বিশ্বব্যাপী লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাত বিভিন্ন ধরনের ধাতব ও ইলেকট্রনিক পণ্যের একটি বিস্তৃত পরিসর নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে রয়েছে সাইকেল ও মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ, কৃষি যন্ত্রপাতি, নির্মাণ সামগ্রী, বৈদ্যুতিক তার, ব্যাটারি, স্যানিটারি ফিটিংস, ডাই ও মোল্ড এবং হালকা যন্ত্রপাতি। বর্তমান বাজার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে এই পণ্যগুলোর চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে।
বাংলাদেশের জন্য লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প অর্থনৈতিক রূপান্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ। এই খাতের গুরুত্ব তিনটি মূল দিকে প্রতিফলিত: ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি যা আমাদের জনসংখ্যার সুবিধা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উন্নয়নে অনুঘটক ভূমিকা যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে, এবং স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহারের প্রসার যা আমদানি নির্ভরতা কমায় এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে।
তীব্র প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারে সফলতার জন্য গুণগত মানের প্রতি আপসহীন অঙ্গীকার অপরিহার্য। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সার্টিফিকেশন যেমন ISO এবং CE মার্কের সাথে সামঞ্জস্যতা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি পরিবর্তনশীল বাজারের চাহিদা মেটাতে পণ্যের বৈচিত্র্য এবং ক্রমাগত উদ্ভাবনের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
গবেষণা ও উন্নয়নে কৌশলগত বিনিয়োগ টেকসই প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার ভিত্তি তৈরি করে। এই বিনিয়োগ শুধুমাত্র নতুন পণ্য উন্নয়নের জন্য নয়, বরং বিদ্যমান পণ্যের ক্রমাগত উন্নতির জন্যও অপরিহার্য যা বাজারের প্রাসঙ্গিকতা এবং প্রিমিয়াম অবস্থান বজায় রাখতে সাহায্য করে।
লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে দক্ষতার ঘাটতি তাৎক্ষণিক এবং ব্যাপক মনোযোগ দাবি করে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একীভূত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং কর্মক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন দক্ষ প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ এবং কারিগরি কর্মীর ঘাটতি পূরণ করবে।
প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার জন্য একটি মৌলিক প্রয়োজন। উন্নত যন্ত্রপাতি, স্বয়ংক্রিয়করণ ব্যবস্থা এবং রোবোটিক্সের একীকরণ একসাথে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং উৎপাদন খরচ কমাবে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে একটি টেকসই প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা তৈরি করবে। ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ, যার মধ্যে রয়েছে IoT ইন্টিগ্রেশন এবং স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং সিস্টেম, বাংলাদেশের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতকে বৈশ্বিক উৎপাদন প্রবণতার অগ্রভাগে অবস্থান করাবে।
সফল আন্তর্জাতিক সম্প্রসারণের ভিত্তি হচ্ছে ব্যাপক বাজার গবেষণা। কোম্পানিগুলোকে টার্গেট মার্কেটের চাহিদার প্যাটার্ন ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সম্পর্কে গভীর ধারণা অর্জন করতে হবে। এই ধারণা পণ্যের কাস্টমাইজেশন এবং বাজার প্রবেশের কৌশল নির্ধারণ করবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা এবং রোডশোতে সক্রিয় অংশগ্রহণ পণ্য এবং ব্র্যান্ড পরিচিতি বাড়াবে। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তির (PTA) কৌশলগত সদ্ব্যবহার শুল্ক বাধা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে এবং বাজার প্রবেশাধিকার সুবিধা প্রদান করতে পারে।
কৌশলগত নীতি সহায়তা এবং আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে সরকারি হস্তক্ষেপ খাত উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসেবে কাজ করে। অত্যাবশ্যকীয় নীতি পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে রপ্তানি ভর্তুকি, রিয়াতি ঋণ সুবিধা, কর অবকাশ এবং অবকাঠামো উন্নয়ন সহায়তা। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (SEZ) মধ্যে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং এর জন্য বিশেষায়িত জোন স্থাপন একটি কেন্দ্রীভূত বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করতে পারে যা দেশীয় এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে এবং শিল্প ক্লাস্টারিং সুবিধা প্রদান করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ ফান্ড থেকে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সুবিধা এই খাতের নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। এই প্রণোদনা কর্মসূচি বিশেষভাবে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে নতুন পরিকল্পনাকারীদের জন্য ডিজাইন করা যেতে পারে, যা তাদের প্রাথমিক পুঁজি গঠন এবং প্রযুক্তি অধিগ্রহণে সহায়তা প্রদান করবে। এই ধরনের লক্ষ্যভিত্তিক আর্থিক সহায়তা শুধুমাত্র নতুন উদ্যোক্তাদের বাজারে প্রবেশের বাধা কমাবে না, বরং দেশের সামগ্রিক শিল্প ভিত্তি সম্প্রসারণে অবদান রাখবে এবং এই খাতে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করবে।
বাংলাদেশের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক বাজার অবস্থান প্রতিষ্ঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সফলতার জন্য প্রয়োজন দূরদর্শী সরকারি নীতি, সাহসী উদ্যোক্তা বিনিয়োগ এবং আমাদের দেশের পরিশ্রমী ও দক্ষ কর্মীবাহিনীর সমন্বয়। এই খাতের উন্নয়ন শুধুমাত্র রপ্তানি বহুমুখীকরণের উদ্দেশ্য অর্জন করবে না, বরং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের একটি উন্নত এবং সমৃদ্ধ জাতিতে রূপান্তরেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। এই কৌশলগত অবস্থান জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং উৎপাদন শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক মূল্য সৃষ্টি করে।
সাকিফ শামীম
ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার
ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ