মহাবিপদসংকেত কমলেও রেমালের তাণ্ডবে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে উপকূলীয় জেলাগুলো। উপকূলের বেশ কয়েকটি এলাকার গাছপালা, ঘরবাড়ি তছনছ হয়েছে গেছে। তলিয়ে গেছে মাছের ঘের, কৃষি খামারসহ বিস্তীর্ণ মাঠ।
ঘূর্ণিঝড় রেমাল গতকাল রোববার রাত ৮টার দিকে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত করে। এরপর উপকূল থেকে শুরু করে সারা দেশে বৃষ্টি শুরু হয়। এখনও তাণ্ডব অব্যাহত রয়েছে। বাতাসের গতিবেগ রয়েছে ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার।
সোমবার সকালে পায়রা ও মংলা সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়েছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করে বর্তমানে কয়রা, খুলনার নিকট অবস্থান করছে। এটি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে ক্রমশঃ বৃষ্টিপাত বাড়িয়ে পরবর্তী ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে কিছুটা দূর্বল হয়ে ঘুর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়ে পড়ে।
বাগেরহাট: ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বাগেরহাটের উপকূলজুড়ে প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে বইছে বাতাস। ফলে জেলার বিভিন্ন এলাকার গাছপালা উপড়ে পড়ে গেছে। এতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারে রয়েছে পুরো জেলা। এছাড়াও জোয়ারে নদী ও খালগুলোর পানি দুই থেকে তিন ফুট বেশি পানি বেড়েছে। বেড়িবাঁধ ও সড়ক উপচে পানি ঢুকেছে লোকালয়ে।
পটুয়াখালী: ঘূর্ণিঝড় রিমাল গতকাল রোববার রাত ৯টা থেকে উপকূলে আঘাত হেনেছে। এর প্রভাবে শুরু হওয়া তাণ্ডব এখনও অব্যাহত রয়েছে। মহাবিপৎসংকেত কমে গেলেও দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে জেলার কলাপাড়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকার গাছপালা, ঘরবাড়ি। তলিয়ে গেছে মাছের ঘের। এখনও বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার রয়েছে। এর প্রভাবে উপকূলের বিভিন্ন জেলায় জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। সেই সঙ্গে বয়ে যাচ্ছে ঝড়ো হাওয়া।
বরগুনা: ঘূর্ণিঝড় রিমাল গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে উপকূলে আঘাত হানে। এর প্রভাবে বরগুনার প্রধান তিন নদ-নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পাঁচ থেকে সাত ফুট উচ্চতার জোয়ার প্রবাহিত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে জেলা শহরসহ সেখানকার উপকূলের অনেক গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সদর উপজেলা এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের পালের বালিয়াতলী ও বদরখালী ইউনিয়নের বাওয়ালকর এলাকায় বাঁধ ভেঙে ১০-১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়াও দীর্ঘ সময় ধরে ঝোড়ো বাতাস বয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানের গাছপালা উপড়ে পড়ে।
ভোলা: রিমালের প্রভাবে গতকাল ঝড়, বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে জেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন উপকূলীয় এলাকার লক্ষাধিক মানুষ। এর প্রভাবে আজ সোমবারও ঝড়বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইছে। এখনো বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইছে।
এছাড়াও জেলার মনপুরা, লালমোহন, তজুমদ্দিন ও চরফ্যাশন উপজেলায় মোট ১০টি স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যশোর: রিমালের কারণে গতকাল রাত ১০টার পর থেকে যশোর শহরে ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করে। রাত ১২টার দিকে বাতাসের গতিবেগ বাড়লে গোটা শহরের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বিদ্যুতের দেখা মেলেনি। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্থানে ঘর-বাড়ি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
চট্টগ্রাম: রিমালের প্রভাবে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে চট্টগ্রামে। এতে নগরীর বিভিন্ন এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। গতকাল রোববার দুপুর থেকে থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়। আজ সোমবার ভোর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এখনো তা অব্যাহত আছে।
ঢাকা: প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আজ সারা দেশে বৃষ্টি হচ্ছে। এরই মধ্যে রাজধানীতে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
ফেনী: গতকাল রোববার মধ্যরাত থেকে ফেনীতে ঝোড়ো হাওয়া ও ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এর প্রভাবে গাছপালা পড়ে বিদ্যুতের তার ও খুঁটি ভেঙে পুরো সোনাগাজী উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
খুলনা: ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় এখনো দমকা হাওয়া ও ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। জলোচ্ছ্বাসে রাতেই উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের অন্তত ২০টি স্থানে নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে সাগরের নোনাপানিতে প্লাবিত হয়েছে অর্ধশতাধিক গ্রাম। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন উপজেলার প্রায় এক লাখ মানুষ। খাবার পানির উৎসগুলো তলিয়ে গেছে। ফসলের খেত ও মাছের ঘের পানিতে ভেসে গেছে। ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে পুরো উপজেলা বিদ্যুৎহীন রয়েছে।
সাতক্ষীরা: প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাব গতকাল রোববার রাত ৮টার দিক থেকে শুরু হয়। এর ফলে জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধের কয়েকটি স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। দমকা বাতাসের সঙ্গে প্রবল বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন এলাকায় কিছু কাঁচা ঘর ভেঙে গেছে, উপড়ে পড়েছে গাছপালা। এ ছাড়া কিছু চিংড়ি ঘেরও ভেসে গেছে। শ্যামনগরে বাড়ি থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে পড়ে গিয়ে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে।