২৫ মার্চ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনের গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে হামাসের হাতে জিম্মি ব্যক্তিদের মুক্তি এবং গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বাড়ানোর জরুরি প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে।
অর্থাৎ যুদ্ধবিরতি, জিম্মিদের মুক্তি এবং গাজায় ত্রাণ বাড়ানো—এই তিনটি দাবি উপস্থাপিত হয়েছে ওই প্রস্তাবটিতে। প্রস্তাবটি তুলেছিল নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী ১০টি সদস্য দেশ—আলজেরিয়া, সিয়েরা লিওন, মোজাম্বিক, কোরিয়া, জাপান, স্লোভেনিয়া, গায়ানা, ইকুয়েডর, মাল্টা ও সুইজারল্যান্ড। নিরাপত্তা পরিষদের ১৪ সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও আগের মতো যুক্তরাষ্ট্র ভেটো না দিয়ে ভোটদানে বিরত থাকে।
প্রায় ছয় মাস ধরে গাজায় নির্বিচারে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে এ পর্যন্ত ৩২ হাজারের অধিক ফিলিস্তিনিকে প্রাণ দিতে হয়েছে, দেশের অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে, বেঁচে থাকা লাখ লাখ ফিলিস্তিনি দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। এমনকি গত সপ্তাহে আল-শিফা হাসপাতালেও ইসরায়েলি সেনাদের হাতে ১৫০ জনের অধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যদিও ইসরায়েল তাদের হামাস জঙ্গি হিসেবে আখ্যায়িত করে।
গাজায় যুদ্ধবিরতি কি আদৌ বাস্তবায়িত হবেসেখানকার সঠিক চিত্রটি ফুটে উঠেছে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বক্তব্যে। কয়েক দিন আগে গাজায় ত্রাণ সরবরাহের মূলপথ মিসরীয় অংশের সীমান্ত সফরে গিয়ে তিনি বলেন, গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে, বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে ফিলিস্তিনি শিশু, নারী ও পুরুষ সবাই দুঃস্বপ্নের মধ্যে রয়েছে। তিনি দেখেছেন একদিকে ত্রাণবাহী ট্রাকের দীর্ঘ সারি, অন্যদিকে ক্ষুধার্ত মানুষের দীর্ঘ ছায়া। তাই তিনি সেখানে আরো ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ দিতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান।
এর আগে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে কয়েকবারই প্রস্তাব পাসের চেষ্টা করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোক্ষমতা প্রয়োগের ফলে কোনো প্রস্তাবই পাস হয়নি। গত ২২ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছিল। প্রস্তাবটির পক্ষে ১১টি দেশ ভোট দিলেও রাশিয়া ও চীন ভেটো প্রদান করে, রোটেটিং সদস্য আলজেরিয়া বিপক্ষে ভোট দেয় এবং গায়ানা ভোটদানে বিরত থাকে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছাটি আর পূরণ হয়নি।
মূলত হামাসের হাতে জিম্মিদের মুক্তির জন্যই ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি’র জন্য ওই প্রস্তাবটি এনেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এটি ছিল ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে, বিশেষ করে হামাসের হাতে জিম্মি ব্যক্তিদের মুক্ত করার জন্য একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতির পাঁয়তারা। অন্যরা সেটি বুঝতে পারায় মার্কিনদের সেই উদ্দেশ্যটি সফল হয়নি। তা ছাড়া যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার জন্য সম্প্রতি ইসরায়েলসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।
যা হোক, এবার যে যুক্তরাষ্ট্র ভোট বা ভেটো কোনোটিই দেয়নি, বিরত থেকেছে, এটি অন্তত মন্দের ভালো। যে দেশটি গত ২২ মার্চ নিজেই ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল, সে কোন কারণে এই প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দিল না—এই প্রশ্নটি জাগাই স্বাভাবিক। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো অন্তর্নিহিত সমীকরণ রয়েছে। আসলে ফিলিস্তিনে যুক্তরাষ্ট্র কী চায়, তা কমবেশি সবারই জানা; যদিও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নাখোশ হয়ে ইসরায়েল এ মাসের শেষ সপ্তাহে নির্ধারিত ইসরায়েলি প্রতিনিধিদলের হোয়াইট হাউস সফর বাতিল করেছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন যে প্রস্তাবটি পাসের অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগের অবস্থান থেকে পিছু হটেছে। মিত্র দেশ হওয়ার পরও এই প্রস্তাব পাস হওয়া ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস হওয়া নিয়ে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়াকে বাড়াবাড়ি বলে মনে করছে ওয়াশিংটন। যেমনটি বাইডেন প্রশাসন জানিয়েছে, ইসরায়েল নিয়ে তাদের নীতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি, ভবিষ্যতেও হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষার্থে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়োগ করে, বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা প্রদান করে, যেকোনো পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের পক্ষ নেয়, ইসরায়েলের প্রধান রক্ষকের ভূমিকা পালন করে এবং কখনোই ফিলিস্তিনি নিধন থেকে তাদের বিরত রাখে না, সেই দেশ কী করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গিয়ে একটি নিরপেক্ষ মনোভাব পোষণ করতে পারে? আসলে ২২ মার্চের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি স্থাপনের যে ভূমিকা নিতে চাচ্ছিল, তা বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য, ফিলিস্তিনিদের বোকা বানিয়ে ইসরায়েলের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। বাস্তবতার নিরিখে যাচাই করলে যুক্তরাষ্ট্র কি এই সংকটে মধ্যস্থতা করার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা রাখে? যা হোক, ২৫ মার্চের প্রস্তাবে তার বিরত থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরায়েলের ভুল বোঝার কোনো কারণ থাকতে পারে না। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যা কিছুই ঘটে যাক না কেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনো ইসরায়েলকে বিপদে ফেলবে না।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববলয়ে যেসব মুসলিম দেশ রয়েছে, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় ঘটুক, এমন কিছু যুক্তরাষ্ট্র কখনো চাইবে না। কারণ তা ইসরায়েলের জন্যই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তা ছাড়া বিশ্ববাসী, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণও এই যুদ্ধের অবসান চায়।
জানা মতে, কাতারে যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাসের পরও গাজায় ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞ চলমান রয়েছে। ইসরায়েল যদি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত না মেনে নেয়, তাহলে যেসব পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে সে সম্পর্কে ইসরায়েল অবগত রয়েছে। কোনো দেশ যেন ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ না করতে পারে সে জন্য জাতিসংঘ থেকে নিষেধাজ্ঞাও আসতে পারে। তবে ইসরায়েলের কাছে মজুদ করা অস্ত্র দিয়ে যদি ফিলিস্তিনকে ধুলায় পরিণত করা যায়, ফিলিস্তিনি হত্যাযজ্ঞ আরো কয়েক মাস চালিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে ইসরায়েল জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি আহ্বানে সাড়া দেবে কি না সন্দেহ।
উল্লেখ্য, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সফরকালে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জানিয়েছেন যে মার্কিন সমর্থন ছাড়াই ইসরায়েল গাজার রাফাহতে সেনা পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। ইসরায়েলি সেনারা যেকোনো মুহূর্তেই রাফাহ অভিযানে নেমে পড়তে পারে। সেটি করলে জাতিসংঘ কি থামাতে পারবে? আর তখন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানটাই বা কী হবে?
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড কী হবে এবং সেসবে যুক্তরাষ্ট্র তাকে কতটুকু সমর্থন করবেÑ সবার দৃষ্টি এখন সেদিকেই। ইসরায়েল নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত কি মেনে নেবে, নাকি জাতিসংঘকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অতি পরিচিত গুণ্ডা রাষ্ট্রের তকমা নিয়ে ফিলিস্তিনি হত্যা অব্যাহত রাখবে? আর সে ক্ষেত্রে সারা বিশ্ব কি নীরব দর্শক হয়ে দুই বন্ধুর নৃশংসতার উল্লাস সহ্য করে যাবে? জাতিসংঘ আর বিশ্বের জনগণ কি এতটাই অসহায়!
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব