বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি দূরভিসন্ধিমূলক। স্বাধীন সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ বলে মনে করে ১৪ দলীয় জোট।
জোটের নেতারা বলেন, বিএনপি-জামায়াতের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এটা দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট মনে করে, এ ভিসানীতি অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।
আজ রোববার সকালে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমুর ইস্কাটনের বাসায় ১৪ দলের বৈঠকে নেতারা এসব কথা বলেন।
বৈঠকে উপস্থিত ১৪ দলের একাধিক নেতা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বিষয়টি নিশ্চত করেছেন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ১৪ দলের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বৈঠকে গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার শাহাদাত হোসেন বলেছেন, নির্বাচনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণা তাদের একটি এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ হয়েছে। এটা তাদের দূরভিসন্ধিমূলক সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপের অংশ। এটা তারা করতে পারে না।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীসহ ১৪ দলের অনেকেই কথা বলেন।
বৈঠকে সরকারের ঘোষিত প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে কথা হয়। অনেকেই খাতা কলম ও কাগজের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার বিরোধিতা করে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার আহ্বান জানান।
জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিতে আহ্বান জানানো হয় বৈঠক থেকে।
কিছু কিছু মন্ত্রীর অতিকথন নিয়েও কঠোর সমালোচনা করেন ১৪ দলের শরিক দলের নেতারা।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৪ দলীয় জোট নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্রুত বৈঠক আহ্বানের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘অনেকেই আমাদের প্রশ্ন করেন, কিন্তু আমরা কোনো উত্তর দিতে পারি না। সভা-সমাবেশের মতো কর্মসূচি থেকে শুরু করে নির্বাচনী কার্যক্রম কোথাও তো ১৪ দলের তৎপরতা নেই। এসব বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দ্রুত বৈঠকে বসা দরকার।’
নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীও একই বিষয়ে কথা বলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ৬ জুন রাজধানীতে ১৪ দলের জনসভা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠক থেকে।
বিষয়টি নিয়ে দলীয় সভাপতির সঙ্গে কথা বলবেন বলে শরিক দলের নেতাদের জানান ১৪ দলের মুখপাত্র আমির হোসেন আমু।
বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করেন ১৪ দলের মুখপাত্র আমির হোসেন আমু। তিনি বলেন, ’জোটের বৈঠকে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর বিশদ আলোচনা হয়েছে।’
সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান জোট সমন্বয়ক।
আমির হোসেন আমু বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনাহূতভাবে আসায় তা অত্যন্ত দূরভিসন্ধিমূলক মনে হচ্ছে। এটা কারও কারও পক্ষে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা মনে করি, জাতি সংবিধানের প্রত্যেকটি প্রক্রিয়াকে সমুন্নত রাখার জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকবে। আমরা একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। এক্ষেত্রে অন্য কোনো হস্তক্ষেপ আমরা কামনা করি না।’
আপনারা ভিসানীতির সমালোচনা করছেন কিন্তু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দাবি করেছেন তাদের টার্গেট করে এটা করা হয়নি—এমন এক প্রশ্নে আমু বলেন, ‘আমরা ভিসানীতিকে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করি। আরেকটা কথা হলো, এটা তো ১৪ দল। আওয়ামী লীগের মিটিং না। মনে রাখবেন। আমরা তো রাবার স্ট্যাম্প না। এখানে আরও ১৩টা দল আছে, সবাই তো আওয়ামী লীগ না, এটা আপনাকে মনে রাখতে হবে। এখানে কথা হচ্ছে ১৪ দল যেটা ফিল করে সেটাই বলবে। অন্য দল কে কী বলবে, সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। আমাদের আলোচনায় যেটা আসবে সেটা আমরা প্রকাশ করব।’
আমির হোসেন আমু বলেন, ‘আমরা মনে করি, যারা নির্বাচনকে বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে বানচাল করতে চায়, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, তাদের জন্য এটা (ভিসানীতি) সহায়ক হতে পারে। সেই দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা কথাগুলো বলতে চাই। এখানে যদি অন্য কোনো দেশের সন্দেহ থাকে, তাহলে তারা বসে এটা ঠিক করতে পারে যে সংবিধানের ভেতরে কোথায় কোন ফাঁক-ফোকর আছে, সেটা তারা বিবেচনা করুক। সেগুলো দেখুক, আলোচনা করুক। কিন্তু সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচনটা অনুষ্ঠিত হতে হবে। দেশে এ ধারাটা অব্যাহত রাখার জন্য। সংবিধানে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে অন্য কোনো উপায়ে আঘাত আসুক, এটা আমরা চাই না।’
সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের জন্য ১৪ দলীয় জোট কোনো আলোচনার উদ্যোগ নেবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে জোটের মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা মনে করি এ জাতি সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কোনো দলই জাতির বাইরে না, জনগণের বাইরে না, দেশের বাইরে না। জনগণের ওপর আস্থা থাকে, সংবিধানভিত্তিক নির্বাচনে আস্থা থাকে এমন সবারই অংশগ্রহণ করা উচিত। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সব দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানাই। কোনো দলের পক্ষে জনস্রোত থাকলে, এই স্রোতের বাইরে প্রশাসনও যেতে পারে না। সেই দিকেই নির্বাচন ধাবিত হয়।’
বৈঠকে দ্রব্যমূল্য বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ১৪ দল। জোটের পক্ষ থেকে দ্রুত বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে বলে জানান আমির হোসেন আমু।
বাজেট নিয়ে সংসদে বিস্তারিত আলোচনা হবে বলে জানিয়ে আমির হোসেন আমু বলেন, ‘আমরা যেহেতু পড়াশোনার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি, প্রধানমন্ত্রী নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা পয়সায় বই বিতরণ করছেন। সবকিছু ঠিক আছে। সেক্ষেত্রে কলম ও কাগজের দাম বৃদ্ধি পড়াশোনার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। সংবাদপত্রের ওপর ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। তাই আমরা মনে করি কাগজ-কলমের দাম কমানো উচিত। আরোপিত কর প্রত্যাহার করা উচিত।’
বিদ্যুৎ সমস্যা দ্রুত স্বাভাবিক পর্যায়ে আনার জন্য ১৪ দলীয় জোট সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
জোটের সমন্বয়ক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সব রকম চেষ্টা করছেন। আমাদের দেখতে হবে সরকার সচেতন কি না, প্রচেষ্টা আছে কি না। কিন্তু পরিস্থিতি হাতের বাইরে থাকলে কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।’
তিনি জানান, ‘আগামী ৬ জুন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ১৪ দল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে বিকালে একটি জনসভা করবে।’
জোট সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমুর সভাপতিত্বে বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, জাতীয় পার্টি (একাংশ)-জেপির সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মৃনাল কান্তি দাস, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের আহ্বায়ক ওয়াজেদুল ইসলাম খান, গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন, গন আজাদী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট এসকে সিকদার, বাসদের আহ্বায়ক রেজাউর রশিদ খান, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টির সভাপতি জাকির হোসেন, ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী ফারুক, জাতীয় পার্টি জেপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এনামুল হক রুবেল, জাসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাদের চৌধুরীসহ ১৪ দলের কেন্দ্রীয় নেতারা।