মঙ্গলবার ১ জুলাই ২০২৫ ১৭ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ১ জুলাই ২০২৫
বাজারে এসে শুধু ঘুরি
মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে দ্রব্যমূল্য
বাজারে এখন কম দামে পাওয়া যাচ্ছে না কোনো কিছুই
জাহিদ হাসান মাহা
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৪:৪২ PM আপডেট: ২৪.০২.২০২৩ ৫:০৮ PM
গরু, মুরগি, খাসি সবকিছুর দাম আগে থেকেই বাড়তি। বাজারে এখন কম দামে কোনো মাছও পাওয়া যাচ্ছে না। সব ধরনের মাছের দাম বাড়তি। তাহলে সাধারণ ক্রেতারা কী মাছ কিনে খেতে পারবে না? বিক্রেতাকে এমন প্রশ্ন করে বসলেন রাজধানীর শেওড়াপাড়া বাজারে আসা ক্রেতা জীবন মজুমদার। জবাবে মাছ বিক্রেতা আনোয়ার বললেন, পাইকারি বাজার থেকে বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে আমাদের। তাই খুচরা বাজারেও দাম বাড়তি।

মালিবাগে বাজার করতে আসা আরেক ক্রেতা বলেন, বাজারে এসে শুধু ঘুরি, বাজারের গরিবের মাছ বলতে এখন আর কিছু নেই। সবকিছুর দামই বাড়তি। শেওড়াপাড়া বাজারে আলাপকালে আনোয়ার হোসেন নামের আরেক ক্রেতা বলেন, আগে অন্তত বাজারে গরিবের মাছ হিসেবে পরিচিত ছিল পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, চাষের কই... সেই মাছগুলোই এখন আর গরিবের মাছ নেই, সেগুলোর দামও এখন বাড়তি। কম দামে এখন আর কোনো মাছই খুঁজে পাই না বাজারে।

শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাড়তি দামেই সব ধরনের মাছ বিক্রি হচ্ছে। কোনো মাছই ক্রেতাদের নাগালে নেই। বাজার ঘুরে দেখা গেছে,  প্রতি কেজি কাতল মাছ ৩৫০-৪০০ টাকা, তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়, রুই মাছ আকার ভেদে ৩০০-৩৫০ টাকা, পাবদা মাছ ৪০০-৪৫০ টাকা, মলা মাছ আকার অনুযায়ী ৪০০-৫০০ টাকা, শোল মাছ আকার অনুযায়ী ৬০০-৮০০ টাকা, পাঙাশ মাছ ২০০ টাকা, কই মাছ ২৫০-৩০০ টাকা, টেংরা মাছ ৫০০-৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা, চিংড়ি মাছ ৬০০-৮০০ টাকা, পোয়া মাছ ৪৫০ টাকা,  ছোট বাইলা মাছ ৪০০ টাকা,  রূপচাঁদা প্রতি কেজি ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে,  ও কালিবাউস ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মাছের বাজার দর নিয়ে হাতিরপুল কাঁচাবাজারের মাছ বিক্রেতা সেলিম হোসেন বলেন, চারদিকে কিন্তু সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। সর্বশেষ মুরগির দামও অনেকে বেড়েছে। তবে মাছের বাজার আগের মতোই আছে স্থিতিশীল। তবে এই অবস্থা কত দিন থাকবে বলা যায় না। কেননা অন্যসব পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাব মাছের বাজারেও পড়বে। পশ্চিম-রাজাবাজার বাজারের মাছ বিক্রেতা সুমন মিয়া বলেন, দাম এখন আর বাড়বে না, যা বাড়ার রোজার মাসের এক সপ্তাহ আগে একসঙ্গে বাড়বে। বাজারের সব জিনিসের দামই বাড়তি। এই বাড়তি দামের প্রভাব রমজান মাসের শুরুতে মাছের বাজারে পড়বে।

এদিকে মাছের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কার বিষয়ে হাতিরপুল কাঁচাবাজারের বাজার করতে আসা ক্রেতা সিদ্দিক বলেন, বিক্রেতারা বলছেন মাছের দাম স্থিতিশীল, ধরে নিলাম তাদের কথা ঠিক। কিন্তু যে জায়গায় এসে দাম স্থিতিশীল হয়েছে, সেই দামে তো মাছ কেনার অনেকেরই সামর্থ্য নেই। আর যদি রমজান মাসে দাম বাড়ে তাহলে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের মাছ খেতে পারবে না।

রাজধানীর মালিবাগ এলাকার স্থানীয় একটি মাছের বাজারে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মাছ কিনতে এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী রবিউল ইসলাম রুবেল। মাছের দাম নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ছোট একটা চাকরি করে ঢাকায় পরিবার নিয়ে টিকে থাকা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবজি থেকে শুরু করে ডিমের দামও বাড়তি। গরু-খাসির মাংস কিনে খাওয়ার কথা তো চিন্তাও করতে পারি না। ব্রয়লার মুরগির দামও বাড়তি। তিনি বলেন, বাজারে এসে শুধু ঘুরি, তেলাপিয়া মাছ আগে কিনেছি ১৫০ টাকায় সেটার দাম এখন ২০০ এর উপরে। আবার চাষের কই কিনতাম ১৬০ টাকায় এখন সেটা ২৪০ টাকা, পাঙ্গাস কিনেছি ১২০ টাকায় এখন সেটা ২০০ টাকা। বাজারের গরিবের মাছ বলতে এখন আর কিছু নেই। সবকিছুর দামই বাড়তি।

মাছের দাম কেন এত বাড়তি— জানতে চাইলে মালিবাগের মাছ বাজারের বিক্রেতা জাহিদুর রহমান বলেন, কয়েক মাস ধরে মাছের দাম আসলেই বাড়তি যাচ্ছে। মূলত ফিডের দাম (মাছের খাবার) বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহনের খরচও আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। এসব কিছুর প্রভাব পড়েছে মাছের বাজারে। আমরা পাইকারি বাজারে আগে যেসব মাছ কম দামে কিনেছি সেগুলোর দামও এখন বাড়তি। যে কারণে মাছের বাজার কিছুটা বেশি যাচ্ছে কয়েক মাস ধরে।

বাজারে গরুর মাংস কিনতে আসা এক নারী বললেন, বড়লোকরাই মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে, সেখানে আমাদের মতো গরিবরা তো কিছুই না। শুক্রবার রাজধানীর বাড্ডা এলাকার একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে  বাজারদর নিয়ে ক্রেতাদের অসন্তুষ্টি থাকলেও বিক্রেতারা বলছেন, তারা পরিস্থিতির শিকার।  

গরুর মাংসের কিনতে আসা নাসিমা বেগম বলেন, এত দামের মাংস কি আর নিজেরা খাওয়া যায়? বাসায় মেহমান এসেছে, তাই এক কেজি নিতে এসেছি। তিনি বলেন, আগে যেখানে প্রতি সপ্তাহেই মাংস খাওয়া হতো এখন একমাসেও নিয়মিত হয় না। আগে যখনই মাংস নিয়েছি দুই কেজি করে, এখন এক কেজিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

নাসিমা আক্তার আরও বলেন, বাজারে এখন সবকিছুরই দাম বেশি। আগে মুরগির দাম একটু কম ছিল, কিন্তু এখন দেখলাম আবারও বেড়ে গেছে। মাছের দামও বাড়তি। আমাদের দেখার আসলে কেউ নেই।

মগবাজার সংলগ্ন গরুর মাংস বিক্রেতা মো. হোসেন মাংস বিক্রি করছেন ৭২০ টাকা কেজি দরে। তিনি বলেন, আমি সব সময় অন্যদের তুলনায় কিছুটা কমে বিক্রি করার চেষ্টা করি। এখন অন্যান্য জায়গায় ৭৫০ করে বিক্রি হলেও আমার এখানে ৭২০ টাকা। এর আগে দীর্ঘদিন ৭০০ টাকায় মাংস বিক্রি করেছি, তখন অন্যরা ৭২০ টাকা করে বিক্রি করেছে। এখন দামটা অনেকটা বাধ্য হয়েই বাড়িয়েছি। তিনি বলেন, দাম বেশি হওয়ায় গরুর মাংসের ক্রেতা অনেক কমে গেছে। তারপরও অন্যদের তুলনায় দাম কম হওয়ায় আমিই মনে হয় এই এলাকায় মাংস বেশি বিক্রি করি।

অপরদিকে মোটা চাল, মৌসুমের কমদামি সবজি, পাঙাশ-তেলাপিয়া মাছ কিংবা ব্রয়লার মুরগি- এসব নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ছুটির দিনে ভালো খাবার। কিন্তু বাজারে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে এগুলোর কোনো পদ-ই কিনতে গিয়ে স্বস্তি পাবেন না কেউ। বাধ্য হয়ে নিতে হবে আরও কমদামের বিকল্প কোনো নিত্যপণ্য। কারণ সপ্তাহ ব্যবধানে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম বেড়েছে দেড় থেকে দুই টাকা। শীত শেষ হওয়ায় মৌসুমি সবজিও বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। আর প্রতি কেজি ব্রয়লারের দাম ২৪০ থেকে ২৪৫ টাকা। আজ রাজধানীর কয়েকটি কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেলো এই চিত্র।

মালিবাগ রেলগেট এলাকার সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক আবুল হোসেন বলেন, আগে গরিব মানুষ যা খেতো, সেগুলোর দাম বাড়তো কম। এখন সেগুলোর দামই তরতর করে বাড়ছে। দেশে যেন নৈরাজ্য চলছে। বাজারভরা জিনিস কিন্তু দামের চোটে কোনো কিছুই কেনা যাচ্ছে না। ওই বাজারে চাল বিক্রেতা কাশেম মিয়া বলেন, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে শুধু মোটা চালের দাম দেড় থেকে দুই টাকা বেড়েছে। আগে যে পাইজাম চাল প্রতি কেজি ৫৪ টাকা বিক্রি হতো তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকা দরে। বাজারে অনেকের কাছে গুটি স্বর্ণা চাল নেই। মোটা জাতের ওই চালের সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়ছে।

শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়, টমেটো প্রতি কেজি ৪০ টাকায়, মিষ্টি কুমড়া প্রতি কেজি ৪০ টাকা, ঝিঙা প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, বরবটি প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ১৬০ টাকা, কাঁচা কলা প্রতি হালি ৪০ টাকা, পেঁপে প্রতি কেজি ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

অন্যদিকে শিম প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা আর বিচিসহ শিম ৬০ টাকা, প্রতি কেজি করোলা ১২০ টাকা, ঢেঁড়স প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, শসা প্রতি কেজি ৪০ টাকা, পটল প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, ফুলকপি প্রতি পিস ৩০ টাকা, বাঁধাকপি প্রতি পিস ৩০ টাকা,  শালগম প্রতি কেজি ৩০ টাকা, নতুন আলু (লাল) প্রতি কেজি ৪০ টাকা, নতুন আলু (ডায়মন্ড) প্রতি কেজি ৩০ টাকা, গাজর প্রতি কেজি ৪০ টাকা এবং প্রতি পিস লাউ ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে রাজধানীর মহাখালী কাঁচা বাজারে বাজার করতে আসা বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী ফরিদুল ইসলাম বলেন, শীত এলে সবজির দাম কিছুটা কম ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সেই যে দাম বাড়ল, আর কমেনি। আমাদের মতো সাধারণ ক্রেতাদের বাড়তি দামেই সবজি কিনতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দাম বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলেই বিক্রেতারা বলে সরবরাহ কম, বাড়তি দাম, পরিবহন খরচ বেড়েছে। তাদের একই রকমের অভিযোগ সব সময়। যেমন ইচ্ছে তেমনভাবে বাজারে দাম বেড়ে যায় কিন্তু বাজার মনিটরিংয়ের কোনো উদ্যোগ দেখি না।

কিছু কিছু সবজির দাম অতিরিক্ত বেশি- এ বিষয়ে  রাজধানীর শেওড়াপাড়া এলাকার সবজি বিক্রেতা রুবেল মিয়া বলেন, এখন মৌসুম না যেসব সবজির সেগুলোর দাম কিছুটা বেশি। কারণ এই সময়ে এসে ওইসব সবজির উৎপাদন বা সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়। 

বাবু/জেএম

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত