রবিবার ১৩ জুলাই ২০২৫ ২৯ আষাঢ় ১৪৩২
রবিবার ১৩ জুলাই ২০২৫
সক্রিয় বিদেশি অপরাধীরা
অভিজাত এলাকায় শক্তিশালী সিন্ডিকেট
ইমরান আলী
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৬ মে, ২০২৩, ১১:২৭ AM আপডেট: ১৬.০৫.২০২৩ ১২:০৯ PM

উপহার পাঠানোর নামে প্রতারণা, হেরোইন, কোকেন ও অপ্রচলিত মাদকের কারবার, ব্যাংকের এটিএম বুথে জালিয়াতি, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, জাল ডলারের কারবার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, সোনা চোরাচালান, অনলাইনে ক্যাসিনো এবং মানবপাচারে জড়িত 

রাজধানীর অভিজাত এলাকাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিদেশী নাগরিকদের অপরাধ সিন্ডিকেট। মাদক, জাল ডলার, প্রতারণা থেকে শুরু করে সবরকমের অপরাধের সঙ্গে এই সিন্ডিকেটটি জড়িয়ে পড়েছে। মূলত গার্মেন্টস ব্যবসার নাম করে দেশে আসা এসব বিদেশী নাগরিকরা অপরাধ সংঘটিত করছে। চলতি বছরের শুরু থেকে র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ মাদক, জাল ভিসা, প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধে শতাধিক বিদেশি নাগরিককে আটক করেছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, ১৫ টি দেশের নাগরিকরা বিভিন্ন অপরাধে সম্পৃক্ত হচ্ছে। আটকের বাইরে থাকা এসব দেশের নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ সংখ্যা প্রায় ৫ হাজারের মতো।

সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত গুলশান, বারিধারা ও উত্তরা এলাকা এখন বিদেশি নাগরিকদের অপরাধের নিরাপদ ঘাঁটি। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করে বিদেশি অপরাধীরা নানা অপরাধ করছে। আর তাদের আশ্রয়দাতা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস ও একশ্রেণির বাঙালি কর্মকর্তা। কূটনৈতিক জোন বলে খ্যাত রাজধানীর গুলশান ও বারিধারার বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও অলিশান হোটেলে অবস্থান নেয়া এসব বিদেশি অপরাধীরা তাদের অপকর্ম করছে। আর মোটা অর্থ কামানোর জন্য তারা জাল মুদ্রা তৈরি, মানবপাচার, মুদ্রাপাচার, হেরোইন ও মাদকের ব্যবসা করে আসছে। 
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা রাজধানীর গুলশান, বারিধারা ও উত্তরা এলাকাকে ঘিরে বিশ্বের ১৫টি দেশের ৫ হাজার অপরাধী চক্র সক্রিয় রয়েছে বলে জানিয়েছে। দেশগুলো হলো, নাইজেরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, লিবিয়া, ইরাক, ভারত, ক্যামেরুন, পাকিস্থান, ফিলিপাইন, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, সুদান, তাঞ্জানিয়া, উগান্ডা ও শ্রীলংকা। এ সব দেশের নাগরিকদের মধ্যে অনেকেই অবৈধভাবে বসবাস করছেন।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রেজাউল হায়দার বলেন, বিদেশিরা এদেশে বৈধভাবে এলেও ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই মূলত তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। শুধু বাংলাদেশ নয়, এসব আফ্রিকান ভারত, সিঙ্গাপুর ও দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে মার্চেন্ডাইজিংসহ বিভিন্ন ব্যবসা করতে এসে অপরাধ করছে। তাদের অপরাধের ধরন এমন যে, কেউ ভিকটিম হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের প্রতারণার বিষয়টি টেরও পায় না।

তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একার পক্ষে তাদের অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। যেসব বাড়ির মালিক বা দেশিয় নাগরিক তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন তাদের সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশে স্বল্পমেয়াদি ভিসায় আসা আফ্রিকানদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। অপরাধচক্রের প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদেরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি) রিফাত বিন শামিম বলেন, বিদেশী অপরাধীরা অপরাধ সংঘটনের জন্য সব সময় নিরাপদ এলাকা বেছে নেয়। আর তাই নিরাপদ ভেবেই এরা গুলশান, বারিধারা ও উত্তরা এলাকায় বেশি অবস্থান করে থাকে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখ ফাঁকি দিতে তারা একাধিকবার বাসাবাড়িও বদল করে। এটা অপরাধীদের এক ধরনের কৌশল বলে মন্তব্য করেন গোয়েন্দা বিভাগের এই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, এ পর্যন্ত আমরা প্রায় শতাধিক এই ধরনের বিদেশি নাগরিকদের আটক করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। ধারাবাহিক এ ধরনের ঘটনায় নজরদারিও বৃদ্ধি করেছি।

তিনি আরও বলেন, পোশাক শিল্প, বায়িং হাউস, আইটি ও টেলিকম সেক্টর, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, রেস্টুরেন্ট, প্রিন্টিং প্রেস এবং এনজিওসহ নানা ধরনের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ভিনদেশীদের একটি সংঘবদ্ধচক্র নানা অপরাধে জড়িত হচ্ছে। নামে-বেনামে বিদেশিরা শত শত বায়িং হাউসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলেও তারা মূলত অবৈধ ব্যবসা করে থাকে।

গোয়েন্দা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, সম্প্রতি নাইজেরিয়ান তিন নাগরিক ওকোপ্সি সিমকো(২৮), ওকোফার সিকি(২৬) ও অ্যাডলাস স্যামুয়েলকে আটক করা হয়। এর কিছুদিন পর উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের ৩ নং রোডের ৩৭ নম্বর বাড়ি থেকে বিদেশি বিয়ার ও মদসহ মধ্য আফিকার দেশ গিনি ও আফ্রিকার নাগরিক কামারা কাডে (৩৮), কোনজি লোভেনিয়া (৪০) এবং রবার্টো মিলি মনোনো (৩২) কে আটক করা হয়। কোকেনসহ গিনির নাগরিক কোনজি লোভেনিয়া (৪০) আটক করে বনানী থানা পুলিশ। এছাড়া প্রায় কোটি টাকার হেরোইনসহ বিমানবন্দরে ধরা পড়ে অন্য তিন বিদেশি নাগরিক।

র‌্যাব-১০ রাজধানীর অদূরে কেরাণীগঞ্জে জাল ডলারসহ কঙ্গোর দুই নাগরিক কামাঙ্গাবো নিবা জোসেফ এবং ফাইলেফলবো মিন্ডোলিয়াকে নামের দু’জনকে আটক করে। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গুলশানের একটি বাসা থেকে ৬০ লাখ টাকা মূল্যের বিভিন্ন দেশের জাল ডলার উদ্ধার করা হয়। সাভারে জেকে নিট কম্পোজিট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম খান থানায় পেরুর নাগরিক মিসেস ব্রিট জে লুলুডাভিগসেন ছাকাতা ও ভারতীয় নাগরিক সম্পদ কুমারের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করলে দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করলে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। এভাবে বিভিন্ন অপরাধে প্রতিনিয়ত বিদেশি ওইসব দেশের নাগরিকরা আটক হচ্ছে।

সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে ফেসবুকে উপহার পাঠানোর নামে প্রতারণা, হেরোইন, কোকেন ও অপ্রচলিত মাদকের কারবার, ব্যাংকের এটিএম বুথে জালিয়াতি, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, জাল ডলারের কারবার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, সোনা চোরাচালান, অনলাইনে ক্যাসিনো এবং মানবপাঁচারে জড়িত থাকার অপরাধে নানা সময়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

বিদেশি চক্র ঢাকায় বসে ফেসবুক ব্যবহার করে এজেন্টের মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। প্রথমে তারা ফেসবুকে আইডি খুলে বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। ই-মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারেও তারা বন্ধুত্ব গড়েন। একপর্যায়ে মোটা অঙ্কের টাকার লোভ দেখান। ইন্টারনেট ও মোবাইলে লোভনীয় লটারি পাওয়ার মেসেজ পাঠিয়ে মূল্যবান গিফট পাঠানোর কথা বলে পার্সেল ফি আদায় করে প্রতারণা চালান।

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, আফ্রিকার কয়েকটি দেশের নাগরিকরা মাদক পাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এর পাশাপাশি অন্যান্য অপরাধও তারা করছে। তিনি বলেন, দিনের বেশিরভাগ সময় অভিজাত হোটেল রেডিসন, ওয়েষ্টিন, রিজেন্সি, ওয়াশিংটনে সময় পার করে থাকে। এরা বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মতো লাভজনক ব্যবসাকে পুঁজি করে অপরাধ করে। তারা নিজেরা বাইরে পরিচয় দেয় পোশাক কারখানারগুলোর সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আসলে এটা তাদের এক ধরনের প্রতারণা।

আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের ফরেন ডেস্ক শাখার এক কর্মকর্তা জানান, কয়েকটি দেশের নাগরিক বাংলাদেশে এসে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এদের কেউ-কেউ গ্রেফতারও হচ্ছেন। অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নবায়ন না করে অবৈধভাবেই তারা বাংলাদেশে বসবাস করছেন। পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ এবং বর্তমান অবস্থান জানতে না পারায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, আবার অনেকে রয়েছে টুরিস্ট ভিসায় বেড়াতে এসে বছরের পর বছর এ দেশে কাটিয়ে দিচ্ছেন। আবার এক বছরের ওয়ার্ক ভিসায় এসে বছরের পর অধিক সময় থাকছেন। যার কারণে এরা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, এদের কে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত