# সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় রাজধানীতে বার বার ঘটে দুর্ঘটনা
# বছরে ১৬ হাজার অগ্নিকাণ্ড, প্রাণ হারায় ২ সহস্রাধিক
# এখনও কেমিক্যালে ঠাসা পুরান ঢাকা
আগুনে মৃত্যুপুরীর খ্যাতি পেয়েছে পুরান ঢাকা। ভয়াবহ সব অগ্নিকাণ্ডে মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও যেন তারা ঘুমিয়ে। বলতে গেলে মৃত্যুপুরীতেই বসবাস করছে তারা। ঢাকার অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে পুরান ঢাকায়। এর বেশিরভাগই ঘটে ভয়ঙ্কর কেমিক্যালের কারণে। পুরো পুরান ঢাকা এলাকায় ছোট বড় সবমিলিয়ে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। পাশাপাশি অধিকাংশ মার্কেটও ঝুঁকিপূর্ণ।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানান, চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরে। এর মধ্যে অন্যতম সুপারিশ ছিল অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে আবাসিক এলাকায় যে কোনো ধরনের রাসায়নিকের দোকান বা গুদাম স্থাপন করা যাবে না। কিন্তু সুপারিশে থাকা স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলেও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়নি। এখনো সরানো যায়নি রাসায়নিকের সব দোকান-গুদাম। এছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়েও সুপারিশ দেয়া হয়েছে। বাস্তবায়ন না হওয়াতেই ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা।
তিনি আরো বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা মার্কেট ভবন এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে। আর ওইসব ভবনেই হয় বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করলে ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা থেকে আমরা রক্ষা পাই। তিনি আরও বলেন, আমাদের সবারই অগ্নিনিরাপত্তায় জরুরি ভিত্তিতে সচেতনতার প্রয়োজন।
সূত্র মতে, অতি সম্প্রতি রাজধানীর স্যায়েন্সল্যাবে বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় ৩ জনের। এর একদিন পরেই সিদ্দিকবাজারে ঘটে আরো একটি ভয়াবহ বিস্ফোরণ। যাতে মারা যায় ২৪ জন। এর রেশ কাটতে না কাটতে বঙ্গবাজারের ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এতে হতাহত না হলেও পুরো মার্কেট ভস্মিভূত হয়ে যায়। ঈদের আগে ব্যবসায়ীদের স্টক করা শত কোটি টাকার পোশাক পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ক্ষতি হয় হাজার কোটি টাকার। ভয়াবহ এ আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনা, নৌ এমনকি বিমান বাহিনীর সদস্যরাও যোগ দেয়।
পুরনো সব মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ :
গতকাল বৃহস্পতিবার ফায়ার সার্ভিস, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (জিজিএফআই) একটি সমন্বিত দল গাউছিয়া মার্কেট পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে পরিদর্শক দলের প্রধান ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স ঢাকা সদর জোন-১ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. বজলুর রশিদ বলেন, মার্কেটগুলো ফায়ার সার্ভিসের চাহিদা ফুলফিল করতে পারেনি। ঢাকার বেশিরভাগ মার্কেটই আমাদের চোখে ঝুঁকিপূর্ণ।
গাউসিয়া মার্কেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ মার্কেটের ছয়টি সিঁড়ি রয়েছে, কিন্তু সিঁড়িগুলো উন্মুক্ত নয়। দোকান বসার কারণে সবগুলোই অপ্রশস্ত হয়ে পড়েছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এসব সিঁড়ি দিয়ে পর্যাপ্ত মানুষ নামতে পারবে না। বৈদ্যুতিক তার যেখানে-সেখানে ঝুলে রয়েছে। এছাড়া মার্কেটটিতে স্বয়ংক্রিয় ফায়ার এলার্ম ব্যবস্থা স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল সেটি এখনও করা হয়নি। তিনি আরও বলেন, এ মার্কেটে ৪৩০টি দোকান রয়েছে। মার্কেটের ওপরের তলাগুলোতে আছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের অফিস ও গুদাম। মার্কেটে ফায়ার এটিংগুইশার আছে, এছাড়া যা যা থাকা দরকার তা নেই।
তিনি বলেন, ২০২০ সালে মার্কেটটিতে একটি মহড়া হয়েছিল। মহড়া শেষে বেশ কিছু সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল, যার কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভাতে কাজ করবে, সেজন্য পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থাও এখানে নেই। রিজার্ভ পানি থাকলেও সেটা পর্যাপ্ত নয়। এ মার্কেটে ফায়ার টিম আছে বলে জানিয়েছেন মালিক সমিতি, তবে তার অস্তিত্ব পাইনি।
এ সময় গাউছিয়া মার্কেট মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব মোহাম্মদ কামরুল হাসান বাবু বলেন, দু’বছর আগে ফায়ার সার্ভিস যে নির্দেশনা দিয়েছে তা পরিপূর্ণ করেছি। আমাদের ফায়ার সার্টিফিকেট আছে। এছাড়া সব ভবনেই কিছু ত্রুটি থাকে, আমাদের এখানে আউটডোরসহ যে ত্রুটি আছে তা দু-একদিনের মধ্যে সমাধানের চেষ্টা করব।
সিঁড়ির মধ্যে দোকান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব দোকান বসাতে সমিতির কোনো দায় নেই। কর্তৃপক্ষ যাদের দোকান বরাদ্দ দিয়েছে তারা জানেন এ বিষয়ে। সমিতির সভাপতি হিসাবে দোকান বরাদ্দ দেওয়ার কাজ আমার না। এরপরও ফায়ার সার্ভিস এসব দোকান সরাতে বলছে, আমরা কমিটির সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেবো।
এদিকে মার্কেটের পাশাপাশি বহুতল ভবনও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। রাজধানীর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভবনে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই। অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ, কম ঝুঁকিপূর্ণ- এ তিন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে ভবন মালিকদের অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেয়ার জোর তাগিদও দেয়া হয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে। তবে সে তাগিদ উপেক্ষা করে আসছে ভবন মালিকরা। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে ১৬ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত আট বছরে দেশে ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে দুই সহস্রাধিক মানুষ।
এদিকে ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলি ও ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। নিমতলিতে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয় ১২৪ তাজা প্রাণ, আর চুড়িহাট্টায় ৭১। দু’বারই সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুরান ঢাকা থেকে দাহ্য রাসায়নিকের ব্যবসা স্থানান্তর করা হবে। তবে এখনো দাহ্য কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মুক্ত হয়নি পুরান ঢাকা।
দিন যত গেছে সেই তৎপরতা ততই কমেছে এবং কমতে কমতে এক সময় থেমে গেছে। চকবাজার যেমন ছিল তেমনই আছে, তেমনই আছে পুরান ঢাকা। কিছুই সরেনি, কিছুই নড়েনি। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলিতে অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও এমনটাই ঘটেছিল। প্রাণের পর প্রাণ ঝরে, পুরান ঢাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল সরে না। গণমাধ্যমের সংবাদে ও মানুষের মনে দগদগে ঘায়ের মতো এসব স্মৃতি যত শুকিয়ে যায়, কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্বও যেন ততই ফুরিয়ে যায়।
ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশ :
অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য সুপারিশমালাগুলো হলো- অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে আবাসিক এলাকায় যে কোনো ধরনের রাসায়নিকের দোকান বা গুদাম স্থাপন করা যাবে না। পুরান ঢাকার সব রাস্তা ও গলিপথ বাধামুক্ত করে কমপক্ষে ২০ ফুট প্রশস্ত করতে হবে। এসব রাস্তায় স্ট্রিট হাইড্রেন্ট স্থাপন করে নির্দিষ্ট দূরত্বে পানির প্রবাহ নিশ্চিত রাখতে হবে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের সেই সুপারিশের পুরোপুরি বাস্তবায়ন ঘটেনি আজও। শিল্প ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত বছর দাখিল করা একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ড ঠেকানোর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়।
জানা যায়, প্রায় ২৫ হাজার রাসায়নিক দাহ্যপদার্থের গোডাউনের ওপরই বসবাস করছে বিশাল জনগোষ্ঠী। যদিও এসবের মধ্যে মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন ঢাকার বাইরে আলাদা কেমিক্যাল জোন গড়ে তুললে তারা ব্যবসায়িকভাবেও লাভবান হবেন।
দেখা গেছে, সারি সারি প্লাস্টিকের ড্রাম আর দাহ্য রাসায়নিক পদার্থে ঠাসা দোকান। কোনো কোনোটিতে আবার বস্তাভর্তি দাহ্য কেমিক্যাল। তার ঠিক ওপরেই এলোমেলোভাবে ঝুলছে অসংখ্য বৈদ্যুতিক তার। দোকানের উপরেই রয়েছে বাসাবাড়ি। পুরান ঢাকার আরমানিটোলা, লালবাগ, কোতোয়ালি, বংশাল, চকবাজারসহ বেশিরভাগ এলাকার কেমিক্যাল দোকানগুলোর দৃশ্য এমন। আবাসিক ভবনগুলোর নিচতলা বেশিরভাগই বিভিন্ন কারখানা ও গোডাউন। এসব গোডাউনেই মজুদ থাকে প্লাস্টিকের ড্রাম আর দাহ্য রাসায়নিক পদার্থে ভর্তি বস্তা। এসব গুদামে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইল ইত্যাদি। আগুনের সংস্পর্শে এলে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে এসব রাসায়নিক পদার্থ।
এদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানীর পুরান ঢাকায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক পণ্যের গুদাম রয়েছে। এ সবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসাবাড়িতেই। এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের জানান, করপোরেশনের উদ্যোগে ১ হাজার ৯২৪ জন ব্যবসায়ীর তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এ তালিকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। পরে স্থানান্তরের বিষয়ে তারা পদক্ষেপ নেবে।
আবু নাছের জানান, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩, ৪ ও ৫ নম্বর অঞ্চলে এসব কেমিক্যাল গোডাউনগুলোর অবস্থান। এর মধ্যে এগারোশর অধিক কারখানার অবস্থান অঞ্চল ৩-এ।
বাপার নির্বাহী সহ-সভাপতি আব্দুল মতিন বলেন, পূরাণ ঢাকার কেমিক্যাল সরাতে বাপা একাধিকবার কথা বলেছে। কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও এখন আর কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
তিনি বলেন, আমাদের অনুসন্ধানে প্রায় ২৫ হাজার অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এগুলো না সরালে কিছুতেই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমবে না। আমরা বারবার সরকারকে এ বিষয়ে তাগিদ দিয়ে আসছি।
-বাবু/এ.এস