মঙ্গলবার ১ জুলাই ২০২৫ ১৭ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ১ জুলাই ২০২৫
অস্থির বাজার
সবকিছুর মূলে ডলার!
ফাতেমা তুজ জোহরা, ঢাকা
প্রকাশ: শনিবার, ২০ আগস্ট, ২০২২, ৭:০৩ PM
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কয়েক মাস ধরে অস্থিতিশীল নিত্যপণ্যের বাজার। বাড়তি ব্যয়ভার বহন করতে হচ্ছিল মানুষের। তার মধ্যেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় দফায় দফায় বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। দ্রব্যমূল্যের লাগামাহীন ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষেরঅ্য। স্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির পেছনে কারণ হিসেবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার বিষয়টি উঠে আসছে।

দেশের বাজারে ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে রেকর্ড করেছে জ্বালানি তেল, স্বর্ণ। এমনকি নিত্যপণ্যের বাজারেও দেখা যাচ্ছে রেকর্ড মূল্য। ডিমের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। লিটারপ্রতি ডিজেল ও কেরোসিনে এক লাফে ৩৪ টাকা এবং অকটেনে ৪৬ ও পেট্রলে ৪৪ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। ২৭ জুলাই-৭ আগস্ট মধ্যে চার দফা বাড়ানো হয় স্বর্ণের দাম। ফার্মের লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা হালি দরে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য এখন টিকে থাকাই জীবনের বড় সংগ্রাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আপাতত এ সমস্যার কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। তবে এর মূলে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা ডলার। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবকিছুতেই এর প্রভাব পড়েছে। এমনকি দেশের খোলাবাজারেও অস্থিতিশীল ডলারের দাম। সঙ্গে রয়েছে ডলার সংকট। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।

তারা আরও বলেছেন, বিদেশি মুদ্রার আয় বাড়ানোর জন্য যত ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব, সবই নিতে হবে। এজন্য রপ্তানিপণ্য ও বাজার বহুমুখী করতে হবে। দেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য পোশাক। এছাড়াও অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সঙ্গে ইউরোপের পাশাপাশি পণ্য রপ্তানির জন্য অন্যান্য দেশ খুঁজতে হবে। বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

গত ৫ আগস্ট রাতে লিটারপ্রতি ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, অকটেনে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ ও পেট্রল ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করার সিদ্ধান্ত জানায় সরকার, যা ওইদিন রাত ১২টার পর থেকেই কার্যকর হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর হু হু করে বেড়েছে বিভিন্ন পণ্যের দাম। দেশের বাজারে প্রথমবারের মতো এক ডজন ডিমের দাম ১৬০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়।

দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে চাল, আটা, ময়দা, সাবান, মসুর ডাল, ফল, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। চালের দাম কেজিতে ৩-৫ টাকা বেড়েছে। এতে গরিবের মোটা চালের কেজি ৫৫ টাকায় উঠেছে। আটা, ময়দার দাম কেজিতে ৫-৭ টাকা বেড়েছে। প্রকারভেদে মসুর ডালের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০-১৫ টাকা। বিভিন্ন ফলের দাম কেজিতে ৩০-১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সবজির দাম বেড়েছে কেজিতে ১০-২০ টাকা। 

কালশী বাজারের ডিম বিক্রেতা রমজান আলী বলেন, লাল ডিমের হালি বিক্রি করছি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। ডজন বিক্রি করছি ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা। দেশি মুরগির ডিমের (কক) দামও বেড়েছে। এখন ডজন বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকায়।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘আপাতত মূল সমস্যা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। তবে এর গোড়ার সমস্যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। রিজার্ভ যা, তাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে। এ সমস্যা আরও প্রকট হবে। সবকিছুর দাম বাড়বে। কারণ তেল হলো সবকিছুর গোড়া। এটাকে বলে সিজার ইফেক্ট। অর্থাৎ যেতেও কাটে, আসতেও কাটে। আমদানি করতে হবে বেশি দামে। আবার আমদানি করা পণ্য দিয়ে উৎপাদন করতে বেশি খরচ পড়বে। আলটিমেটলি ক্রেতা বিপদে পড়েন।’

এ সংকট থেকে উত্তরণে বৈদেশিক মুদ্রা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানোর তিনটা পথ আছে। এর একটি রপ্তানি বাড়ানো। রপ্তানি বাড়ালে আপনি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবেন। এটা কীভাবে করবেন, সেটা নীতিনির্ধারক যারা আছেন, তাদের সঙ্গে বসতে হবে। দ্বিতীয়ত, রপ্তানি যা করছেন, সেখানে খরচ কমানোর কোনা সুযোগ আছে কি না, তা দেখতে হবে। খরচ কমানোর সুযোগ থাকলে, সেগুলো ব্যবহার করতে হবে।’

‘তৃতীয় বিষয়টি হলো- ট্রেডিশনাল রপ্তানিপণ্য ও ট্রেডিশনাল রপ্তানি গন্তব্য এ দুটিই বহুমুখীকরণ করতে হবে। আপনার প্রধান গন্তব্যস্থল যেটা, সেখানে কিন্তু যুদ্ধ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধিয়েছে। এতে পুরো ইউরোপে যুদ্ধাবস্থা। সেখানে মানুষের জীবন ব্যবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেটাও মাথায় রাখতে হবে। আর একটা হলো প্রচলিত পণ্য না, মানুষ। যাদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পান। দক্ষ মানুষ বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে’ বলেন ড. আবুল বারকাত।

বর্তমান সংকট কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে, জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইমিডিয়েট (অতি দ্রুত) একটা সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। খালি স্লোগান দিয়ে, পলিটিক্যাল বক্তব্য দিয়ে লাভ হবে না। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে কী করা যায়, তা ঠিক করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন, মধ্যবর্তীকালীন ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। এ পরিকল্পনা শুধু জ্বালানি খাতের জন্য না, রপ্তানি ও বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে হতে হবে। তা না হলে আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো আরও প্রকট হবে।’

তিনি বলেন, ‘চ্যালেঞ্জগুলো শুধু মহামারি করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোষ দিলে হবে না। নিজস্ব সমস্যাগুলো তো আমরা বহুদিন সমাধান করিনি। অর্থের অপচয়, পাচার, জবাবদিহিতার অভাব, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে টাকা ব্যয়, এগুলো এখন কমাতে হবে। লোক দেখানো প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। মানুষের জীবিকা ও জীবনব্যবস্থার উন্নয়ন হয় এমন কাজগুলো করতে হবে।’

এদিকে, সম্প্রতি ১০ দিনের (২৭ জুলাই-৭ আগস্ট) মধ্যে চার দফা বাড়ানো হয় দামি ধাতু স্বর্ণের দাম। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) প্রতিবারই দাম বাড়ার কারণ দেখিয়েছে স্থানীয় বাজারে তেজাবী স্বর্ণের (পাকা স্বর্ণ) মূল্যবৃদ্ধিকে। এর আগে কখনো দেশের বাজারে এভাবে স্বর্ণের দাম বাড়ানো হয়নি। এমন দাম বাড়ানোর ফলে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ৮৪ হাজার ৩৩১ টাকা হয়ে যায়, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। অথচ বিশ্ববাজারে ওইসময়ে স্বর্ণের দাম বাড়েনি।

বিশ্ববাজারে দাম না বাড়ার পরও দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ার বিষয়ে বাজুসের সাবেক সভাপতি ওয়াদুদ ভূইয়া বলেন, ‘দেশের বাজারে স্বর্ণের যে দাম বেড়েছে, তার মূল কারণ ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। ডলারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এখন ১১২-১১৩ টাকার নিচে এক ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ডলার এ দাম ধরে হিসাব করলে দেখা যাবে, দেশে স্বর্ণের যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, তা একদম ঠিক আছে।’

-বাবু/ফাতেমা
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত