বুধবার ৯ জুলাই ২০২৫ ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
বুধবার ৯ জুলাই ২০২৫
উপকূলীয় অঞ্চলে রিলে পদ্ধতিতে গম উৎপাদন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০২৪, ১:৪৪ PM
বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চলে শুধু বৃষ্টির মৌসুমে বছরে একটি মাত্র ফসল আমন ধান হয়। এই ধান কৃষকরা ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে কেটে থাকেন। এরপর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অপঘাতে শুষ্ক মৌসুমে জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে এবং সেই সঙ্গে সেচযোগ্য পানির দুষ্প্রাপ্যতার কারণে উপকূলের ৪ লক্ষ ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ছয় মাস থেকে সাত মাস কোনো ফসল ফলানো সম্ভব হয় না।

এই বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চলের লবণাক্ত পতিত জমিতে ফসল ফলানোর লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (ACIAR)-এর সহায়তায় গত পাঁচ বছর থেকে সাত বছর ধরে গবেষণা করে যাচ্ছি। যেহেতু গম ও ডাল জাতীয় ফসলে অল্প পানি সেচ দিয়েই ভালো ফসল উত্পাদন সম্ভব এবং ফসল হিসেবে গম প্রকৃতিগতভাবেই কিছুটা লবণাক্ততাসহিষ্ণু, তাই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অপঘাত মোকাবিলায় উপকূলে রিলে পদ্ধতিতে গম ও মুগ ফসলের প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণা করছি।

গমের জন্য ঠান্ডা আবহাওয়া জুঁতসই। ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচের তাপমাত্রায় গমগাছ ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং তা ভালো মানের গমের শিষ বের হতে সহায়তা করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখন শীতকাল ছোট হয়ে গেছে। দক্ষিণাঞ্চলে শীতকাল আরো কম। তবে গম উত্পাদনে এ ধরনের ঠান্ডা আবহাওয়া এখনো বাংলাদেশের উপকূলে শুধু ডিসেম্বর মাসের শেষার্ধে এবং জানুয়ারি মাসে পাওয়া যায়। সেজন্য বাংলাদেশের উপকূলে গম বোনার প্রকৃত সময় মধ্য নভেম্বর। মধ্য নভেম্বর জমিতে গমবীজ বুনলে জানুয়ারি মাসের অনুকূল ঠান্ডা আবহাওয়ায় প্রচুর গমের ছড়া বের হতে সহায়ক হবে। কিন্তু উপকূলের জমিতে নভেম্বর মাসে আমন ধান থাকে, যা কৃষকরা ডিসেম্বর মাসে কেটে থাকেন। এ কারণে সঠিক সময়ে গমবীজ বোনার লক্ষ্যে জমিতে আমন ধান থাকা অবস্থায়ই মধ্য নভেম্বরই গমবীজ ছেটানো হয়েছে। এটিই রিলে পদ্ধতিতে গম চাষ প্রযুক্তি। 

নভেম্বর মাসে জমিতে লবণাক্ততা কম থাকার কারণে গমবীজ ভালোভাবে গজাতে এবং বেড়ে উঠতে পারছে। এছাড়া নভেম্বর মাসে জমিতে আর্দ্রতা থাকার কারণে গম প্রয়োজনীয় রস পাচ্ছে। আমার এই গবেষণায় মধ্য নভেম্বর সঠিক সময়ে জমিতে গমবীজ বোনার কারণে এবং ঐ সময়ে জমিতে লবণাক্ততা না থাকা বা কম থাকার কারণে এবং মধ্য নভেম্বর জমিতে প্রয়োজনীয় রস বা আর্দ্রতা বিদ্যমান থাকা—মূলত এই তিন কারণেই উপকূলের লবণাক্ত পতিত জমিতে রিলে পদ্ধতিতে গম চাষে অসামান্য সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে।

রিলে প্রযুক্তিতে জমি চাষের প্রয়োজন হয় না বিধায় উত্পাদন খরচও অনেক কম, যা পরিবেশসহায়ক। এছাড়া গম চাষাবাদে কম পানি সেচ দিতে হয়। আবার রিলে গম চাষাবাদে পানির প্রয়োজন আরো কম। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখন প্রায় প্রতি বছরই আগাম বৃষ্টি হচ্ছে। প্রতি বছরই ডিসেম্বর বা জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথমে কোনো না কোনো সময়ে বৃষ্টি হচ্ছে, যা গম চাষের জন্য ভালো। এ সময় বৃষ্টি হলে সেচের প্রয়োজন হয় না। এতে সেচখরচও কমে যায়। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে রিলে গমের জমিতে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার বিকল্প নেই। গম ফসল জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।      

উপকূলের এই সমস্ত পতিত জমিতে শুষ্ক মৌসুমে ফসল ফলাতে লবণাক্ততার পাশাপাশি সেচযোগ্য পানির অপ্রতুলতাও একটি সমস্যা। আমার একটি গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলের লবণাক্ত জমির ঠিক নিচেই যে পানির স্তর আছে, তা লবণাক্ত এবং সেচযোগ্য নয়। কিন্তু এই সমস্ত জমির ১ হাজার ১০০ ফুট থেকে ১ হাজার ২০০ ফুট গভীরের পানি লবণাক্তমুক্ত ও সেচযোগ্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই পানির লবণাক্ততা ০.৫ ডিএস/মিটারের কম, যা শুধু ফসল চাষাবাদেই নয়, খাওয়ারও যোগ্য। সাবমারসিবল পাম্পের সাহায্যে ১ হাজার ১০০ ফুট বা তার-ও নিচের পানি উত্তোলন করা সম্ভব। বোরিং ও ফিটিংসহ সম্পূর্ণ পাম্পটি কিনতে এবং বসাতে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। এ ধরনের একটি পাম্প দিয়ে ২০ বিঘা থেকে ২৫ বিঘা জমিতে অনায়াসে রিলে প্রযুক্তিতে গমসহ অন্যান্য রবি ফসলের চাষাবাদ করা যাবে। এর থেকে নিরাপদ খাওয়ার পানিও পাওয়া যাবে।

এছাড়া উপকূলের প্রায় সব জায়গাতেই প্রচুর খাল, পুকুর, ডোবা, জলাশয় আছে, সেগুলো সংস্কার করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলেই উপকূলের বিশাল জমি রিলে গম চাষের আওতায় আনা সম্ভব। এছাড়া আমার আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, এক একর বা ১০০ শতাংশ জমির ১০ ভাগ অর্থাত্ মাত্র ১০ শতাংশ জমিতে যদি ৬ ফুট–৬ ফুট–৬ ফুট অর্থাত্ দৈর্ঘ্যে ৬ ফুট, প্রস্থে ৬ ফুট ও গভীরতায় ৬ ফুট করে জমির উঁচু স্থানে পুকুর খনন করা যায় এবং ঐ পুকুরের পানি যাতে চুঁইয়ে নিচে চলে না যায়, সেজন্য পুকুরের তলদেশে মোটা পলিথিন বিছিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায়, তাহলে ঐ বৃষ্টির পানিতে ছয় মাস মাছ চাষ সম্ভব এবং ঐ পানি দিয়ে বাকি ৯০ শতাংশ জমিতে রিলে পদ্ধতিতে গম উত্পাদন সম্ভব। 

রিলে পদ্ধতিতে এক বিঘা জমিতে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা খরচ করে ৪০০ কেজি (১০ মন) গম পাওয়া যাচ্ছে; যার মূল্য প্রতি কেজি ৫০ টাকা হিসাবে ২০ হাজার টাকা। উপকূলের পতিত জমিতে রিলে পদ্ধতিতে গম ফসল চাষাবাদ ছড়িয়ে দিতে পারলে ৪ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর (৩২ লক্ষ বিঘা) পতিত জমিতে ১৩ লক্ষ টন বা ৩ কোটি মন গম পাওয়া যাবে। উপকূলে গত  পাঁচ বছর থেকে ছয় বছর ধরে কৃষকের মাঠে কৃষকদের সঙ্গে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে গবেষণার কাজ করতে পারার কারণে এবং পাশাপাশি প্রচলিত ধ্যানধারণাকে কাজে লাগিয়ে উপকূলের কৃষকের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বিশ্বাস করি, রিলে পদ্ধতিতে বিনা চাষে কম খরচে গম উত্পাদন  এই অঞ্চলের জন্য একটি আশীর্বাদ।

এতে শুষ্ক মৌসুমে পতিত জমিতে উপকূল অঞ্চলের কৃষকরা আমন ধানের পর আরো একটি লাভজনক ফসল ঘরে তুলতে পারছে। যেহেতু রিলে পদ্ধতিতে গম চাষে খুব কম পরিমাণ পানির প্রয়োজন—মাত্র তিন বার হালকা সেচ দিলেই ভালো গম উত্পাদন সম্ভব, সেহেতু শুধু সেচের ব্যবস্থা থাকলেই উপকূলের বিশাল পতিত অঞ্চলে রিলে পদ্ধতিতে গম উত্পাদন করতে পারবে, যা শুধু উপকূল অঞ্চলের অবহেলিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তায়ই নয়, বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তায়ও বড় অবদান রাখবে। এছাড়া মুগ ফসলও অত্যন্ত কম সময়ের ফসল। মাত্র ৭০ দিন থেকে ৮০ দিনে প্রথম বার মুগ ফসল ঘরে তোলা সম্ভব। মুগে পানির প্রয়োজনও খুবই কম। বাংলাদেশে দানা জাতীয় এমন আর কোনো ফসল নেই, যার থেকে মাত্র ৭০ দিন থেকে ৮০ দিনে ফসল সংগ্রহ সম্ভব। মুগডালের বীজও রিলে পদ্ধতিতে আমন ধানের জমিতে ছিটিয়ে দিলে বীজ বোনার ৭০ দিন থেকে ৮০ দিনের মধ্যেই অর্থাত্ জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার আগেই প্রথম বারের ফসল ঘরে তোলা সম্ভ্ভব।

আমি বিশ্বাস করি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অপঘাত মোকাবিলায় উপকূলের পতিত জমিতে রিলে পদ্ধতিতে আমন ধানের জমিতে গম ও মুগ ফসল চাষের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবেন এবং আগামী মৌসুমেই উপকূলের পতিত জমিতে রিলে পদ্ধতিতে গম ও মুগ ফসল চাষের উদ্যোগ নেবেন। আমি বিশ্বাস করি, শুধু রিলে পদ্ধতিতে আমন ধানের জমিতে গম ও মুগ ফসল চাষের মাধ্যমেই উপকূলের কৃষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘প্রতি ইঞ্চি জমিকে আবাদের আওতায় আনা’ সম্ভব। 
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত