখাতে বিশেষকরে এসএমই খাতে ঋণ সহায়তা যেন কোনভাবেই হ্রাস না পায় সেটার প্রতি লক্ষ্য রাখাতে হবে বলে অভিমত জ্ঞাপন করেন।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের সাথে বেসরকারিখাতের সমন্বয় আবশ্যক এবং বিদ্যমান অবস্থার উন্নতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। একই পণ্যের একাধিক বাণিজ্য সংগঠন আছে বলে তিনি করেন। এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী সময়ে ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের বাণিজ্য সম্প্রসারণে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই বলে তিনি মত প্রকাশ করেন, তবে কবে নাগাদ গ্রাজুয়েশন করা যৌক্তিক হবে সে বিষয়ে আরো ডায়লাগ করার উপর তিনি জেরারোপ করেন, কেননা এলডিসি পরবর্তী সময়ে আমরা বেশকিছু অগ্রাধিকার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে, এর পাশাপাশি সহায়ক নীতিমালার কোন বিকল্প নেই বলে মত জ্ঞাপন করেন। নিজেদের বাণিজ্যের উদারীকরণের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের সাবসেক্টরগুলোর জন্য সহায়ক নীতিমালা প্রণয়নের উপর তিনি জোরারোপ করেন। এছাড়াও সামাজিক ন্যয় বিচার নিশ্চিতকরনে সরকারী ব্যয় বাড়াবে, তাই আমাদেরকে কর আহরণ বাড়ানোর উপর জোরারোপ করতে হবে, এর মাধ্যমে জনগনের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিএবি’র সভাপতি আব্দুল হাই সরকার, বিটিএমএ শওকত আজিজ রাসেল, ফিকি’র সভপতি জাভেদ আখতার, এবিবি’র সভাপতি সেলিম আর এফ হোসেন, প্রাণ আরএফএর গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সিইও আহসান খান চৌধুরী ও ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মোক্তাদির-এ বাণিজ্য সম্মেলনে প্যানেল আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করবেন।
আব্দুল মোক্তাদির বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করলেও কিছু ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যার সুফল আসবে। তিনি বলেন, শিল্প-কারখানায় অস্থিরতা কোনভাবেই কাম্য নয়, তাই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন সুনিদিষ্ট সময়সীমা সহ রোডম্যাপ থাকতে হবে। তিনি জানান, বিভিন্ন পণ্যের উচ্চ আমদানি শুল্ক হারের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হচিছ এবং ছোট ব্যবসায়ীরা কঠিন পরিস্থিতি পার করছে। তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের বেশকয়েকটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে, তাই কয়লার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দিলেই শিল্প খাতে আরো বেশি হারে গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে।
আহসান খান চৌধুরী বলেন, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন হলে ব্যবসার উন্নয়ন আসবে। তিনি উল্লেখ করেন, ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনের নিরিখে এলসি খুলতে না পারলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান দুটোই ব্যাহত হবে। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি খাতের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি তিনি পার্শিয়াল বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব করেন। এছাড়াও তিনি বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ঋণের সুদের হার হ্রাস প্রদান করা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন।
সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন সরকারের পক্ষ হতে এখনও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়নি, তবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী। তবে , অর্থনৈতিক খাতে সরকার বেশ ভালো করেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধুমাত্র সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিই যথেষ্ট নয়, বরং পণ্যের সাপ্লইচেইনে চাঁদাবাজি বন্ধ সহ বাজার ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক খাতের মামলাজট নিরসনে তিনি আরো বেশি হারে আদালত ও বিচারপতি নিয়োগের আহবান জানান।
জাভেদ আখতার বলেন, বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা ও সক্ষমতা একান্ত অপরিহার্য। এলডিসি উত্তরণের বিষয়ে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহবান জানান।
আব্দুল হাই সরকার বলেন, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি উল্লেখ, দেশকে স্বাভাবিক পর্যায়ের নিয়ে আসতে সকলকে সম্মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে। তিনি জানান, জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত ছাড়া শিল্প উন্নয়ন সম্ভব নয়, এ অবস্থার উন্নয়ন জরুরী।
শওকত আজিজ রাসেল বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি এক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। ব্যবসা পরিচালন ব্যয় হ্রাসে বিশেষকরে দূর্নীতি কমানোর উপর তিনি জোরারোপ করেন। তিনি আরো বলেন, অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিজস্ব গ্যাস উৎপাদান না করায় আমাদেরকে উচ্চ মূল্যের গ্যাস দিয়ে শিল্পকারখানা পরিচালিত হচ্ছে, ফলে আমাদের সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, ২০২৬ এ আমাদের এলডিসি গ্রাজুয়েশন স্থগিত করতে হবে, কারণ আমরা এখন বেঁচে থাকার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছি তাছাড়া এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল বেশকিছু ভুল তথ্যের ভিত্তিতে। তিনি উল্লখ করেন, আমাদের আমদানি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে, পাশাপাশি কমেছে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যসংযোজন। তিনি জানান, গ্যাসের সংকটের অভাবে আমরা ফেব্রিক্স তৈরি করতে পারছি না ফলে এ ধরনের পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হচ্ছে। পাশপাশি তিনি বাণিজ্য সংগঠনগুলোকে রাজনীতির বাইরে রাখার আহবান জানান।
মুক্ত আলোচনায় ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান রোমো রউফ চৌধুরী, ডিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি হোসেন খালেদ, রিজওয়ান রাহমান অংশগ্রহণ করেন। বক্তারা ব্যবসায়ীদের হয়রানি রোধ, ভোটের স্বার্থে পকেট এসোসিয়েশন তৈরি বন্ধ করা, এবং হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়ানোর উপর জোরারোপ করেন।
ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী, সহ-সভাপতি মোঃ জুনায়েদ ইবনে আলী, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ, প্রাক্তন সভাপতিবৃন্দ সহ বেসরকারিখাতের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।