১৯৯০ সালের ইতালি বিশ্বকাপ দিয়ে শুরু। এরপর থেকে বৈশ্বিক ফুটবলের বৃহত্তম এই আসরের প্রতিটি আয়োজনে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন ডেভিড হ্যানকক। কিন্তু ৩২ বছরের মধ্যে এই প্রথমবার ফুটবল বিশ্বকাপ বয়কট করছেন তিনি। কারণ, কাতারের রক্ষণশীল নিয়মকানুন; বিশেষ করে, সমকামিতা নিষিদ্ধ হওয়ায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ এই ব্রিটিশ নাগরিক।
বিবিসির খবরে জানা যায়, পেশায় স্পোর্টস ট্রাভেল এজেন্ট হ্যানকক। ক্রীড়া সাংবাদিকদের জন্য ভ্রমণ প্যাকেজের আয়োজন করেন তিনি। ১৯৯০ ফুটবল বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রতিটি টুর্নামেন্টে উপস্থিত ছিলেন ৫৮ বছর বয়সী এ ব্যক্তি।
কিন্তু কাতারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়া নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে এবারের টুর্নামেন্ট বয়কট করছেন তিনি। বিশেষ করে, সমকামীদের প্রতি কাতারের আচরণ মোটেও মেনে নিতে পারছেন না এসেক্সের এই বাসিন্দা।
কাতার বিশ্বকাপে হ্যানককের অন্তত ২০ জন ক্লায়েন্ট থাকবেন। তারপরও তিনি নিজে উপসাগরীয় দেশটিতে যেতে অনিচ্ছুক।
হ্যানকক বলেন, আমি সত্যিই [এই বিশ্বকাপে] খুব বেশি আগ্রহ পাচ্ছি না। এলজিবিটি (সমকামী ও রূপান্তরকামী) সম্প্রদায়ের প্রতি কাতার সরকার যে মনোভাব দেখাচ্ছে, আমি তা মেনে নিতে পারি না। আমি এও মনে করি, এই টুর্নামেন্টটিকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে পশ্চিমাদের রাজি করাতে বেশ ভালো কাজ করেছে তারা।
২০১০ সালে কাতারকে বিশ্বকাপ ফুটবলের ২২তম টুর্নামেন্টের আয়োজক হিসেবে ঘোষণা করে ফিফা। এ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে ‘অজ্ঞাত ব্যক্তিদের’ বিরুদ্ধে তদন্ত করছেন সুইজারল্যান্ডের প্রসিকিউটররা। তবে আজ পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি।
কাতারে ইসলামী শরিয়া আইন অনুসারে সমকামিতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বিশ্বকাপ শুরুর অনেক আগেই এ বিষয়ে সতর্ক করেছিল দেশটির সরকার।
বিশ্বকাপ উপলক্ষে বেশ কয়েকটি নতুন স্টেডিয়াম, হোটেল, বিনোদনকেন্দ্রসহ নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরি করেছে কাতার। তবে এসব প্রকল্পে কর্মীদের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধার অভাব এবং বেশ কয়েকজন অভিবাসী কর্মীর মৃত্যুর কারণে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে উপসাগরীয় দেশটিকে। যদিও অবহেলাজনিত সব ধরনের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে কাতার সরকার।
ডেভিড হ্যানকক জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিনি চারবার কাতারে গিয়েছেন এবং সেখানে ইংল্যান্ড টিমের হোটেলও পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেছেন, টুর্নামেন্ট এগিয়ে আসার পাশাপাশি আমার আরও অনেক উদ্বেগ রয়েছে।
হ্যানকক বলেন, সেখানে (কাতারে) কিছু করার নেই, কিছুই নেই। আপনি হয়তো পাঁচতারকা হোটেলে গিয়ে মদপান করতে চাইবেন, কিন্তু সেখানেও সম্ভাব্য সমস্যা দেখতে পাচ্ছি।
কাতারে কেবল নিবন্ধিত বার ও রেস্টুরেন্টেই মদ বা অ্যালকোহল বিক্রি হয়। প্রাথমিকভাবে বিশ্বকাপ চলাকালে স্টেডিয়ামের সঙ্গে কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় মদ বিক্রি হবে বলে জানিয়েছিল আয়োজকরা। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র দুদিন আগে ফিফা জানিয়েছে, স্টেডিয়াম এলাকায় দর্শকদের কাছে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
হ্যানককের অভিযোগ, ফিফা সবসময় বিশ্বকাপের উত্তরাধিকার নিয়ে কথা বলে। কেউ কি বলতে পারবেন, দোহা ও কাতারের জন্য কী উত্তরাধিকার হতে চলেছে?
ফুটবলের বাইরে বিশাল আয়োজন
আগামী ২০ নভেম্বর পর্দা উঠছে কাতার বিশ্বকাপের। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা দেখতে উপসাগরীয় দেশটিতে ছুটে যাবেন ১২ লাখের বেশি ফুটবলপ্রেমী। তবে কাতারের এই আয়োজন কেবল পৃথিবীর সেরা ৩২টি ফুটবল দলের লড়াইয়েই সীমাবদ্ধ নয়; বিশ্বের বিখ্যাত অনেক বিনোদনতারকার মনোজ্ঞ পারফরম্যান্সও সেখানে দেখতে পারবেন দর্শকেরা।
ধারণা করা হচ্ছে, সরাসরি স্টেডিয়ামে ও টেলিভিশন সেটের সামনে বসে এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল দেখবেন অন্তত ৫০০ কোটি মানুষ। অর্থাৎ, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে কাতারের নাম। তাই বিশ্বকাপের আয়োজনকে বর্ণাঢ্য করে তুলতে চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি।
পর্যটকদের জন্য কাতারে এখনই অন্তত তিনটি সংগীত উৎসব চলছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্যান্ড ব্ল্যাক আইড পিস, ডাচ ডিজে আরমি ভ্যান ব্যুরেনের পারফরম্যান্স দেখার সুযোগ পাবেন ভক্তরা।
কাতারের এই বিশাল সাংস্কৃতিক আয়োজনের কেন্দ্রে রয়েছে আর্কেডিয়া ফেস্টিভ্যাল। এতে ১০০ জনের বেশি আন্তর্জাতিক শিল্পী পারফর্ম করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। চলবে ১৯ নভেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর, অর্থাৎ ফাইনাল ম্যাচের পরের দিন পর্যন্ত।
কাতারের আইকনিক ইসলামিক আর্ট জাদুঘর আবারও খুলে দেওয়া হয়েছে গত মাসে। দর্শনার্থীদের জন্য ২০২২ সালে চালু হওয়া একঝাঁক নতুন স্থাপনার মধ্যে রয়েছে ৩-২-১ কাতার অলিম্পিক ও ক্রীড়া জাদুঘরও।
বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়া লাখ লাখ অতিথির রাতযাপনের জন্য অত্যাধুনিক সুবিধাযুক্ত অ্যাপার্টমেন্ট, হোটেল রুম, মরুভূমি ক্যাম্প, ভিলা, ও ফ্যান ভিলেজ তৈরি করেছে কাতার। এমনকি নোঙ্গর করা ক্রুজ শিপে কেবিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কাতার বিশ্বকাপের মহাসচিব হাসান আল থাওয়াদি সম্প্রতি বলেছেন, ঠিকমতো না জেনেই তার দেশের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এই টুর্নামেন্ট আয়োজনে উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য আমাদের ক্ষমাপ্রার্থী হওয়া উচিত নয়। কারণ আমরা ফুটবলপ্রেমী এবং অন্য যেকোনো জায়গার মতো ফুটবলপাগল। এই অঞ্চলকে বিশ্বের অন্যান্য অংশের কাছে তুলে ধরা এবং আমরা কে সে সম্পর্কে মানুষের ধারণা পরিবর্তনের বৈধ অধিকার রয়েছে আমাদের।
সূত্র: বিবিসি, আল-জাজিরা
বাবু/এসএম