সোমবার ৭ জুলাই ২০২৫ ২৩ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ৭ জুলাই ২০২৫
পূর্বপুরুষদের দোহাই ও সামাজিক মূল্যবোধ
চামেলী খাতুন
প্রকাশ: রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ৬:৪২ PM আপডেট: ১৮.০২.২০২৪ ৬:৪৮ PM
মোশতাকরা পৃথিবীর বুকে কিছুই রেখে যেতে পারে না তাদের ভোগবাদী জীবনের উচ্ছিষ্টাংশ ছাড়া। আর সন্তান লালন এই বিশ্বায়নের যুগে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের অতিসতর্কতার সঙ্গে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

মানুষ হয়ে জন্মানোর নানাবিধ প্যারা রয়েছে; কারণ পৃথিবীর বুকে একমাত্র মানুষকেই আলাদা কিছু দায়বদ্ধতা স্বীকার করে নিতে হয়; তা নাহলে সে মানুষ কীসের? অন্যান্য জীবজন্তু ও প্রাণী মানবের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। আর মানুষের বশ্যতা স্বীকার করে নিতে হয় নিজস্ব সত্তার কাছে, সমাজের কাছে, সৃষ্টি জগতের কাছে। আবার মানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই মানবমনের নিগূঢ় সত্য, দুঃখবোধের ব্যাপ্তিগুলো অনায়াসে বলতে না পারাও এক ভয়াবহ দুঃখ। আর এভাবে অনেক কিছু উপেক্ষা করতে করতে আমাদের জীবনের বোধের জগৎ কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে! মনে হচ্ছে কতকাল আগেই আমরা মরে-পচে-গলে গেছি। 

পৃথিবীর বুকে জন্ম নিয়েই মানুষ আত্মচিৎকারে ফেটে পড়ে। জানান দেয় পৃথিবীকে ‘আমি এসেছি, আমাকে মানবের মাঝে ঠাঁই দাও’। অথচ কতটুকুই বা মানুষের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পায় একজন নবজাতক? অর্থাৎ জীবনের পরতে পরতে এক একটা ধাপ অতিক্রম করা, নবসংযোজনে, নব-আয়োজনে সামিল হওয়ার লড়াই, সদ্যজাত শিশুর এক একটা অভিযানে?

বিবাহ নামক একখণ্ড শব্দ আমাদেও জীবনকে শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করেছে; সামাজিক দায়বদ্ধতাকে বহু ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। কারণ এখানে থাকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বীকৃতি। সেখানে বয়সের সীমারেখা অযাচিত তবুও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে শারীরিক পরিপূর্ণতা,মানসিক মেলবন্ধন, প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যেটাকে উপেক্ষা করে আধুনিক সভ্য জগতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ধাপগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

বিবাহরীতির সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা বিবেচ্য বিষয়। বিশেষ করে আমাদের প্রাচ্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পেশাগত জীবনে নারীর পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত জনগোষ্ঠীর কাতারে ফেলে যুগ যুগ ধরে তাদের ভরণপোষণের দায়ভার স্বামী নামক পুরুষ লোকটির উপরই বর্তেছে। অতএব, কোনো পরিবার যদি অর্থনৈতিক সঙ্গতিপূর্ণতাকে কন্যার জীবন সঙ্গী নির্বাচনে প্রাধান্য দেয় তাতে দোষের কিছু দেখি না।
তবে সেক্ষেত্রেও বয়স এবং মানসিক সামঞ্জস্যতা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অজ্ঞতা বিধ্বস্ত করে আমাদের কুসুমিত স্বজ্ঞার। আর অসভ্যতা সেটাকে তরান্বিত করে নিয়ে যায় বহু পথ। অন্ধবিশ্বাস মানুষের অন্ধত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে। যে বা যারা অন্ধবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে কুযুক্তির সাহায্যে সামাজিক অসঙ্গতিকে জায়েজ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ে তখন আমাদের বুঝতে হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠের এই হীন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে জীবনযাত্রা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় তাদের কাম্য। কারণ তারাও মনে-প্রাণে এমন দিনের অপেক্ষায় থাকে।

আমরা বলছি, পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়; এখান থেকে বেরিয়ে প্রস্তর যুগে পদার্পন কোনোভাবেই সম্ভব না। তবে আধুনিকতার ছত্রছায়ায় সুন্দরের, সৌন্দর্যের, সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে জীবনমানকে উজ্জীবিত করাই আধুনিকতার মূলমন্ত্র। কিন্তু আধুনিকতার দোহাই দিয়ে জীবন যাপনের বাণিজ্যিকীকরণ আমাদের মন্দ বার্তা দিচ্ছে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একধরণের বিকারগ্রস্ততা তৈরি করছে। যেটা থেকে উত্তরণের পথ সমাজ প্রণেতাদেরই বের করতে হবে। 

প্রলোভন এই শব্দটি বহুল প্রচলিত; এটার কাছে বশ্যতা স্বীকার করে অনেক সুযোগসন্ধানী মানুষ। তবে শিক্ষার মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠা মানুষ কখনো প্রলোভনে মত্ত হয়না। অতএব, পরিবার এবং শিক্ষায়তন থেকে বোধের চর্চা এবং সামাজিক মূল্যবোধে অধিষ্ঠিত হয়ে মুক্তচিন্তার সাহচার্যপ্রাপ্ত হলেই কেবল নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হয় না।

বিদ্যালয় শিক্ষা লাভের মাধ্যম; শিক্ষকবৃন্দ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিবর্গ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় এবং পিতা-মাতা তুল্য। আর আমি দেখেছি তাঁদের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের এক ধরনের মুগ্ধতা থাকে, যেটাকে কোনো সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। সেই মুগ্ধতাকে পুঁজি করে অনেক সুযোগসন্ধানী বিকারগ্রস্ত কর্তাব্যক্তি অবুঝ ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে কুরুচিপূর্ণ সম্পর্কে জড়িয়ে ফেলে। এখানে প্রেম কিংবা ভালোবাসা গৌণ; সহজে মেলামেশা করার সহজ পন্থা হিসেবে এই সুযোগটা ব্যবহার করে। এর নজির আমরা ইতিপূর্বে বহু ঘটনা প্রত্যক্ষ করে উপলব্ধি করতে পেরেছি।

চলমান কিছু সামাজিক অসঙ্গতি এবং চারিত্রিক স্খলন আমাদের ব্যক্তিগত জীবন ও সামগ্রিক মানবজীবনে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে; যার মধ্যে সর্বোচ্চ উল্লেখযোগ্য ঘটনা, ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ খন্দকার মোশতাক এবং আঠারো বছরের একজন উঠতি বয়সি তরুণীর মধ্যকার তথাকথিত প্রেম-ভালোবাসা এবং সেইটার দোহাই দিয়ে পরিণয়ে আবদ্ধ হওয়া। এর পক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তি, অযুক্তি, কুযুক্তির মাধ্যমে বিষয়টিকে জায়েজ-নাজায়েজ করার পাঁয়তারা চলছে। এর সাথে ঐ বেয়াকুব দম্পতি তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে বারবার মিডিয়ার সামনে আত্মপক্ষ সমর্থনের ঘোষণা দিচ্ছে। এর মাধ্যমে বিষয়টি তরুণ প্রজন্ম, সচেতন জনগণ এবং কুরুচিপূর্ণ সুযোগসন্ধানী মানুষের মাঝে নানারূপ মিশ্রপ্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এই ধরনের অসম সম্পর্ক সভ্য সমাজ, সুখী দাম্পত্য জীবন, সর্বোপরি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মন্দ বার্তা আনয়নসহ নানারকম বিভ্রান্তিকর অস্থিরতা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে এবং ভবিষ্যতে এর করুণ পরিণতি আমাদের সামাজিক, পারিবারিক কাঠামোকে ভঙ্গুর করে তুলবে বলে আমি মনে করি।

সৃষ্টির আদি থেকেই এই ধরণের অসম সম্পর্ক চলে আসছে না তা নয়;কিন্তু এই ধরনের সম্পর্ক তৈরিতে বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করাই ছিল এর মূল  কারণ। সেখানে আমরা লক্ষ করেছি পুরুষতান্ত্রিক প্রভাবপ্রতিপত্তি এবং অর্থনৈতিক অবস্থান মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। বৃদ্ধ বয়সে হতদরিদ্রের কন্যাকে প্রলোভন দেখিয়ে এবং সামাজিকভাবে তাদের সম্মানিত করতে (তথাকথিত) শাড়ি, গয়না,জায়গা, জমি লিখে দেওয়ার নামে জীবনের হীন চরিত্রের খায়েশ মেটানো এবং সেবাদাসী রূপে তাকে জীবন কাটাতে বাধ্য করা হয়েছে (পরিবারের মতেই)। এসব নারীদের অল্প বয়সে বৈধব্যের বেশে নানা চড়াই-উৎরাই জীবন বেছে নিতেও দেখা গেছে।  আবার যারা সুস্থ এবং সুখী দাম্পত্য জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সেখানে নারীটি (পুরুষটিও হতে পারে) আর নির্দ্বিধায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারবে না। পুরুষ (নারী) সঙ্গীটি যদি অগাধ সম্পত্তি-প্রতিপত্তির অধিকারী হয় তখন সম্পর্কটা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। শরিয়তের দোহাই, হুমায়ুন আহমেদ এর দোহাই, খন্দকার মোশতাকের লালসা তাদেরকেও সর্বগ্রাসী করে তুলবে। অতএব নারী সঙ্গীটি চরম দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়াবেন এবং সন্দেহের বর্শবতী হয়ে নানাবিধ অভিযোগ তুলে জীবন অতিষ্ট করে তুলবে। (যেহেতু এ ধরনের সম্পর্কে অর্থ মুখ্য ভূমিকা পালন করে; তাহলে নারীর উচিত হবে পুরুষের পকেট শূন্য করে রাখা)।

সবশেষে এটা বলতে চাই, আমরা আসলে নিজের সাথে, পরিবারের সাথে এমন ঘটনা ঘটলেই শুধু বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারব। কিন্তু এই যে রঙ্গ-তামাশা চলছে এই বুড়ো বয়সের ভীমরতি দেখে, তা থেকে উত্তরণের পথ পাচ্ছি না এবং মজা নিচ্ছি। আর সোশ্যাল মিডিয়ার লোকজন সামাজিক দায়বদ্ধতা পেছনে ফেলে ভিউজ বাড়িয়ে টাকা উপার্জনটাকেই মূখ্য করে তুলেছে। 

একবার তিশার বাবার চোখের পানি দেখুন, তারপর উপলব্ধি করুন এরূপ ঘটনার বলী তারা কীভাবে হয়েছেন! আর তিশার মতো সন্তান কারও ভাগ্যে যেন না জোটে সারাজীবন নিঃসন্তান থাকলেও।

পরিশেষে এটুকুই বলতে চাই,খন্দকার মোস্তাকরা যুগে যুগে সমাজ, মানুষ, সভ্যতা, সময় সর্বোপরি পৃথিবীর বুকে সুন্দর কিছুই রেখে যেতে পারেনা। তারা শুধু তাদের হীনচরিত্রের খোলস, ভোগবিলাসের উচ্ছিষ্টাংশ মানবকূলে কালো অধ্যায়রূপে সজ্জিত করে রেখে যায়। আর সুযোগসন্ধানী নেকড়ের দল সেই উচ্ছিষ্টাংশ ছিনিয়ে নিতে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে ওঠে এবং তাদের বদমতলব হাসিল করতে সেই পথ অনুসরণ করে। (কাউকে হেয় বা খাটো করা আমার উদ্দেশ্য নয়; চলমান অসঙ্গতি থেকে নিজস্ব উপলব্ধি আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে তাই লিখলাম।)

লেখক : কবি

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত