প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে মানবজাতি স্বয়ংক্রিয় রোবোটিক ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে যার প্রভাব দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে অনুভব করা যায়। এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার শুরু হয় চার্লস ব্যাবেজেরর কম্পিউটার আবিষ্কারের মাধ্যমে। বিশেষ করে নেটওয়ার্ক ইন্টারর্নেট আবিষ্কারের মাধ্যমে এর নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এর পর থেকে ইন্টারনেট সকল ধরনের যোগাযোগের মেরুদণ্ডে পরিণত হয়। যা বর্তমান আধুনিক সময়ে জ্ঞান আহরণের অন্যতম মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
প্রত্যেক মুদ্রারই দুটো দিক থাকে, ঠিক তেমনি ইন্টারনেটের কিছু ভালো ও কিছু খারাপ দিক রয়েছে। তার মধ্যে একটি প্রতিকূল দিক হচ্ছে সাইবার ক্রাইম ‘ইন্টারনেট ব্যবহার করা অপরাধ’। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ধরনের অপরাধমূলক কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করা হয় যেমন; ইমেইল স্পুঞ্জিং, ক্রেডিট কার্ড জালিয়তি, স্প্যাম এবং সফটওয়ার পাইরেসিসহ আরো অনেক অপরাধ যা আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
সরকার কর্তৃক বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করার পর থেকে প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহারের সংখ্যা বেড়ে যায় তার সাথে পাল্লা দিয়ে দেশে বেড়েছে সাইবার অপরাধ। এই অপরাধকে দমন করার জন্য ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ধারা সম্ভবপর হচ্ছে না, অধিক মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগে মানুষ ভিন্ন ধরনের অপরাধ করতে থাকে যা এই আইনে প্রতিকার দেয়া সম্ভব ছিল না। তাই অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে ও ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে প্রতিকার প্রদানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ প্রনয়ণ করা হয়। পরবর্তীতে এই আইন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় বিভিন্ন মহলে। সমালোচনার কারণে সরকার এই আইনটি ও বাতিল করে নতুন আইন তথা সাইবার।
আমাদের দেশে ১১ ধাপে সাইবার অপরাধ হচ্ছে যেমন: সহিংস উগ্রবাদ, গুজব, রাজনৈতিক অপপ্রচার, মিথ্যা সংবাদ, গ্যাং কালচার, পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, জালিয়াতি, চাঁদাবাজি, পাইরেসি, আসক্তি এবং নারীদেরকে ব্ল্যাকমেইলিং। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ সালের ৬৮ ধারা মতে ঢাকায় একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যাল স্থাপিত হয়েছে। আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সরাসরি ট্রাইবুনালে মামলা দায়ের করতে পারেন অথবা পুলিশের কাছে অভিযোগ দেবেন এবং পুলিশ তদন্ত সাপেক্ষে উপযুক্ত আদালতে মামলাটি গ্রহণের জন্য প্রেরণ করবেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ আইনের অতিরাষ্ট্রিক প্রয়োগ রয়েছে অর্থাৎ ৪ (১) ধারা মতে কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাহিরে কোনো অপরাধ সংঘটন করলে যদি এই আইনের অধীন দণ্ডযোগ্য হয়, তাহলে তিনি বাংলাদেশেই অপরাধ সংঘটন করেছেন বলে বিবেচিত হবে এবং এই দেশের আদালতে মামলা করা যাবে। কিন্তু অপরাধের পরিমাণ এত বেড়ে গেলো যে একটি আদালত বা ট্রাইবুনালের পক্ষে এতো অপরাধের বিচার করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে পরবর্তীতে ২০২১ সালে আরো ৭টি ট্রাইবুনাল যুক্ত করে অর্থাৎ প্রত্যেক বিভাগে একটি করে বর্তমানে ট্রাইবুনাল রয়েছে ৮টি।
পরবর্তীতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ রহিত করে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ প্রনয়ন করা হয় কিছু ধারায় পরিবর্তন আনায়নের মাধ্যমে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে সকল ধারা পরিবর্তন এনে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে সে সকল ধারার তুলনামূলক পার্থক্য তুলে ধরা হলো।
যেহেতু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ কে রহিত করে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ প্রনয়ন করা হয় সেহেতু বর্তমানে সংঘটিত সাইবার অপরাধের বিচার কার্জ পরিচালিত হবে সাইবার নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বলবত থাকাকালীন যে সকল মামলা সাইবার ট্রাইবুনালে বিচারাধীন রয়েছে সে সকল মামলা পরিচালিত হবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী। তা থেকে বুঝা যাচ্ছেÑ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রভাব এখনই শেষ হয়ে যাচ্ছে না। কেননা বিভিন্ন আদালতে প্রায় ৭,৫০০ মামলা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিচারাধিন রয়েছে। যে সকল মামলা পরিচালিত হবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ অনুযায়ী।
সাইবার নিরাপত্তা আইনে যেসব ধারায় পরিবর্তন আনা হয়েছে :
২১ ধারা : এই ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালায় বা তাতে মদদ দেয় তাহলে সেটি অপরাধ বলে গণ্য হতো এবং এর জন্য ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান ছিল।
এই একই অপরাধ কেউ দ্বিতীয়বার করলে তার সাজা দ্বিগুণ করার বিধান ছিল। আর বারবার একই অপরাধের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা তিন কোটি টাকা জরিমানার বিধান ছিল। এই ধারাটিতে পরিবর্তন এনে সাজার মেয়াদ ৫ বছর করা হয়েছে। আর দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলেও সাজা দ্বিগুণ করার বিধান রহিত করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করা বা উস্কানি দেয়ার জন্য ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করে, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত করে, তাহলে তা অপরাধ হবে। এই অপরাধের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর কারাদণ্ড, বা দশ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। একই অপরাধ বার বার করলে সাজা ও জরিমানার মেয়াদ দ্বিগুণ হওয়ার বিধান ছিল।
এই ধারায় সাজা কমানো হয়েছে, ২ বছর করা হয়েছে। এই ধারার অপরাধ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধিনে জামিন অযোগ্য ছিল। কিন্তু নতুন আইনে এই অপরাধ জামিনযোগ্য করা হয়েছে (ধারা ৫২)।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে তিনি তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। এছাড়া একই অপরাধ পুনরায় সংঘঠনের জন্য পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল।
এই ধারায় পরিবর্তন এনে কারাদণ্ডের যে সাজা ছিল সেটাকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। এখানে শাস্তি হবে শুধু জরিমানা। আর জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড হতে পারে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারায় এর আগে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় তাহলে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ৭ বছর এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। একাধিক বার একই অপরাধ করলে সাজা বেড়ে ১০ বছর এবং জরিমানা ১০ লাখ টাকা করার বিধান ছিল। এই ধারায় পরির্বতন এনে সাজার সময়-সীমা কমানো হয়েছে। আগে সাত বছরের কারাদণ্ডের পরিবর্তে এটা কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। বার বার একই অপরাধ করলে সাজা বাড়ানোর বিষয়টি বাতিল করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩৩ ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে হ্যাকিং সম্পর্কিত অপরাধ নামে নতুন ধারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, যা নতুন আইনের ৩২ ধারায় আসছে । এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
ডিএসএ এর ৩৩ ধারায় বলা হয়েছিল যে, যদি কোনো ব্যক্তি কম্পিউটার বা ডিজিটাল সিস্টেমে বে-আইনিভাবে প্রবেশ করে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা কোনো আর্থিক বা বাণিজ্যিক সংস্থার কোনো তথ্য-উপাত্তের কোনো ধরণের সংযোজন বা বিয়োজন, স্থানান্তর বা স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তা অপরাধ বলে ধরা হবে।
বর্তমান আইনে হ্যাকিং হচ্ছে, কম্পিউটার তথ্য ভাণ্ডারের কোন তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তন বা তার মূল্য বা উপযোগিতা কমানো বা অন্য কোন ভাবে ক্ষতিসাধন বা নিজ মালিকানা বা দখল বিহীন কোন কম্পিউটার, সার্ভার, নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশের মাধ্যমে তার ক্ষতিসাধন হবে হ্যাকিং। আপরাধ সংগঠনের সহায়তা পূর্বের আইনের ৩৫ ধারায় ছিলো বর্তমান আইনের ৩৩ ধারায় আছেÑ ডিএসএ এর ৪৩ ধারা নিয়ে বড় বিতর্ক থাকলেও সেটি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
অপরাধের আমলযোগ্যতা ও জামিনযোগ্যতা। এই আইনের ধারা ১৭, ১৯, ২৭ ও ৩২ এ উল্লিখিত অপরাধসমূহ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য হইবে। ধারা ১৮ এর উপ-ধারা (১) এর দফা (খ), ধারা ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১ ও ৪৬ এ উল্লিখিত অপরাধসমূহ অ-আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য হইবে। এবং ধারা ১৮ এর উপ-ধারা (১) এর দফা (ক)-তে উল্লিখিত অপরাধসমূহ অ-আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আদালতের সম্মতি সাপেক্ষে আপোষযোগ্য হইবে।
দুই আইন মিলিয়ে দেখা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধারা ১৮ এর উপ-ধারা (১) এর দফা (খ), ২০, ২৫, ২৯ ও ৪৭ এর উপ-ধারা (৩) এর অপরাধসমূহ ‘অ-আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য’ ছিল। প্রস্তাবিত আইনের এগুলোর সঙ্গে ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৮, ৩১ ও ৩২ ধারাকেও ‘জামিনযোগ্য’ করা হয়েছে।
আগের আইনে ৩৪ নম্বরে ধারায় থাকা হ্যাকিংয়ের শাস্তির বিধান নতুন আইনে ৩৩ নম্বরে এসে ‘অজামিনযোগ্য’ই থাকছে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার পথে বাধা হিসাবে চিহ্নিত ৩৩ ধারা বাতিলের পাশাপাশি অনলাইন মাধ্যমে মানহানির বিধানেও আনা হয়েছে পরিবর্তন। অন্যদিকে, জামিনযোগ্য হিসাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে থাকা ৪৭ থেকে বর্তমান আইনে ৪৬ নম্বরে উঠে আসা বিধান জামিনযোগ্যই থাকছে।
সর্বশেষে বলা যেতে পারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা নতুন প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনকে আইন নতুন মোড়কে একই জিনিস বলা যেতে পারে। নতুন কিছু সংযুক্ত করা ছাড়াই এটিকে একই বিষয়ের পুনরায় উপস্থাপন হিসেবে ধরা যেতে পারে।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট