মানবজীবন বৈচিত্র্যময় আয়োজনের সমন্বিত রূপ; এখানে সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি হয় নানাবিধ কর্মসাধনের মাধ্যমে। তবে সকল কর্মসাধনা অর্থ উপার্জনের নিমিত্তে কিংবা স্বার্থের দৃষ্টিকোণে প্রবাহমান তা কিন্তু নয়; কিছু কর্মকাণ্ড নির্মল আনন্দ উপভোগের জন্যই মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে যায়। খেলাধুলা হচ্ছে তেমনই আনন্দের উপকরণ, যা মানুষ শত ব্যস্ততা, জীবন জটিলতার নানা উত্থান-পতনের মাঝেও সানন্দে গ্রহণ করে। এমন কোনো মানুষ নেই যে খেলাধুলার মতো নির্মল আনন্দে উদ্বেলিত হতে চায় না।
ফুটবল খেলা তেমনই একটা নির্মল আনন্দ উপভোগের সেরা মাধ্যম। যারা এটা খেলে এবং চর্চা করে প্রথমত তারা মনকে উৎফুল্ল রাখতে এবং শারীরিক ফিটনেস ঠিক রাখতেই খেলে; পরবর্তীতে সেটা নেশা এবং পেশায় পরিণত হয়। আর দর্শকবৃন্দ তাদের এই উদ্দীপনা, কসরৎ, নিপুণ কৌশলক্রিয়া দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হয়।
বিশ্বায়নের এই যুগে ফিফা বিশ্বকাপ সকল দেশ, কাল, ধর্ম, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক মানবগোষ্ঠীকে একসাথে গ্রন্থিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছে; ভাষার বৈচিত্র্য, জাতিগত দ্বন্দ্ব, বর্ণবাদের নিকষকালো অন্ধকার, পৃথিবীর মানচিত্রে দেশ নামক সীমানা প্রাচীর ভুলে এক এবং অদ্বিতীয় বিশ্বসত্তার পতাকাতলে জড়ো করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সারাবিশ্ব কাতার বিশ্বকাপের জৌলুষে ভরা উন্মাদনায় বিভোর ছিল।
কিন্তু খেলা নামক পার্থিব উল্লাসে মেতে ওঠা নির্মোহ ভালোলাগাটুকু হারিয়ে যায় দলীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। যেকোনো বিষয় নিয়ে মানুষ নিজস্ব মতামত ও বিচার-বিশ্লেষণ পেশ করবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ অন্যদলের সমর্থক নই বলে তাদের শিল্পকৌশল, খেলার নৈপুণ্যে আগ্রহী না হয়ে শুধু একপেশে গালমন্দ করে যাবেন এটা কেমন কথা!
বাঙালি চিরকালই প্রতিক্রিয়াশীল জাতি; অন্যের বিষয়ে নাক গলাতে এরা সিদ্ধহস্ত। এমনকি নিজের মন্দ হবে জেনেও এরা নানাবিধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পিছপা হয় না। ক্রীড়াশিল্পে মুগ্ধ হওয়ার চেয়ে দলীয় সমর্থকের নামে যে পরিমাণ বিষোদগার উদগীরণ করে তাতে শঙ্কিত হতে হয়। খেলা অন্তরের খোরাক জোগায় এবং একদল আরেকদলকে নিষ্ঠা, বুদ্ধিমত্তা, কৌশল, কঠোর অনুশীলন, শারীরিক শক্তি দ্বারা পরাজিত করার দুর্দান্ত মানসিক শক্তি নিয়ে লড়ে যায়। তাদের মধ্যেও দেখা যায় সহমর্মিতা, সৌজন্যতা। আর দর্শক সারিতে বসে হাততালির মাধ্যমে তাদেরকে উৎসাহ জাগানো হচ্ছে কর্তব্য। অথচ চিল্লায়েই দলকে জয়ী করার মানসিকতায় লিপ্ত হয়ে যায় মানুষ কোনো কোনো ক্ষেত্রে।
এই প্রতিযোগিতামূলক খেলার মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে; শুধু যে বিনোদনের উদ্দেশ্যে খেলাধুলা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে তা কিন্তু না; কোনো দেশ এবং জাতিকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমন অনেক দেশ আছে পৃথিবীর বুকে যাদের পরিচয় দেওয়ার মতো তেমন কিছু নেই; তবে খেলাধুলার মাধ্যমে তারা নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে মাথা উঁচু করে পৃথিবীর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বকাপ আসলেই আমরা যত্রতত্র নানাবিধ পতাকার ব্যবহার লক্ষ করি। মূলত দলীয় সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ এসব পতাকার ব্যবহার হয়।কিন্তু স্বাধীন দেশ ও মাটিতে পতাকা উড়ানোর কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বিশ্বকাপ খেলা শুরু হলে নিয়মের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছাখুশিতে ধ্বজা উড়িয়ে নিজেকে নির্দিষ্ট দলের সমর্থক হিসেবে জানান দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে অনেক আগে থেকেই।
বিশ্বকাপ শুরু হলে আরও একটা মন্দ দিক হল পৃথিবীটা একটি মেরুদণ্ডের খণ্ডখণ্ড অস্থিতে রূপান্তরিত হয় এবং ধর্মীয় উন্মাদনা থেকেও এই নির্মল আনন্দের পটভূমিটা রেহাই পায় না। এমনকি রাজনৈতিক ভিন্ন মতাদর্শে জর্জরিত হয়ে ওঠে সারাবিশ্ব। বর্ণবাদের বুলিংয়েও পরিণত হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। জাতিগত বৈষম্যে লিপ্ত করতেও দ্বিধা করে না। আধুনিক বিশ্ব মানবজাতির মধ্যকার বৈষম্য দূর করার নিমিত্তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; এতসব বিভাজন, সংকীর্ণতা, হিংসা-বিদ্বেষ, বিষোদগার উদগীরণ, মানবজাতিকে মূল উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে বাধাগ্রস্ত করে; আরও পেছনে নিয়ে যায়। পৃথিবীর সমস্ত দেশ ও জাতিকে একত্রিত করার বদলে বিভাজনের দেয়াল প্রকট করে তোলে। এজন্য চাই সুষ্ঠু নিয়ম শৃঙ্খলা, সামাজিক মূল্যবোধ ও সর্বোপরি প্রকৃত দেশাত্মবোধে বলীয়ান হয়ে নির্মল বিনোদনে শরিক হওয়া।
চিত্ত বিনোদন অন্বেষণই খেলার মূল উপজীব্য বিষয়। এখানে হারজিত থাকবেই। মনকে প্রফুল্ল রেখে খেলোয়াড়দের দক্ষতা এবং দেশপ্রেম থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিক্ষা নিতে হবে। বাঙালি লড়াকু জাতি। সৃষ্টির আদি থেকে তারা কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থানে উপবিষ্ট হয়েছে। এদের মধ্যেও রয়েছে দেশের প্রতি মমত্ববোধ এবং দায়বদ্ধতা। অতএব গুটিকতক মানুষের ব্যর্থ উন্মাদনা, পতাকা ও সার্বভৌমত্বের অসম্মান কোনোক্রমেই দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে না। বিশ্বকাপ ফুটবলের সৌন্দর্য হল দেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া; প্রাণপন লড়ে যাওয়ার শিক্ষাটা শিখে নেওয়া। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে নানাবিধ সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাপূর্ণ দেশ ও জাতি হিসেবে,বিশ্বের দরবারে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে সর্বশ্রেণির মানুষকে এগিয়ে যাওয়াই কর্তব্য।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট
বাবু/জেএম