শীত যাচ্ছে, আসছে বসন্ত। এর পরই আসবে প্রচণ্ড গরমের গ্রীষ্মকাল। আবহাওয়ায় শুরু হয়েছে ঋতু পরিবর্তনের খেলা, দিনের বেলা গরম এবং রাতে শীতল হাওয়া। আবহমান কাল থেকেই ঋতুর এই পরিবর্তন চলে আসছে এবং চলতেই থাকবে।
ঋতু পরিবর্তনের এই খেলায় তাপমাত্রা, আর্দ্রতা আর ধুলোবালুর তারতম্যে দেখা যায় নানা রকম অসুখ-বিসুখের উৎপাত। এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন বা রোগব্যাধি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই আমাদের সবাইকে হতে হবে সচেতন, নিতে হবে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। ঋতুভেদে এসব অসুখের বেশির ভাগই ভাইরাসজনিত এবং সাময়িক, কিন্তু অস্বস্তিকর। তবে সুবিধা হলো, একটু সতর্ক হলে প্রায় ক্ষেত্রেই এগুলো প্রতিরোধ করা যায়।
ঋতু পরিবর্তনের সময় রোগব্যাধির প্রকোপ হয় স্বাসতন্ত্রের ওপর। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত। বিশেষ করে শীতের শেষে আর গরমের শুরুতে তাপমাত্রা পরিবর্তনের সময়টাতেই এর প্রাদুর্ভাব বেশি। নাক দিয়ে পানি ঝরে, গলাব্যথা, শুকনো কাশি আর জ্বরও থাকতে পারে। এগুলো বেশির ভাগই ভাইরাসজনিত, লক্ষণভিত্তিক কিছু চিকিৎসা, এমনকি কোনো চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়, কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয় না। তবে শুকনো কাশিটা কয়েক সপ্তাহ ভোগাতে পারে। ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধ, অ্যান্টিহিস্টামিন খেতে হয়। আর গরম পানিতে গড়গড়া করতে হবে। গরম গরম চা বা গরম পানিতে আদা, মধু, লেবুর রস, তুলসী পাতার রস ইত্যাদি পান করলে উপকার পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাসের পরপরই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে।
জলবসন্ত রোগের প্রকোপও এই সময়ে বেশি বেশি হয়। প্রথমে একটু জ্বর-সর্দি, তারপর গায়ে ফোসকার মতো ছোট ছোট দানা। সঙ্গে থাকে অস্বস্তিকর চুলকানি, ঢোক গিলতে অসুবিধা। গায়ে ব্যথা থাকতে পারে। এটাও কোনো মারাত্মক অসুখ নয়। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, শরীর চুলকালে অ্যান্টিহিস্টামিন-জাতীয় ওষুধ, ক্যালামিন লোশন ইত্যাদি ব্যবহার করলেই রোগের প্রকোপ কমে আসবে। সাইনোসাইটিস ও টনসিলাইটিস-জাতীয় রোগগুলোও এই সময়ে দেখা দিতে পারে। টনসিলের সমস্যা যে কারোরই হতে পারে, তবে ছোট বাচ্চারাই বেশি আক্রান্ত হয়। হঠাৎ শীত চলে যাওয়ার প্রাক্কালে গরমের শুরুতে ঠান্ডা পানীয় বা আইসক্রিম খাওয়ার প্রবণতার কারণে, এমনকি বাচ্চারা স্কুলে বা অন্যান্য যায়গায় ধুলোবালুতে খেলাধুলা করলেও এসব রোগ বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। যারা হাঁপানি, ব্রংকাইটিস বা শ্বাসজনিত অন্যান্য রোগে ভোগেন, তাদের এই রোগের প্রকোপ শীতের পর বসন্তে, এমনকি গরমের শুরুতে বাড়তে পারে।
এ সময় বৃষ্টির কারণে আবহাওয়াও স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠে। এই জমে থাকা পানিতে এডিস মশা জন্ম নেয়। এই মশা ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু বহন করে। ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দেখা দিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। বর্ষায় জমে থাকা বৃষ্টির পানি ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার কারণে যে রোগটি বেশি সংক্রমিত হয়, তা হচ্ছে ফাঙ্গাল ইনফেকশন বা চর্মরোগ। দাদ জাতীয় গোল চাকা চাকা ফাঙ্গাল শরীরের নানা জায়গায় হতে পারে। অসহ্য চুলকানি হয়। এগুলো গোলগাল রিং আকারে শরীরে বাড়তে থাকে। তাই অনেক সময় একে রিংওয়ার্মও বলা হয়ে থাকে। আঙুলের ফাঁকে ঘা বর্ষাকালে একটি অতিপরিচিত সমস্যা এবং এতে মিক্স ব্যাকটেরিয়াল ও কেনডিডাল ইনফেকশন হতে পারে। ছুলি বর্ষার সময় বাড়তে পারে। একধরনের ছোপ ছোপ সাদা অথবা কালচে দাগ মুখে-পিঠে বা বুকে হয়ে থাকে। এসব সমস্যা এড়াতে বর্ষায় ত্বকের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। নিয়মিত ত্বক পরিষ্কার রাখা, সাবান দিয়ে গোসল করা, জামা-কাপড় নিয়মিত পাল্টানো বা পরিষ্কার রাখা এসব সমস্যা থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে।
আরো কিছু কিছু রোগ হওয়ার প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যায়, যেমন প্রচণ্ড গরমে পিপাসার কারণে রাস্তাঘাটে পানি বা শরবত পান করার ফলে পানিবাহিত রোগ বেশি হতে দেখা যায়। দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়া খাদ্যদ্রব্য, ফলমূল গ্রহণ করার ফলে প্রায়ই ডায়রিয়াজনিত রোগব্যাধি দেখা দেয়। এমনকি এসব গ্রহণ করার কারণে টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, জন্ডিস, সাধারণ আমাশয়, রক্ত আমাশয়ও হতে পারে। আবার তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত তাপমাত্রায় হিট স্ট্রোক বা হিট এক্সহসশানের মতো জটিল সমস্যার প্রকোপও দেখা দিতে পারে।
কী কী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে : শীতের শেষে হ্রীষ্মের আগমনে স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই মোটামুটি সুস্থ থাকা সম্ভব। (১) ধুলোবালু পরিহার করতে হবে, অতিরিক্ত গরমে যাওয়াও এড়িয়ে চলতে হবে এবং ঘাম হলে মুছে ফেলতে হবে।
(২) মনে রাখতে হবে, জ্বর এবং কাশি যদি দুই সপ্তাহের বেশি হয?, সর্দি একেবারে সারে না, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অযথা অবহেলা করলে অসুখ জটিল হয়ে যেতে পারে অথবা খারাপ রোগ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভাইরাসজনিত অসুখে আক্রান্ত রোগীর কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে।
(৩) যারা হাঁপানিসহ অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের রোগে ভোগেন, তারা বাইরে বেরোলে ধুলোবালু পরিহার করুন, প্রয়োজনে মাস্ক ব্যবহার করলে আরো ভালো হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঠান্ডা পানি বা খাবার খাওয়া, ধুলোবালুতে যাওয়া ইত্যাদি পরিহার করলে এসব রোগ থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব।
(৪) সব সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। যেখানে-সেখানে দূষিত পানি বা অন্যান্য পানীয় খাওয়া বর্জন করতে হবে। পানি বা অন্য তরলজাতীয় পান করুন অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি, শুধু যেন হয় বিশুদ্ধ। ওরস্যালইনও খেতে পারেন। (৫) পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণ, কাঁচা সবজির সালাদ, ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’যুক্ত ফলমূল গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা, যা রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে দেহকে রাখবে সুস্থ। (৬) নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করা, নিয়মিত ও পরিমিত কায়িক পরিশ্রম ও ধূমপান পরিহার করা উচিত।
(৭) ঘরবাড়ি তথা ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা। ঘরের দরজা-জানালা খুলে পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ করে দিয়ে একটি নির্মল বসবাসের পরিবেশ নিশ্চিত করা। (৮) হাত ধোয়ার অভ্যাস করা, বিশেষ করে নাক মোছার পর, বাইরে থেকে আসার পর এবং খাদ্যবস্তুর সংস্পর্শে আসার আগে হাত ধোয়া। (৯) প্রতি বছর ইনফ্লুয়েঞ্জার এবং পাঁচ বছর পর পর নিউমোনিয়ার টিকা নেওয়া উচিত।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক