মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ডানকান ব্রাদার্স পরিচালিত আলীনগর এর ফাঁড়ি সুনছড়া ও কামারছড়া চা বাগান থেকে অবৈধভাবে বালু বিক্রির মহোৎসব চলছে। ছড়া ও ছড়ার পার্শ্ববর্তী চায়ের টিলা খুঁড়ে প্রতিনিয়ত সিলিকা বালু উত্তোলন করে ট্রাকযোগে পরিবহন করা হচ্ছে।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে চা বাগান কর্তৃপক্ষ ইতিপূর্বে জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিলেও কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এ ব্যাপারে চা বাগানের পক্ষ থেকে আদালতে মামলাও আছে। ফলে রাস্তা, চায়ের টিলা, ছড়া, কালভার্ট ভাঙ্গনসহ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে এবং সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণের রাজস্ব।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার সুনছড়া ও কামারছড়ার বিভিন্ন স্থান থেকে দীর্ঘদিন ধরে সিলিকা বালু উত্তোলন করে ট্রাকযোগে পরিবহন করা হচ্ছে। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্র অব্যাহতভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি ও পরিবহন করছে। এতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চায়ের টিলা, বাগানের রাস্তা, দুই চা বাগানের মধ্যবর্তী লোহার কালভার্ট, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও সম্ভাবনাময়ী খনিজ সম্পদ। এছাড়া চা বাগানের উত্তোলিত চা পাতা পরিবহনে বাঁধাগ্রস্ত হওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রছে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই দীর্ঘদিন ধরে অবাধে বালু উত্তোলন চলছে। এতে রাঘববোয়ালরাও সুবিধা পাচ্ছে।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের দাবি জানিয়ে ইতিপূর্বে আলীনগর চা বাগান ব্যবস্থাপক হাবিব আহমেদ চৌধুরী মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক বরাবরে দু’দফা লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয়, সুনছড়া ও রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের মধ্যবর্তী ছড়া বালু মহাল হিসাবে লিজভুক্ত না হলেও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ব্যাপকহারে বালু উত্তোলন অব্যাহত রয়েছে।
বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত ট্রাক চলাচলের প্রেক্ষিতে চা বাগানের রাস্তাঘাট চলাচলের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ফলে বাগানের চা পাতা পরিবহন ও অন্য্যান্য দৈনন্দিন কাজে চরম ব্যাঘাত ঘটছে। প্রশাসনের নজর এড়িয়ে এবং চা বাগানের নিষেধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে বাগানের শ্রমিক কর্মচারী, কর্মকর্তারা নিরাপত্তার অভাববোধ করছেন। আরও বলা হয়, বালু উত্তোলন স্থানের ছড়া ভাঙ্গনের ফলে পরিবেশ ও চা সেকশন সমুহে মারাত্মক ভুমিধ্বস দেখা দিয়েছে। এছাড়া সরকারের চা বোর্ড কর্তৃক গৃহীত চা শিল্পের উন্নয়ন ও পথনকশা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সনের ১৮ জুন প্রজ্ঞাপন দ্বারা মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত ৫১টি পাহাড়ি ছড়া সিলিকাবালু সম্পৃক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে ১৯ টি-কে অযান্ত্রিক পদ্ধতিতে বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা প্রদান করা হয়। ইজারা গ্রহীতাদের অনিয়ন্ত্রিত ও বেআইনীভাবে বালু উত্তোলনের ফলে কমলগঞ্জসহ জেলার সংশ্লিষ্ট এলাকা সমূহের পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিপর্যয় ঘটছে।
এব্যাপারে ২০১৬ সনের ৮ মার্চ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) জনস্বার্থে রীট পিটিশন (নং-২৯৪৮/২০১৬) দায়ের করে। শুনানি শেষে ২১ মার্চ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ১৯টি বালুমহালকে পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ (ইআইএ) ও পরিবেশগত ছাড়পত্র (ইসিসি) ছাড়া পরবর্তী ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেন। সেই সাথে ইজারাভুক্ত ছড়াসমূহ থেকে সকল প্রকার ড্রিল, ড্রেজার, বোমা মেশিন এবং বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত যান্ত্রিক মেশিনসমূহ জব্দ করার জন্য আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন।
জানা গেছে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই প্রশাসনের নাকের ডগায় স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ছড়া থেকে সরকারি ইজারা ছাড়া অবৈধভাবে বালু উত্তলন করে বিক্রি করছে। এ যেন দেখার কেউ নেই। বনবিভাগের লোকজনও ভয়ে প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছে না। স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, মাঝে মধ্যে প্রশাসনের লোকেরা লোক দেখানো অভিযান করলেও এর স্থায়ী কোন সমাধান হচ্ছে না।
প্রশাসনের লোকেরা আসার আগেই বালু উত্তলনকারী চক্র পালিয়ে যায়। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে অন্যদিকে পরিবেশর মারাত্বক ক্ষতি হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমলগঞ্জের আলীনগর ইউনিয়নের কয়েকজন বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, সুনছড়া থেকে ইজারা ছাড়া অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রতিদিন এখান থেকে ২০-২৫ হাজার টাকার সিলিকা বালু উত্তলন করে বিক্রি করা হয়। এ বালুর বাজার মূল্য অনেক বেশি। এভাবে বালু উত্তোলনের কারণে পরিবেশ ও রাস্তার অনেক ক্ষতি হচ্ছে। বালু উত্তলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনসহ স্থানীয়রাও নিরব ভূমিকা পালন করছে।
আলীনগর চা বাগান ব্যবস্থাপক হাবিব আহমেদ চৌধুরী বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বিষয়ে ইতিপূর্বে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করা হলেও কার্যকর কোন ব্যবস্থধা গ্রহণ করা হয়নি। এ ব্যাপারে চা বাগানের পক্ষ থেকে মৌলভীবাজার আদালতে মামলাও চলমান আছে। এ চক্রে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকায় কার্যকরী পদক্ষেগ গ্রহণ না হওয়ায় চা বাগানের রাস্তাঘাটসহ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে এবং আমরাও আতঙ্কগ্রস্ত।
পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলা এর সিলেট বিভাগীয় সমম্বয়ক এড. শাহ সাহেদা বলেন, আদালতের রায়কে অমান্য করে বালু উত্তোলনের বিষয়টি আদালত অবমাননার শামিল। অধিকাংশ ছড়া চা বাগানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। ২০২৩ সালের বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী চা শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার জন্য চা বাগানের ভেতরে বালুমহাল লীজ দেয়া যায় না।
কমলগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) রইছ আল রেজুয়ান বলেন, সুনছড়া ও কামারছড়ায় কোন ইজারা হয়নি। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অবৈধ বালু উত্তোলন বিষয়ে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জয়নাল আবেদীন জানান, ইতিপূর্বে অভিযান করে জরিমানাও করা হয়েছে। সরেজমিন তদন্তক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।