চা শ্রমিকদের জন্য মালিক পক্ষের প্রকাশিত দৈনিক মজুরির তালিকা হাস্যকর বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-এর নেতৃবৃন্দ।
শনিবার বিকেল ৫টায় ঢাকার পুরানা পল্টন মোড়ে চা শ্রমিকদের আন্দোলন সমর্থনে এক সংহতি সমাবেশে এসব কথা বলেন বক্তারা।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, একজন শ্রমিক দিনে মাত্র ১২০ টাকা মজুরি পায় ‘এখন এটা’ বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা করার কথা বলা হচ্ছে। এটা কি মানবিক? নেতৃবৃন্দ চা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করার দাবি জানান।
বক্তারা, চা শ্রমিকের সন্তানদের ভবিষ্যত জীবন নিশ্চিত করতে প্রত্যেক বাগানে প্রাথমিক স্কুল ও প্রত্যেক ভ্যালিতে উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনেরও দাবি জানিয়ে বলেন, চা শ্রমিকের শিক্ষিত সব সন্তানদের চাকরির নিশ্চয়তা এবং সব জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটনোর জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের করতে হবে।
এছড়াও বক্তারা, বাগানের শ্রমিকদের ছুটি বৈষম্য দূর করা, রেশনের মান ও পরিমাণ বাড়ানোসহ প্রতিটি বাগানে মানসম্মত চিকিৎসা কেন্দ্র, পর্যাপ্ত খাবার পানি ও শৌচাগার স্থাপনেরও দাবি জানান।
সিপিবি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক এ.এন. রাশেদার সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আব্দুল্লাহ আল কাফি রতন, এডভোকেট মন্টু ঘোষ ও কাজী রুহুল আমিন। সমাবেশ পরিচালনা করেন সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জলি তালুকদার।
সমাবেশ শেষে চা-শ্রমিকদের আন্দোলনের সমর্থনে একটি মিছিল প্রেসক্লাব, তোপখানা রোড প্রদক্ষিণ করে সিপিবি কার্যালয়ে এসে শেষ হয়।
এদিকে দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে টানা ৮ দিন ধরে কর্মবিরতিতে চা শ্রমিকরা। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও শ্রম অধিদপ্তরের হস্তক্ষেপে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা বিষয়টি মেনে চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন সাধারণ শ্রমিকরা।
হবিগঞ্জের লস্করপুর ভ্যালির ২৪টি চা বাগানের শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন তারা চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে কর্মবিরতি চালিয়ে যাবেন। সেই সঙ্গে ভ্যালির নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
লস্করপুর ভ্যালির সাধারণ সম্পাদক অনুরুদ্ধ বাড়াইক বলেন, ‘চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা আমাদের সাথে আলোচনা না করেই ১৪৫ টাকা মজুরিতে স্বাক্ষর করেছে। আমরা এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা আমাদের কর্মবিরতি চালিয়ে যাব।
‘রাতে আমরা আমাদের ভ্যালির নেতাদের নিয়ে আলোচনায় বসে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা দেব।’
জানা যায়, শনিবার দুপুরে শ্রীমঙ্গলস্থ বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের অফিসে চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী ও মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া।
অপরদিকে, চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল ও বিভিন্ন ভ্যালির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।
বৈঠক শেষে শনিবার বিকেলে চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল জানান, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন। শ্রমিকদের মজুরি ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া খোদ প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর থেকে ফিরে চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করবেন। চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এ সময় তাদের দাবিদাওয়া প্রধানমন্ত্রীর নিকট উপস্থাপন করবেন। এই আশ্বাসে তারা আপাতত ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন। রোববার থেকে সব বাগানে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেবে।
কিন্তু নেতাদের এই সিদ্ধান্তকে মেনে নেননি সাধারণ চা শ্রমিকরা। বৈঠকের পরপরই শ্রীমঙ্গলস্থ শ্রম দপ্তরের সামনেই বিক্ষোভ শুরু করেন স্থানীয় চা শ্রমিকরা। তারা ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ারও কথা জানান তারা। এসময় সমিতির নেতাদের প্রতিও ক্ষোভ জানান সাধারণ শ্রমিকরা।
বাংলাদেশ চা কন্যা নারী সংগঠনের সভাপতি খায়রুন আক্তার বলেন, ‘আমাদের দালাল নেতারা ১৪৫ টাকা মজুরিতে স্বাক্ষর করেছে। তারা আমাদের কষ্ট কি বুঝবে। আমরা খেয়ে না খেয়ে ১২ দিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছি। এখন তারা আমাদের সাথে আলোচনা না করেই ১৪৫ টাকা মজুরিতে স্বাক্ষর করেছে। আমরা এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করছি। সেই সাথে দালাল নেতাদের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাই।’
হবিগঞ্জে চা বাগানের সংখ্যা ৪২টি। এর মধ্যে লস্করপুর ভ্যালিতে শ্রমিকের সংখ্যা ৩৫ হাজার। এর মধ্যে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২৭ হাজার।
বৈঠকের পর সিলেটের মালনিছড়া, হিলুয়াছড়া ও তারাপুর চা বাগানে শ্রমিকরাও এ সিদ্ধান্তকে বয়কট করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কয়েক শ চা শ্রমিক বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মালনিছড়া বাগানের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।
এ সময় মিছিলে উপস্থিত থাকা চা শ্রমিক ফেডারেশনের সংগঠক অজিত রায় বলেন- আমরা এ সিদ্ধান্ত মানি না। কমপক্ষে ২০০ টাকা দৈনিক মজুরি ছাড়া মানবো না। আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবো।
-বাবু/ফাতেমা