সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫ ৩০ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫
গণপূর্তের’ নিয়োগে তিন ভুয়া সচিবের থাবা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৯:৫৯ AM আপডেট: ২৩.০২.২০২৩ ১০:০২ AM
এই প্রতারকচক্র ‘গণপূর্তের’ একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিকে পুঁজি করে চাকরি দেওয়ার নামে তিন শতাধিক প্রার্থীর প্রায় প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ থেকে ১২ লাখ টাকা করে হাতিয় নিয়েছে। সরকারি অফিসের ‘অব্যবহৃত কক্ষে’ বসে চাকরির পরীক্ষা শেষে কিউআর কোডযুক্ত নিয়োগপত্রও তুলে দেন চাকরিপ্রত্যাশীদের হাতে। তবে চাকরিতে যোগদান করতে গিয়ে তারা দেখেন সবকিছু ভুয়া। এ চক্রে কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিষয়টি নজরে এলে তদন্তে নেমে সম্প্রতি ৩ ভুয়া সচিবসহ ৭ প্রতারককে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি। এরপর বেরিয়ে আসে তাদের প্রতারণার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

জানা গেছে, গত বছরের ৬ এপ্রিল গণপূর্ত অধিদপ্তর ১৪ থেকে ১৬ গ্রেডের বিভিন্ন পদে ৪৪৯ জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এই বিজ্ঞপ্তি ঘিরে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন তিন ভুয়া সচিব আলমগীর, রেজাউল হক এবং হুমায়ূন কবির।

চাকরিপ্রত্যাশী সংগ্রহ করতে তারা কুষ্টিয়া, রংপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফরিদপুর ও বরিশালে দালাল নিয়োগ করেন। দালালদের মাধ্যমে কারও কাছ থেকে ৫ লাখ, কারও কাছ থেকে ৮ লাখ আবার কারও কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা নেন। এরপর বিভিন্ন সরকারি অফিসে অব্যবহৃত কক্ষে বসে তারা চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউও নেন। পরে ভুয়া নিয়োগপত্র ধরিয়ে দেন চাকরিপ্রত্যাশীদের হাতে। কিউআর কোডযুক্ত নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে কারও অবিশ্বাস জন্মায়নি এই চাকরিদাতাদের প্রতি। কিন্তু যখন যোগদান করতে যান, তখনই তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানানো হয়, এ নিয়োগপত্র সঠিক নয়, ভুয়া। 

এদিকে গণপূর্ত অধিদপ্তরে একের পর এক লোকজন এমন নিয়োগপত্র নিয়ে আসতে থাকলে বিষয়টি তারা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে অবগত করে। পরে গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগ বিষয়টি তদন্তে নামে। তারা সম্প্রতি এ চক্রের তিন ভুয়া সচিবসহ ৭ জনকে ঢাকা ও রাজবাড়ী থেকে গ্রেফতার করে। চক্রের অন্য সদস্যরা হলেন-পলাশ চন্দ্র সরকার, মো. আসাদুল হক, জাহিদ হাসান ও আসাদুজ্জামান ওরফে বাবু।

ডিবির একটি সূত্র জানিয়েছে, চক্রটির সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে যাতায়াত থাকায় চাকরিপ্রত্যাশীদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য কখনো কখনো নিয়ে যেতেন সচিবালয়সহ আশপাশের বিভিন্ন অফিসে। নিজেদের সচিব পরিচয় দিয়ে লোক দেখানো সাক্ষাৎকারেরও ব্যবস্থা করতেন তারা।

ডিবি জানায়, চক্রের মূল হোতা আলমগীর হোসেনের বাড়ি নোয়াখালীতে। তিনি স্থানীয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন নোয়াখালীর বিভিন্ন কলেজে। তিনি নিজেকে নোয়াখালী অঞ্চলের আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেন। এরপর শুরু হয় তার প্রতারণা। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নানান কারণে যাতায়াত ছিল তার। আর এ সুবাদে ভুক্তভোগীদের কাছে তিনি নিজেকে ‘সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব’ পরিচয় দিতেন।

তার সহযোগী রেজাউল হকও আপাদমস্তক প্রতারক। তিনি রংপুরের একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে অনার্স মাস্টার্স করেছেন। তার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। নিজের নির্দিষ্ট কোনো আয়ের উৎস না থাকলেও তিনি ঢাকার অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল বাসা নিয়ে থাকেন। নিজের নামের পাশে ড. রেজাউল হক ‘এনডিসি, পিএসসি’ লেখেন। নিজেকে পরিচয় দেন ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আইন অনুবিভাগ শাখার অতিরিক্ত সচিব।’ ‘লায়ন ক্লাবের সদস্য’ পরিচয়ে ভিজিটিং কার্ডও বানিয়েছেন।

আরেক প্রতারক হুমায়ূন কবিরের বাড়ি ফরিদপুরের রাজবাড়ীতে। তিনি নিজেকে কখনো ‘সহকারী সচিব’ আবার কখনো ‘নির্বাহী প্রকৌশলী’ পরিচয় দিতেন। হুমায়ূন কবির প্রতারণার টাকায় ফরিদপুরের রাজবাড়ীতে ২ মাসের মধ্যে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি তৈরি করেছেন। সেই সঙ্গে ইলেকট্রনিক সামগ্রীর বড় একটা শোরুম দিয়েছেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, আমরা তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হয়েছি, তারা আপাদমস্তক প্রতারক। যেসব মন্ত্রণালয়ের পরিচয় তারা দিয়েছেন, সেসব মন্ত্রণালয়ে এই পদে কোনো সচিব নেই। এছাড়া একজন প্রতারক নিজেকে লায়ন ক্লাবের মেম্বার পরিচয় দিতেন। তার এই পরিচয়টিও ভুয়া। তিনি বলেন, চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে তারা সিভি সংগ্রহ করত। সেই সঙ্গে ভুক্তভোগীদের আসল সার্টিফিকেট, মার্কশিট, ব্যাংক ড্রাফট, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও নগদ টাকা নিত তারা। 

ডিসি জানান, প্রতারকদের কাছ থেকে শত শত সিভি, কয়েক ডজন নিয়োগপত্র, কয়েকশ স্ট্যাম্প, কয়েকশ আসল সার্টিফিকেটসহ নানা ডকুমেন্ট জব্দ করা হয়েছে। তারা কৌশলে প্রশ্নপত্র বানিয়ে বিভিন্ন সময়ে তারা চাকরিপ্রার্থীদের ডেকে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে সবাইকেই পাশ করিয়ে দিত। এরপর ঢাকা শহরে বিভিন্ন অফিসে তাদের নিয়ে ৫ থেকে ১০ মিনিট বসিয়ে মৌখিক ইন্টারভিউ নেওয়া হতো। তিনি বলেন, বারকোড থাকা ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ দিয়ে তারা প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। আমরা জড়িত অন্যদেরও গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কারও সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।



বাবু/এ আর 

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


Also News   Subject:  গণপূর্ত   প্রতারকচক্র   







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত