তিন পার্বত্য এলাকায় সশস্ত্র ৫ সন্ত্রাসী গ্রুপে আবারো আশান্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিদিন একেক গ্রুপের সঙ্গে অপরগ্রুপের গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। গতকাল শুক্রবারও সশস্ত্রগ্রুপগুলোর মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে ৮ জন। এরা কেএনএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসী বলে জানা গেছে। শান্তিচুক্তির ২৪ বছরে পাল্টে যাওয়া এ অঞ্চলে দল উপ দলে বিভক্ত ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে খুন হয়েছে আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ। ৩০ লাখ অধিবাসী অধ্যুষিত এ অঞ্চলে পাহাড়ী বাঙ্গালী সবাই এ সশস্ত্রগ্রুপগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার মো. তারিকুল ইসলাম জানান, শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমরা খবর পাই রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতামপাড়ায় কিছু মরদেহ পড়ে আছে। খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহগুলো উদ্ধার করে বান্দরবান সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করি। যতটুকু জেনেছি দুটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলিতে এ ঘটনা ঘটেছে।
তিনি বলেন, পাহাড়ী সশস্ত্রগ্রুপগুলোর বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক। যে সকল গ্রুপ দেশবিরোধী সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত তাদের বিষয়ে আমাদের পদক্ষেপ রয়েছে।
পাঁচ সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন :
স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, তিন পার্বত্য এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সশস্ত্র পাঁচ সন্ত্রাসী সংগঠন। এরা হলো জেএসএস, জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ, গণতান্ত্রিক এবং সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে এমএনপি (মগ গণতান্ত্রিক পার্টি) পরবর্তীতে মগ কেএনএফ রূপে আবির্ভুত হয়েছে। বর্তমানে পাহাড়ে ভয়ঙ্কর সশস্ত্র গোষ্টির নাম কেএনএফ। সম্প্রতি জঙ্গি গোষ্টিকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এটি আরো আলোচনায় এসেছে। দুর্ধর্ষ জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যদের টাকার বিনিময়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তারা। ইতিমধ্যে র্যাবের অভিযানে ধরাও পড়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত বছরের ২০ অক্টোবর থেকে পাহাড়ে হিন্দাল শারক্বীয়ার জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। সর্বশেষ বান্দরবান থেকে ৯ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে জঙ্গি সংগঠনকে মদদ দেওয়া এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য কেএনএফের মোট ১৭ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মূলত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কথিত হিজরতের কথা বলে ঘরছাড়া ৫৫ তরুণের বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে এই হিন্দাল শারক্বীয়ার সব নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানতে পারে র্যাব। ইতিমধ্যেই পলাতক ওই ৫৫ জনের ৩৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং দুজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তবে পাহাড়ি এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে হিন্দাল শারক্বীয়ার মোট ৬৮ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। এর বাইরেও দুজনকে উদ্ধার করে পরিবারে হস্তান্তর করা হয়।
পাহাড়ে ভয়ঙ্কর কেএনএফ :
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কুকি সন্ত্রাসীরা দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। তাদের কম্ব্যাট (সামরিক) পোশাকে অস্ত্র মহড়া, প্রশিক্ষণ ও গুলি চালানোর ভিডিও নিজেরাই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করছে। অনলাইনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুকিদের কিছু আইডি বা পেইজে অনবরত তৎপরতার জানান দিচ্ছে। এমনকি একটি ভিডিওতে কেএনএফের প্রধান নাথান বমসহ তাদের শীর্ষ নেতাদের গায়েও সামরিক আদলে পোশাক দেখা গেছে। কেএনএফ ছাড়াও তাদের আস্তানায় একই আদলে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের প্রশিক্ষণ মহড়ার ভিডিও প্রকাশ হয়েছে। যা জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া এলিটফোর্স র্যাব প্রকাশ করেছে।
গত ১২ মার্চ দুপুরে বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে টহলরত সেনাবাহিনীর এক সদস্যকে (মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন) হত্যা এবং দুজনকে আহত করেছে কুকি সন্ত্রাসীরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ত্রিদেশীয় (বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার) দুর্গম সীমান্ত ব্যবহারের সুযোগ এবং ভারী অস্ত্র-সরঞ্জাম হাতে পেয়ে তারা নিজেদের এখন বেপরোয়া হিসেবেও জানান দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান সময়ের দুর্ধর্ষ জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যদের টাকার বিনিময়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও পাহাড়ি আস্তানায় আশ্রয় দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরির নীলনকশা আঁকে কেএনএফ তথা কুকি সন্ত্রাসীরা। এরপর গত বছরের অক্টোবর থেকে হিন্দাল শারক্বীয়া ও কুকি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান শুরু হয়। এ পর্যন্ত কেএনএফের ১৭ জন এবং হিন্দাল শারক্বীয়ার অন্তত ৬৮ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর অভিযানের কারণে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং পাল্টা প্রতিশোধের অংশ হিসেবে পাহাড়ের গহিনে কেএনএ এবং হিন্দাল শারক্বীয়ার জঙ্গিরা একজোট হয়ে কাজ করছে বলেও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়।
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশীদ বলেন, কেএনএফ যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠছে তাতে নিঃসন্দেহে এদের ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। কেননা, কুকিদের এ ধরনের হামলা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ পরিস্থিতিকেও আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। যেহেতু বান্দরবানকেন্দ্রিক কেএনএফের তৎপরতা বেশি এবং সেখানে কিছু সুবিধাও পাচ্ছে তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো থেকে। পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্ত থেকেও সহযোগী সংগঠনগুলো কুকিদের সহযোগিতা দিচ্ছে। তারা মূলত ভৌগোলিক সীমান্তের সুযোগটি ব্যবহার করছে।
কুকিদের হামলার প্রসঙ্গে জেনারেল রশীদ আরও বলেন, র্যাব কেএনএফের আস্তানা থেকে বেশ কিছু জঙ্গিকে ও কেএনএফ সদস্যকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করেছে। সাধারণত কোনো একটি সফল অপারেশন হলে তার একটা প্রত্যাঘাত আসে, এটা সব দেশেই হয়। সেদিক থেকে কেএনএফ চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে পারে। মূলত, ভূখণ্ডের অখণ্ডতায় কেএনএফসহ পাহাড়ের সব বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ‘টার্গেটেড অপারেশন’ চালাতে হবে। বাংলাদেশের মাটি থেকে এদের উচ্ছেদ করতে হবে।
এদিকে বান্দরবানে স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে জানা যায়, পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ সেখানকার মানুষ। তারমাঝে নতুন করে কেএনএফ দেশের পার্বত্য অঞ্চলকে আরও বেশি অশান্ত ও ভয়ংকর করে তুলেছে। এ সন্ত্রাসী সংগঠনের অত্যাচার-নির্যাতনে এলাকা ছেড়েছে বহু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবার। এমনকি পাহাড়ের যেখানেই উন্নয়নকাজ হচ্ছে সেখানেই বাধা সৃষ্টি করছে কুকি সন্ত্রাসীরা।
জানা যায়, কেএনএফ মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানকেন্দ্রিক আঞ্চলিক সংগঠন। পার্বত্য ৩ জেলার প্রায় অর্ধেক আয়তনের অঞ্চল তথা লামা, রুমা, আলীকদম, থানচি, রোয়াংছড়ি, বিলাইছড়ি, জুরাইছড়ি, বরকলসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে একটি মনগড়া মানচিত্র তৈরি করেছে। যে মানচিত্রের ৩ দিকে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত। এই মানচিত্রকে প্রস্তাবিত হিসেবে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সীমানা, জেলা ও উপজেলা সীমানা নির্ধারণ করেছে তারা। পাহাড়ের বম, পাঙ্খুয়া, খুমি, ম্রো এবং খিয়াং নামক ক্ষুদ্র ৬টি জাতি- গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠন হয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। সংগঠনের লোগোতে প্রতিষ্ঠাকাল ২০০৮ সাল বলে উল্লেখ থাকলেও মূলত ২০১৮ সালের পর থেকে সশস্ত্র কাঠামোয় মাথা চাড়া দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
জানা গেছে, দেশের পার্বত্য অঞ্চলে এসএমজি (সাব-মেশিনগান), একে-৪৭ কিংবা একে-২২ রাইফেলের মতো এমন ধরনের বিপুলসংখ্যক অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করছে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। পাহাড়ের নিরীহ বাঙালি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করতে এবং ভূমিদখলসহ পার্বত্য অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের রাখতে এসব অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার ও মজুদ করছে পার্বত্য অঞ্চলের পাঁচটি আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন। এরা গহিন অরণ্যে গড়ে তুলেছে ঘাঁটি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ করা গোয়েন্দাদের ধারণা মতে, পার্বত্য অঞ্চলের আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের হাতে বছরে অন্তত হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়ে থাকে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলভিত্তিক পাঁচটি উপজাতীয় সংগঠনের হাতে বর্তমানে প্রায় ৪ হাজারের মতো আগ্নেয়াস্ত্র মজুদ রয়েছে। ধীরে ধীরে এসব সংগঠনে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। চাঁদাবাজি ও আধিপত্য নিয়ে কোন্দলে মাঝেমধ্যেই গর্জে ওঠে ভয়ঙ্কর ওইসব অস্ত্র। অস্ত্রের গর্জন ছড়িয়ে শান্তির পাহাড়কে করছে তারা অশান্ত। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রাণ যাচ্ছে ওইসব সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সাধারণ পাহাড়িদেরও।
-বাবু/এ.এস