কবিতা এমন এক শিল্প যা আমাদের ভাবনার দরজা খুলে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়, ভিতরের মনোজগতে ভালোলাগার আলোড়ন সৃষ্টি করে। আলোর প্রতিসরণে যেমন আলো ঘন মাধ্যমে প্রবেশের সময় কিছুটা বেঁকে যায়, কবিতার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দ-বাক্যগুলো ঠিক তেমনি কিছুটা বেঁকে গিয়ে আমাদের ভাবনার সাগরে সাঁতার কাটতে বাধ্য করে। কবিতার লিখিত কোনো সংজ্ঞা না থাকলেও অলিখিত সংজ্ঞা আছে যা নান্দনিকতা প্রকাশ করে যা ছন্দ, উপমা, রূপক, চিত্রকল্পে...অলঙ্কৃত।
বঙ্গ রাখাল দ্বিতীয় দশকের একজন সম্ভাবনাময় তরুণ কবি ও প্রাবন্ধিক যার ছাপ তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলো পড়ে আমরা বুঝতে পারি। সম্প্রতি আমি তার কাব্যগ্রন্থ ‘যৈবতী কন্যা ইশকুলে’ পাঠ করলাম। কাব্যগ্রন্থটিতে মোট ৫৭টি কবিতা আছে। প্রায় প্রতিটি কবিতায় তিনি ছোট ছোট গল্পগুলোয় পরিমিত উপমা, রূপক, চিত্রকল্পের মিথস্ক্রিয়ার নান্দনিকভাবে তার যাপিত জীবনের বেদনা, ভালোবাসা, নারী, প্রকৃতি, সমাজ সচেতনা, আন্দোলন এবং স্বদেশকে ফুটিয়ে তুলেছেন যা একজন পাঠককে তার কবিতার ভিতরে ঢুকতে বাধ্য করে, কাব্যসুধা পান করতে করতে ভাবনার বিস্তৃতি রাজ্যে প্রবেশ করায়। তার কবিতায় গল্প বলার ধরন কিছুটা আলাদা। তার কবিতায় ব্যবহৃত উপমা, রূপক, চিত্রকল্প কিছুটা অন্যরকম, যা কবি বঙ্গ রাখালের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করে। তিনি স্বদেশ কবিতায় বলেছেন ‘জনকের তর্জনী আঙ্গুল আমাদের লড়াই সংগ্রাম, তার বিমর্ষ মুখ আমাদের বিধ্বস্ত স্বদেশ।’ শোষণের ছায়ায় লিখেছেন ‘নম্রতার জালে আবদ্ধ শোষণের ক্ষুধার্ত উন্মাদনা।’ অন্ধকার এক নির্মমতার নাম, কবিতায় বলেছেন ‘উদ্ভট স্বদেশ-প্রতীক্ষায় ভোর,আমি এক দাঁতাল শকুন।’
সময়ের পরিক্রমায় কবিতার ভাষা, উপমা, রূপক, চিত্রকল্প একজন কবির যাপিত জীবনের সংস্কৃতি অনুযায়ী পরিবর্তন হয়। মূলত একজন কবি তার কবিতায় তার সময়কে ফুটিয়ে তুলেন। যে কবি যত দ্রুত তার কবিতায় চিরায়ত প্রথা ভেঙে তার সময়কে কাব্যে ধারণ করেন, তিনি ততো দ্রুত তার কাব্যকে আলোকিত করেন। কবি বঙ্গ রাখালের কবিতা পড়ে মনে হল তিনি তার সময়কে বার বার বুঝার চেষ্টা করছেন এবং তার কবিতায় তার যথাযথ প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন।
কবিতা এক প্রবাহমান নদীর মতো, সময়ে সময়ে যার বাঁক বদল হয়। যে কারণে কবিতা নিদিষ্ট অবয়বে সোজা পথে হাঁটে না, এঁকেবেঁকে যার দুরন্ত ছুটে চলা। মাঝে মাঝে কিছু কবি জন্ম নেয়, যারা তার সময়ের মূলস্রোতে প্রবাহিত না হয়ে একটি নতুন শাখানদী সৃষ্টি করে প্রবাহিত হয়। কখনো কখনো সেটি মূলস্রোতের রূপ নিয়ে এগিয়ে যায়। যাদেরকে আমরা বাঁক বদলের কবি বলি, যা নিজের স্বাতন্ত্র্যকে ফুটে তুলে। কবি বঙ্গ রাখাল এমনি একজন প্রতিভাবান তরুণ কবি যার চলার গতি বাঁক বদলের স্রোতের মতো; অবশ্য এজন্য তাকে আরো বেশি পরিশ্রম ও সাধনা করতে হবে।
-বাবু/এ.এস