নদ-নদী মানবজীবনে ও মানবসভ্যতায় এক অনবদ্য সংযোজন। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর উপস্থিতি আমাদের জীবনে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে নদীর প্রভাব। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্লোগান ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’। এর মাধ্যমে বাঙালিত্বের পরিচয়ে নদী মাতৃকতা বাঙময় হয়ে ফুটে উঠেছে। সৃষ্টির আদি থেকে কত শত জনপদের জন্ম দিয়েছে এই নদী; বিভিন্ন স্থানে গ্রহণ করেছে বিচিত্র সব নাম। নদীর আশির্বাদে কত ব্যক্তি বা জনপদ হয়েছে সমৃদ্ধ। আবার ক্রোধে নিঃস্ব হয়েছে অসংখ্য মানুষ বা জনপদ। প্রতিবছর নদী ভাঙ্গন কিংবা জলোচ্ছ্বাসের শিকার হয়ে অসংখ্য মানুষ হয় গৃহহীন। আবার সুপেয় পানির অভাবে হাহাকার চলছে পৃথিবীর অন্য কোথাও। সুকুমার রায়ের ‘ষোল আনাই মিছে’ কবিতার বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাই আর মুর্খ মাঝির কথোপকথন জ্ঞানপিপাসুদের জন্য এক অসাধারণ শিক্ষা।
নদীও নারীর মতো কথা কয়’- অর্থাৎ নদীর সঙ্গে রয়েছে আবেগের সম্পর্ক। নদীর জন্য কত মানুষের কত বিচিত্র রকমের আকুতি। গ্রামে একটি নদী না থাকায় আনসারউদ্দিনের দুঃখের শেষ নেই। ‘হে নদী, দেখা যদি পাই’ নিবন্ধে নদীর প্রতি তাঁর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন এভাবে, ‘কেন যে জলঙ্গি নদী আমাদের গ্রাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল! এ নিয়ে কত কথা, কত কথকতা। শোনা যায় কোনও এক বর্ষায় জলঙ্গি নদী এদিকেই এগিয়ে আসছিল। তাই দেখে তামাম গ্রামের মানুষ আঁতকে উঠেছিল। বাড়ি বাড়ি মানুষ আর মেয়েমানুষের কান্নার রোল। অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে গাছের মগডালে আশ্রয় নিয়েছিল। শেষমেশ গাঁয়ের মোড়ল মাতব্বরদের মজলিস বসল। তাতে সিদ্ধান্ত হলো-দাও নদীর মুখে হুড়ি জ্বালিয়ে। এমন নির্দেশ কার্যকর করতে গাছের শুকনো ডাল লতাপাতা দিয়ে বানানো হল হুড়ি। তাতে অগ্নিসংযোগ করে জলঙ্গির দিকে ছুঁড়ে মারতেই জলঙ্গির তাবৎ জলরাশি অগ্নিশিখায় পরিণত হল। সেই অগ্নিশিখার স্পর্শে আকাশের জলভরা মেঘ শুকিয়ে গেল। সেবার আষাঢ়ের আকাশ থেকে এক ফোঁটাও বৃষ্টি ঝরেনি। পরের বছর যে বৃষ্টি ঝরেছিল তাতে জলঙ্গির আবার গতি সঞ্চার হলো। আমাদের শালিগ্রাম থেকে তার অভিমুখের পরিবর্তন হয়ে হুদি পীতাম্বরপুরের দিকে ঘুরে গেল’।
নদীর লিঙ্গ নিয়ে বিশ্বজুড়ে কোথাও কোনো বিতর্ক না থাকলেও এই বঙ্গে রয়েছে আনন্দমুখর যুক্তি-পাল্টা যুক্তি। কেউ কেউ মনে করেন যে সব জলরাশির শাখা-প্রশাখা নেই সেগুলো ‘নদ’ এবং যেগুলোর শাখা-প্রশাখা রয়েছে সেগুলো ‘নদী’ নামে পরিচিত। কিন্তু ‘শীতলক্ষ্যা’ কিংবা ‘যমুনা’ নামক শাখা নদী থাকলেও ব্রহ্মপুত্র নদ। তাই, বলা যায় ‘নদ’ বা ‘নদী’ হওয়ার সঙ্গে শাখা-প্রশাখা থাকা না-থাকার বিষয়টি বেশ গোলমেলে। বরং ‘নদ’ বা ‘নদী’ হওয়ার ব্যাকরণগত রীতি বিশ্লেষণে সমাধানের একটি পথ পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞগণের মতে বাংলা ভাষায় পুরুষবাচক শব্দ সাধারণত ‘অ’ এবং ‘উ’-কারান্ত হয়। অপরদিকে, নারীবাচক শব্দ সাধারণত ‘আ, ই বা ঈ’-কারান্ত হয়। তাই যে সব স্রোতধারার নাম পুরুষবাচক অর্থাৎ অ ও উ-কারান্ত সেগুলো 'নদ' এবং যে স্রোতধারার নাম নারীবাচক অর্থাৎ আ বা ই, ঈ-কারান্ত সেগুলো নদী। ‘আড়িয়াল খা’ পুরুষ বাচক শব্দ হওয়া সত্ত্বেও উল্লিখিত নিয়মের আলোকে তা একটি নদী; আবার আমাজন নদী হিসেবে পরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে একটি নদ। একই ব্যাখ্যায় ‘মগড়া’ শব্দটি পৌরুষ বা ত্যাড়ামি নির্দেশক হলেও তা একটি নদী; অপরদিকে, কংসের মতো ধনুও একটি নদ।
নেত্রকোণার নদীর কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে সোমেশ্বরীর কথা। একটু পিছন থেকেই শুরু করা যাক। সেন বংশীয় শাসনামলে পূর্ব-ময়মনসিংহ এলাকায় কতিপয় ছোট ছোট রাজ্য গড়ে ওঠে। এগুলোর মধ্যে দুর্গম পাহাড়ি এলাকাসমৃদ্ধ সুসঙ্গ ছিলো অন্যতম। পূর্ব-ময়মনসিংহের এই ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো তৎকালীন প্রাগজ্যোতিষপুর বা কামরূপ নামক তান্ত্রিক রাজ্যের অধীনে ছিলো। বখতিয়ার খিলজি কামরূপ জয়ের অভিযান ব্রহ্মপুত্রের তীরে এসে শেষ হলেও ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ইক্তার উদ্দীন উজবেগ তুগ্রিল খাঁ কামরূপ বিজয় করেন। কিছুদিনের মধ্যে কামরূপরাজ পুনরায় রাজ্য দখল করেন। এই দখল-পুনঃদখলের বিশৃঙ্খলায় পূর্ব-ময়মনসিংহের ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে তাদের অবস্থান সুসংহত করে নেয়। পাহাড়ি দুর্গম এই এলাকার অধিবাসীগণ বিশেষত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যগণ বাইরের সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো। তাদের শাসক বাইশা বা বৈশ্যা গারো ছিলো নিষ্ঠুর প্রকৃতির একজন সামন্ত রাজা। স্বাভাবিকভাবেই প্রজারা ছিলো অত্যাচারিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত।
৬৮৬ বঙ্গাব্দে (১২৮০ খ্রিষ্টাব্দ) কণ্যাকুব্জ থেকে আগত একজন সাধু সোমেশ্বর পাঠক কামরূপ কামাখ্যায় তীর্থ ভ্রমণ করেন। সেখান থেকে ফেরার পথে তিনি গারো পাহাড়ের গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত খড়স্রোতা একটি নদীর তীরে আশ্রম নির্মাণপূর্বক বসবাস শুরু করেন। কপালে যার রাজতিলক খচিত, তিনি কি নিজেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে থাকতে পারেন, মৎস্য শিকারে যাওয়া একদল জেলে তার দিব্যজ্যোতি দেখে আকৃষ্ট হয়। তারা সাধুপুরুষের আশির্বাদ লাভের উদ্দেশ্যে তার পদতলে নিজেদের নিবেদন করে। তাদের দুর্দশা ও নির্যাতনের কথা খুলে বলে সোমেশ্বর পাঠকের কাছে। আবেদন জানায় সমতলে এসে অত্যাচারী শাসক বৈশ্যা গারোর নির্যাতন থেকে প্রজাদের রক্ষা করার। সাধারণ প্রজাদের দুর্দশার কাহিনি শুনে তিনি খুবই মর্মাহত হন এবং তাদের সংগঠিত করতে ব্রতী হন। এক সময়ে বৈশ্যা গারো ও তার সৈন্যদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হন তিনি। সরাসরি যুদ্ধে বিজয়ী হতে না পারলেও কৌশলের যুদ্ধে তিনি বৈশ্যা গারোকে পরাস্ত করে শাসন ক্ষমতা নিজের করায়ত্ত করে নেন। এভাবে দৃশ্যপটে আগমন ঘটে সুসং জমিদার বংশের আদি পুরুষ সোমেশ্বর পাঠকের। জেলে, নদী ও সোমেশ্বর পাঠক-এই ত্রয়ীর মিলিত শক্তিতে দুর্গম পাহাড়ি এলাকার প্রজাদের মুক্তি ঘটে অত্যাচারী শাসকের নিপীড়ন থেকে।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কুলকুল ধ্বনিতে নেমে আসা টলটল পানির সেই স্রোতধারা গারোদের নিকট ‘সিমসাং’ নামে পরিচিত ছিলো। গারো ভাষার দুটি শব্দ sima অর্থ ‘কালো’ এবং sang অর্থ ‘স্বচ্ছ, পরিষ্কার’ থেকে ‘সিমসাং’ (simsang) শব্দের উৎপত্তি। গারো ভাষার ‘সিমসাং’ শব্দের অর্থ তাই ‘কালো, স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানি’। কথিত আছে যে, উৎসমুখের দিকে এই নদীর পানি খুবই স্বচ্ছ ও টলটলে পরিষ্কার ছিলো। এই নদীর কোথাও কোথাও ‘wari’ বা গভীর ডোবার মতো থাকলেও পানির স্বচ্ছতার জন্য নদীর তলদেশের বালু-পাথরসহ মাছগুলোও স্পষ্ট দেখা যায়। তাইস্ফটিক-স্বচ্ছ পানির নদী হিসেবেই গারো সম্প্রদায় এই নদীর নামকরণ করে ‘সিমসাং’। আর সিদ্ধ অর্থাৎ সৎ পুরুষের সঙ্গ থেকেই এই পরগণার নাম হয় সুসঙ্গ। নদীটি ছিলো গারো তথা সুসঙ্গের জন্য আশির্বাদ। এ জন্য সোমেশ্বর পাঠকের প্রতি কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গারোদের পরিচিত ‘সিমসাং’ নদীর নতুন নামকরণ করা হয় ‘সোমেশ্বরী’ হিসেবে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া ও বাঙাছড়া ঝর্ণাধারা এবং রমফা নদীর মিলিত স্রোতেই সিমসাং বা সোমেশ্বরী নদীর সৃষ্টি। মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা বাজার হয়ে দুর্গাপুর উপজেলার (বর্তমান) বিজয়পুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। রাণীখং পাহাড়ের পাশ দিয়ে প্রবাহিত সোমেশ্বরী শুষ্ক মৌসুমে ধুধু বালুর চর।
আধ্যাত্মিকতা কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাস অথবা কুসংস্কারের সঙ্গে নদীর এই যোগসূত্র বহু পুরাতন। আরও অনেক দেশেই রয়েছে এমন কথাকাহিনি। গ্রিক মাইথোলজি অনুযায়ী ‘আকেরন’ পরাজগতের একটি নদী হলেও বাস্তবে এর অস্তিত্ব রয়েছে। এই নদীর খেয়া নৌকার মাঝি মৃত মানুষের আত্মাকে পরপারে নিয়ে যায় বলে কথিত আছে। কেউ কেউ আবার বলেন ‘স্টিক্স’ নদীর মাঝির নৌকায় করে মৃত মানুষের আত্মাগুলোকে পরকালে অর্থাৎ অসীমের পথে পাড়ি জমাতে হয়। তবে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অধ্যাপক আরজ আলীর রক্তস্নাত সোমেশ্বরী তার আশির্বাদ থেকে সুসঙ্গ বা দুর্গাপুরকে বঞ্চিত করেনি কখনও। হোয়াংহোর বয়ে আনা পলিমাটির মতো সোমেশ্বরীর বালু এখন দুর্গাপুর উপজেলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণভোমরা। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে প্রচণ্ড পাহাড়ি ঢলে সোজাসুজি দক্ষিণ দিকে সোমেশ্বরীর একটি নতুন গতিপথ সৃষ্টি হয়। এই নতুন স্রোতধারা জারিয়া-ঝাঞ্জাইল বাজারের পশ্চিম দিকে কংস নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
ভারতের তুরা পাহাড়ের কয়েকটি ঝর্ণার সম্মিলনে কংস নদের উৎপত্তি। শেরপুরের হাতিবাগার এলাকা দিয়ে কংস বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উৎপত্তি স্থল থেকে শেরপুরের নালিতাবাড়ী পর্যন্ত এই নদীটির নাম ভোগাই। ফুলপুর উপজেলার পর থেকে ভোগাই নদীটি ‘কংস’ নামে পরিচিতি লাভ করে এবং নেত্রকোণা জেলায় প্রবেশ করে। পূর্বধলা, নেত্রকোণা সদর, বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ধর্মপাশা উপজেলার সীমান্তে ঘোড়াউত্রা নদীতে পড়েছে।
মহাভারতের কাহিনি অনুযায়ী কংস ছিলেন ভোজ বংশীয় একজন রাজা। প্রজাপীড়ক হিসেবে তার মারাত্মক কুখ্যাতি ছিল। মথুরার রাজা উগ্রসেনের স্ত্রী পরমাসুন্দরী মহারানী পদ্মাবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে রাক্ষসরাজ দ্রুমিল প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে। সে রাজা উগ্রসেনের ছদ্মবেশে মহারানী পদ্মাবতীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করে। তাদের এই অবৈধ সম্পর্ক থেকেই কংস-এর জন্ম। যৌবনকালে কংস মগধের রাজা জরাসন্ধের দুই কন্যাকে বিবাহ করেন এবং জরাসন্ধের সহায়তায় বৃদ্ধ পিতা উগ্রসেনকে বন্দী করে রাজত্ব দখল করেন। এক সময় তিনি দৈববাণী প্রাপ্ত হন যে, তার বোন দেবকির অষ্টম সন্তান তাকে হত্যা করবে। এ জন্য তার বোন দেবকি ও ভগ্নিপতি বাসুদেবকে কারারুদ্ধ করেন এবং একে একে তাদের ছয় সন্তানকে হত্যা করেন মামা কংস। অর্থাৎ তার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা এবং প্রতিটি কর্মকাণ্ডই অনৈতিকতা, অবৈধতা ও নির্মমতায় পূর্ণ। তাই, সহজাতভাবেই ‘কংস মামা’ শব্দটি পরিচিতি পায় নির্মম আত্মীয়কে সংজ্ঞায়িত করার জন্য।
উৎসমুখে যে নদের নাম ‘ভোগাই’ (অর্থাৎ যা অন্যদের ভোগায় বা কষ্ট দিয়ে থাকে বলে প্রথম পুরুষেই স্বীকার করছে) এবং পরবর্তীতে ‘কংস’ নাম ধারণ করেছে তার বৈশিষ্ট্য অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। নদী আমাদের পরমাত্মীয়। সেই নদী বা নদ যদি হয় দুঃখের কারণ, সে নিশ্চয়ই হয় কংস মামা। এখনও যাত্রা পথের বিভিন্ন স্থানে কংস নদের ভাঙ্গার খেলা সেই নির্মম আত্মীয় কংস মামার কথাই মনে করিয়ে দেয়। প্রসঙ্গতকংস নদ আটপাড়া উপজেলায় মগড়া নদীর সঙ্গে মিলেছে।
গ্রীক ও রোমান পুরানের কাহিনি অনুযায়ী মুজ (Muses)-দের সঙ্গে সঙ্গীতের প্রতিযোগিতায় হেরে ডানা হারিয়ে সমুদ্রে পড়ে যায় ‘নারী ভয়ঙ্করী’ হিসেবে পরিচিত সাইরেনরা (Sirens)। তারা রূপ ও সুরের যাদুতে সম্মোহিত করেসমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকদের দ্বীপের মৃত্যুকূপ তরঙ্গক্ষুব্ধ, উত্তাল-পাথুরে উপকূলের দিকে নিয়ে যেত। সেখানে নাবিকদের জন্য নির্ঘাত মৃত্যু ওৎ পেতে থাকত। তেমন কোনো অভিশপ্ত সমুদ্র নয় বরং মগড়া নদী এসেছে আশির্বাদ হয়ে। পৃথিবী জুড়ে গড়ে ওঠা বহু সভ্যতার ন্যায় মগড়া নদী-বিধৌত হয়েই গড়ে উঠেছে নেত্রকোণার জনবসতি। নেত্রকোণা শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত একেবারে সাপের মতো একেবেঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে এই জনপদকে। ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে মগড়া নদীর সৃষ্টি। পূর্বধলা উপজেলার ভিতর দিয়ে ধলাই নামে প্রবাহিত হয়ে নেত্রকোণা সদর উপজেলার ত্রিমোহনীতে লাউয়ারি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে মগড়া নাম ধারণ করেছে। নেত্রকোণা জেলায় মগড়া নদীর প্রবাহ বা গতিপথ সবচেয়ে বেশি। মগড়ার এমন নামকরণ কিভাবে হলো তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে, এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্র সঙ্গীত আচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কথোপকথন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বভারতীর রসায়নের অধ্যাপক কবিগুরুর অত্যন্ত স্নেহভাজন শৈলজারঞ্জন মজুমদার নেত্রকোণা থেকে ফিরে গেলেই গুরুজি নদীটির কথা জিজ্ঞাসা করতেন।
তোমার নেত্রকোণার নদীর নামটা যেন কী? খালি ভুলে যাই।
: মগড়া।
: মগড়া মানে কী?
: মগড়া মানে হলো রাগী। যেমন মগড়া ঘোড়া।
: নদীর নাম মগড়া হলো কেন?
:নদীর নাম মগড়া হলো কেন, তা কেমন করে বলব? তবে, নদীটি কখনও সোজা গতিতে চলেনি। নেত্রকোণা শহরকে সাপের মতো পেঁচিয়ে দূরে চলে গেছে। এমনকি বাইরে গিয়েও একসাথে এক মাইল পথও সোজা চলেনি। বাঁক নিয়েছেবারবার। সে জন্যই হয়তো এই নদীর নাম হয়েছে মগড়া।
শৈলজা রঞ্জনের বর্ণনায় ‘মগড়া’ আর ‘ত্যাড়ামি’ বা ময়মনসিংহের আঞ্চলিকতায় ‘ত্যাকদামি’ সমার্থক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’র রাজার মতো আপন খেয়ালে ছুটে চলাতেই মগড়ার আনন্দ। কবি নজরুল ইসলামের এই ছন্দের প্রতিচ্ছবি হয়েই যেন মগড়ার আনমনা ছুটে চলা-
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি-ছমকি
পথ যেতে যেতে চকিতে চমকি
ফিং দিয়ে দেই তিন দোল
আমি চপলা-চপল হিন্দোল।
মগড়া নদী কেন্দুয়ার গুগবাজার হয়ে মদন উপজেলা অতিক্রম করে ধনু নদে বিলীন হয়েছে।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের যাদুকাটা ও ধোমালিয়া নামক দুটি নদীর সম্মিলনে ধনু নদের মূল প্রবাহের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তে এসে এর একাংশ সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর হয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী হয়ে কিশোরগঞ্জে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হওয়া এইনদের প্রথমাংশ ধনু, মধ্যভাগ বৌলাই, শেষাংশ ঘোরাউত্রা নামে মেঘনায় পতিত হয়। ঠিক যেন ‘গাঙর হয়েছে কখনও কাবেরী, কখনও বা মিসিসিপি, কখনও রাইন, কখনও কঙ্গো নদীদের স্বরলিপি’।
উল্লেখ্য ধনু একটি খরস্রোতা নদী। নেত্রকোণা জেলার প্রায় সব কটি বড় নদীই এই নদে পতিত হয়ে ভাটিতে গেছে। ১৭৬৪ সালে ইংরেজ সার্ভেয়ার জেমস রেনেল কর্তৃক অঙ্কিত মানচিত্রে সর্বপ্রথম ধনু নদের বিবরণ উঠে আসে। এই নদের প্রশস্ততা কম হলেও এর গভীরতা বেশ। তবে, পাড়গুলো অত্যন্ত খাড়া হলেও এর ভাঙ্গণ প্রবণতা নেই।
‘ধনু নদীর ইতিকথা’য় মো. রওশন আলী রশো উল্লেখ করেন যে, প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধে রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করে শ্রীরাম চন্দ্র লঙ্কা জয় এবং সীতাকে উদ্ধার করেন। লঙ্কাজয়ের মাধ্যমে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে শ্রীরাম চন্দ্র তার প্রিয় ‘হরধনু’ ত্যাগ করেন। রামের পরিত্যাক্ত অতিন্দ্রীয় ক্ষমতাসম্পন্ন ধনুক নিমিষেই হারিয়ে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। একদিন ঝুম বৃষ্টির পর পূব আকাশে দিগন্ত বিস্তৃত ধনুকাকৃতির বর্ণিল রঙের ছটা দেখতে পেয়ে রামের ভক্তগণ একেই হারিয়ে যাওয়া সেই ধনু মনে করে এর নামকরণ করেন ‘রামধনু’। পূর্ব দিকে তখন ছিলো দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। বাতাসে ভেসে থাকা জলীয়বাষ্প আর নদীর পানি একাকার হয়ে মানব দৃষ্টিতে এক অলঙ্ঘনীয় সাগরের সৃষ্টি করে। আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া এই জলরাশির অবস্থান ছিল পাণ্ডববর্জিত পূর্ব-ময়মনসিংহ বলে অনুমেয়। সময়ের পরিক্রমায় ভরাট হয়ে যাওয়া সেই জলরাশি থেকে জেগে ওঠে ধনুকের আকৃতির এক নদ; নাম যার ধনু। প্রবাহমান এই জলধারার গতিপথ আকৃতিতে অবিকল শ্রীরাম চন্দ্রের হাতের ‘হরধনু’র সদৃশ। তাই রামায়নে বিশ্বাসীগণ মনে করেন যে, শ্রীরাম চন্দ্রের পরিত্যক্ত সেই হরধনুই ‘ধনু’ নদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
ধনু নদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত কাহিনি, কত নিঃশ্বাস, কত হাহাকার। মৈমনসিংহ গীতিকার মহুয়া, মলুয়া, দেওয়ান ভাবনা এবং দেওয়ান মদীনার পালায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে ধনু নদের কথা এসেছে। আড়ালিয়া, বংশাইয়া, বাইদ্যার দিঘি, উলুয়াকান্দা, কাঞ্চনপুর, বামনিকোনা, বৈরাগীর ভিটা প্রভৃতি গ্রাম বা জনপদের অস্তিত্ব এই নদের তীরে বলেই কাহিনিতে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যেই ধনু নদের প্রকট উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়।
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী উপধা শব্দের অর্থ ছল, কৌশল, উপায়। আর ‘খালি’ শব্দের অর্থ শূন্য, রিক্ত কিংবা শুধু, কেবল। তাই উপধাখালী বা পরিবর্তিত উচ্চারণে উপদাখালি নামের অর্থ দাড়ায় কেবলি ছল বা প্রতারণা। উপধাখালি নদী অপ্রশস্ত হলেও বর্ষাকালে ভীষণ খরস্রোতা।
আকার দেখে ছোট নদী বা খাল মনে করলে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রায় প্রতিবছর এই নদীতে নৌডুবির ঘটনায় হতাহতের পরিসংখ্যান তাই নামকরণের সার্থকতাকেই ব্যাখ্যা করে। সোমেশ্বরীর শাখা নদীআত্রাখালি হতে পারে উতরাখালির রূপান্তর। উতরাই বা উতরানো শব্দের অর্থ হলোপাহাড় বা উঁচু জায়গা থেকে নিচের দিকে নামার পথ, ঢাল। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তীব্র পাহাড়ি ঢলে সোমেশ্বরী নদীর উতরানো পানির চাপে এই নদীর সৃষ্টি। শুষ্কমৌসুমে নদীটি শুকিয়ে গেলেও বর্ষাকালে আজও এই নদী হয়ে ওঠে খরস্রোতা, প্রমত্তা। দুর্গাপুর থেকে নাজিরপুর হয়ে এই আত্রাখালি নদী কলমাকান্দায় উপধাখালি নদীর সঙ্গে মিশেছে।
পেরুর ‘শানায় টিম্পিসখা’ নদীর পানি টগবগ করে ফুটছে সারাক্ষণ। প্রাচীন সভ্যতা ইনকা’র অধিবাসীরা ছিলো সূর্যের উপাসক। তারা এই স্রোতধারার ফুটন্ত রূপ দেখে এর নামকরণ করেন ‘সূর্যদেবের জলস্রোত’। ছয় মাইল লম্বা ও গড়ে ১৬ ফুট গভীরতার এই নদীর পানির তাপমাত্রা প্রায় ৯০-৯৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে থাকে। গরম পানির এই স্রোত নিজের যাত্রাপথ শেষ করে আমাজনে অবগাহন করে। অপরদিকে, পৃথিবীব্যাপী পরিচিত আমাজনের চার কিলোমিটার নিচে প্রায় ৬,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ আরও একটি নদী রয়েছে বলে দাবি করেন বিজ্ঞানীরা। ভূ-গর্ভস্থ এই নদীর প্রশস্ততা দৃশ্যমান আমাজনের প্রায় কয়েকশ’ গুণ বেশি। নদীকেন্দ্রিক এমন হাজারো চমকপ্রদ তথ্য ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বজুড়ে। এমনকি খনিতে পাওয়ার আগে নদীর তলদেশেই প্রথম হীরকখণ্ড পাওয়া গেছে বলেও কেউ কেউ দাবি করেন।
ধনু এবং কংস নদ ব্যতীত নেত্রকোণার অন্য নদ-নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়। এগুলো সম্পর্কে এমন চমকপ্রদ কোনো তথ্য জানা যায়নি। তবে এই নদ-নদীগুলো চাক্ষুস সাক্ষী হয়ে আছে আমাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের। নেত্রকোণার বিভিন্ন নদীর তীরে ১৯৭১ সালে সংঘটিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি যুদ্ধ হলো ৭ জুলাই কংস নদের বড়ওয়ারি ফেরিঘাট এলাকার যুদ্ধ, ১৩ জুলাই ঠাকুরাকোনায় কংস নদের ওপর রেলব্রিজ ধ্বংস করা, ২৬ জুলাই নাজিরপুর বাজারের নিকট আত্রাখালি নদীর সম্মুখ যুদ্ধ, ২৮ ও ২৯ আগস্ট তারিখে মদন উপজেলায় মগড়া নদীর পাড়ের যুদ্ধ; এবং ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোণা শহরের মগড়া নদীর তীর ও বিএডিসি’র খামার এলাকার যুদ্ধ।
৮ ডিসেম্বরে মগড়া নদীর তীরে প্রায় পাঁচ ঘন্টা স্থায়ী এই যুদ্ধের মাধ্যমে হানাদার পাকিস্তানীরা ময়মনসিংহের দিকে পলায়ন করে; আর নেত্রকোণা হয় শত্রুমুক্ত। মগড়া, কংস, আত্রাখালীর তীরবর্তী এই স্থানগুলো এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার গল্প প্রজন্মান্তরে গৌরব ও উদ্দীপনার আলো ছড়িয়ে যাক নিরন্তর। ভালো থাকুক নেত্রকোণার নদী, গভীর মমতায় আগলে রাখুক এই জনপদ।
বাবু/এসএম