নৌপথ হলো বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণ। প্রতিবছর প্রায় ১১ বিলিয়ন টন পণ্য জাহাজে পরিবহন করা হয়। যাতায়াত এবং বাণিজ্যের জন্য স্থলপথ বা আকাশপথ যতই উন্নত হোক না কেন আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্য, কাঁচামাল পরিবহন এবং সাশ্রয়ী মূল্যের খাদ্য ও উৎপাদিত পণ্য আমদানি-রপ্তানি জলপথ ছাড়া সম্ভব হবে না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে, মোট রপ্তানি এবং আমদানির পরিমাণ বিবেচনায় ৮০ শতাংশ এবং মূল্যের ভিত্তিতে ৫০ শতাংশ নৌপথে হয়ে থাকে। প্রধানত পণ্য পরিবহনের সুবিধা এবং কম খরচের কারণে নৌপথকে শত শত বছর ধরে বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি এই নিরাপদ পথটি অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। মানবসৃষ্ট সমস্যার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট এতে যুক্ত হওয়ায় আমদানি-রপ্তানি বাজার আরও অস্থির হয়ে ওঠার সম্ভবনা দেখা দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব ইতিমধ্যেই দুইটি দেশের বাইরেও বিস্তৃত হয়েছে। ফিলিস্তিনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েল-সংযুক্ত জাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর ওপর যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা হামলার তীব্রতা বৃদ্ধির পর সংকট আরও গভীর হয়েছে। ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় বাংলাদেশের মতো যে দেশগুলো ইউরোপে পণ্য পাঠানোর জন্য এই রুট ব্যবহার করে, তাদের জন্য বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
লোহিত সাগরকে ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত করা সুয়েজ খাল ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ছোট পথ। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে হয়, যা বৈশ্বিক কনটেইনার ট্রাফিকের ৩০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করে। হোয়াইট হাউসের মতে, বৈশ্বিক শস্য বাণিজ্যের ৮ শতাংশ, সমুদ্রগামী তেলের ১২ শতাংশ এবং বিশ্বের তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বাণিজ্যের ৮ শতাংশ লোহিত সাগর দিয়ে যায়। গত মাস থেকে হুতিদের হামলার পর শিপিং কোম্পানিগুলো এখন লোহিত সাগর থেকে শিপিং রুট আফ্রিকার কেপ অফ গুড হোপের পাশে সরিয়ে নিচ্ছে। ব্রিটিশ চেম্বার অফ কমার্সের বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম বেইন বলেছেনÑ ‘নভেম্বরে প্রায় ৫০০,০০০ কনটেইনার সুয়েজ খাল দিয়ে গেলেও ডিসেম্বরে তা ৬০ শতাংশ কমে ২০০,০০০ হয়েছে।’ সাংহাই কনটেইনারাইজড ফ্রেইট ইনডেক্স (এসসিএফআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ লোহিত সাগরে সংঘাতের কারণে প্রতিটি জাহাজকে তার গন্তব্যে পৌঁছতে অতিরিক্ত ১০ দিন ব্যয় করতে হবে। এতে করে প্রতি ২০ ফুট কন্টেইনারের দাম ২৫,০০০ ডলারের থেকে বেড়ে ৩০,০০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থায় একদিকে সময় বৃদ্ধি অন্যদিকে ব্যয় বৃদ্ধির কারণে তেল-গ্যাসের দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে।
বৈশ্বিক মালবাহী জাহাজের ভাড়া আবার বাড়ছে। শিল্প বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে লোহিত সাগরে নিরাপত্তা হুমকির কারণে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দাম দ্বিগুণ হতে পারে। ইতিমধ্যে, বিশ্বের প্রধান প্রধান শিপিং জায়ান্টগুলো জানুয়ারি মাস থেকে প্রতি কন্টেইনারে ৭০০ থেকে ১,৫০০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত সারচার্জ আরোপের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ফরাসি কোম্পানি ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কাসহ সমস্ত এশিয়ান বন্দর থেকে সমস্ত ইউরোপীয় বন্দরগুলোতে ১ জানুয়ারি থেকে ‘পিক সিজন সারচার্জ’ আরোপ করেছে। এই সিদ্ধান্তটি ইতিমধ্যেই পণ্য পরিবহনের খরচকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করা শুরু করেছে। যদি সঙ্কটটি বাড়তে থাকে, তাহলে এটি আমদানিকৃত পণ্যের জন্য গ্রাহকদের মূল্য বৃদ্ধির কারণ হতে পারে, যা বিশ্বব্যপী মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে কাজ করবে।
বাংলাদেশের উপর প্রভাব : লোহিত সাগরে নিরাপত্তা হুমকির কারণে, বিশ্বের বেশিরভাগ বড় জাহাজ কোম্পানি Maersk,
MSC, Hapag-Loyd, CMA CGM, ZIM এবং ONE বাধ্য হয়ে তাদের জাহাজগুলোকে আফ্রিকার কেপ অফ গুড হোপের পাশে দিয়ে যাতায়াত করাচ্ছে। এর ফলে অপারেশন খরচ এবং গন্তব্যে পৌঁছতে সময় বাড়ছে। অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশের প্রায় ১৩০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যের একটি ভাল অংশ জলপথ দিয়ে হওয়ায় বাংলাদেশও এই সংকট থেকে রেহাই পাবে না। ইইউ, ইউএস ইস্ট কোস্ট এবং কানাডাগামী বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ রপ্তানি বোঝাই কনটেইনার লোহিত সাগর অতিক্রম করে। তাছাড়া রাশিয়া, ইউক্রেন, রোমানিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, ডাল এবং সয়াবিনের মতো বিশেষ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্যও এই রুট ব্যবহার করে বাংলাদেশ।
দীর্ঘায়িত লোহিত সাগর সংকট বাংলাদেশের রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, মুদ্রাস্ফীতির চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বিলম্বিত করতে পারে। বাংলাদেশের পোশাক খাত এই রুটের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল, কারণ দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ কাপড় ইউরোপীয় দেশগুলোতে রপ্তানি হয়। কনটেইনার ঘাটতি এবং পণ্য সরবরাহে সময় বৃদ্ধির কারণে, রপ্তানিকারকরা সারাবিশ্বেই অর্ডার হারাচ্ছেন। বাংলাদেশের পোশাক খাতও রপ্তানি আদেশ হারাতে পারে। উচ্চ কন্টেইনার ভাড়া এবং কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেতে পারে। যেহেতু জাহাজগুলো আফ্রিকা হয়ে রি-রুট করছে এবং মালিকরা অতিরিক্ত দাম দাবি করছে, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশি প্তানিকারক এবং আমদানিকারকদেরও উচ্চ মালবাহী চার্জ দিতে হবে। এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপরও চাপ দিতে পারে, কারণ বর্ধিত খরচ বৈদেশিক মুদ্রায় বহন করতে হবে। শুধু তাই নয়, সংকট দীর্ঘায়িত হলে জাহাজ পাওয়া কঠিন হবে, যা সমগ্র ব্যবসায় প্রভাব ফেলবে।
সাধারণত, বাংলাদেশি পণ্য নিয়ে শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর থেকে লোহিত সাগর হয়ে ইউরোপীয় গন্তব্যে পৌঁছাতে জাহাজগুলোর ৩০ থেকে ৩৫ দিন সময় লাগে। এখন থেকে কমপক্ষে আরও অতিরিক্ত ১০ দিন লাগবে। এই বাড়তি খরচ শেষ পর্যন্ত গার্মেন্টস সরবরাহকারীদের বহন করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে পোশাক রপ্তানিকারকদের ব্যয়বহুল এয়ার শিপমেন্ট বেছে নিতে হবে। কিন্তু, এক্ষেত্রে খরচ অনেক বেশি হবে। উদাহরণস্বরূপ, সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম থেকে ইউরোপীয় গন্তব্যে এক কিলোগ্রাম পণ্য স্থানান্তর করতে ৩০ ইউএস সেন্টের কম খরচ হয়, সেখানে বিমান মালবাহী পরিষেবা ব্যবহার করা হলে একই পরিমাণের জন্য খরচ ৩.৫০ ডলার বহন করতে হবে।
এই সংকট শুধুই যে বাংলাদেশে আঘাত হানবে না, এমন নয়। বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোও একই রকম পরিস্থিতিতে পড়বে। তবে একটি ইতিবাচক খবর হলো বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজগুলো এখন পর্যন্ত হুতিদের আক্রমনের টার্গেট হয়নি। হুথিরা বলে যে তারা কেবল ইসরায়েলের সাথে যুক্ত জাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করবে, তাই বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের পতাকা বহনকারী জাহাজের ঝুঁকি কম হতে পারে। তদুপরি, বাংলাদেশি সরবরাহকারীরা বিভিন্ন রুট ব্যবহার করার কারণে সার এবং জ্বালানির চালানের সময়ে কোন প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশ মূলত কেপ অব গুড হোপ ও আরব সাগর দিয়ে সার আমদানি করে। তাই এ অবস্থায় শিপিংয়ের সময় বাড়বে না, কিন্তু মালবাহী চার্জ বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশর জন্য আরেকটি সুবিধা হলো, দেশটির পণ্য আমদানির খুব নগণ্য একটি অংশ লোহিত সাগর দিয়ে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২৩ সালে দেশের ৬৮.৪৫ বিলিয়ন টাকার আমদানির ২৬.১ শতাংশ চীন থেকে সরবরাহ করা হয়। ১৩.৯ শতাংশ শেয়ার নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। পরবর্তী প্রধান সরবরাহকারীরা হল মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, কাতার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং দক্ষিণ কোরিয়া। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, লোহিত সাগরের সংঘাতের কারণে আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ বাংলাদেশ থেকে বেশিরভাগ রপ্তানি পণ্য ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যায়।
বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম শিপিং রুট লোহিত সাগর যেহেতু হুথি হামলা এবং তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের পাল্টা হামলার কারণে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, তাই অচিরেই বিশ্বে আরও একটি সাপ্লাই চেইন সংকট দেখা দিতে পারে। জ্বালানি সরবরাহ উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হতে পারে। এর ফলে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি অন্যান্য পণ্যের দামে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে এবং ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে বাড়িয়ে তুলবে, যা বিশ্বে বিনিয়োগ এবং প্রবৃদ্ধির হারকে কমিয়ে দিতে পারে।
লেখক : করপোরেট সেক্টরে কর্মরত ও গবেষক