গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত তাইওয়ানকে নিজেদের অবিচ্ছিন্ন অংশ বলে দাবি করে চীন। যদিও নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখে তাইওয়ান। বেইজিংয়ের আপত্তি সত্ত্বেও বিগত ২৫ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দ্বীপিটতে সফর শুরু করেছেন ন্যান্সি পেলোসি। এতে অঞ্চলটিতে উত্তেজনা পারদ চরমে ওঠেছে। চীনের কড়া হুঁশিয়ারির পরও তাইওয়ানে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। পেলোসির সফর ঘিরে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। তাইওয়ানের পূর্বাঞ্চলের জলসীমায় একটি যুদ্ধবিমানবাহী রণতরিসহ চারটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে চীন। আকাশে চক্কর দিয়েছে চীনা যুদ্ধবিমান।
গত ২৫ বছরের মধ্যে তাইওয়ান সফর করা সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ মার্কিন রাজনীতিবিদ পেলোসি। তবে তাঁর এই সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সমর্থন দেননি।
রাশিয়া ও চীন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে বলেছে, পেলোসির সফর উসকানিমূলক এবং তা এ অঞ্চলের জন্য অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের তীব্র নিন্দা করেছে এবং একে এক চীন নীতির গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তারা বলেছে, এই সফর চীন-মার্কিন সম্পর্কের রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ পেলোসির : যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের সফররত স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। গতকাল বুধবার স্থানীয় সময় সকালে তাইপের প্রেসিডেন্ট প্যালেসে তাদের মধ্যে হওয়া বৈঠকটি গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
বৈঠকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকারকে বিশেষ গ্রান্ড কর্ডনসহ হালকা নীল রঙের একটি উত্তরীয় পরিয়ে দিয়ে ‘অর্ডার অব প্রপেশাস ক্লাউডস’ সম্মাননা দেওয়া হয়। এরপর উভয় নেতা পরস্পরের প্রতি মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানান। তাইওয়ানের প্রতি ‘অটল সমর্থন’ ও মনোযোগ দিয়ে যাওয়ার কারণে পেলোসিকে গভীরভাবে ধন্যবাদ জানান প্রেসিডেন্ট সাই। “তাইওয়ানের সঙ্গে স্পিকার পেলোসির দীর্ঘ এবং গভীর মিত্রতা বিদ্যমান। আমি অবশ্যই আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ম্যাডাম স্পিকার,” বলেন তিনি। পেলোসিকে তাইওয়ানের ‘সবচেয়ে অনুরক্ত বন্ধুদের একজন’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। এরপর ইউক্রেইনে রাশিয়ার আক্রমণের উল্লেখ করে বলেন, এই আক্রমণের কারণে তাইওয়ান প্রণালীর নিরাপত্তার বিষয়টিও বিশ্ববাসীর মনোযোগ কেড়েছে। “গণতান্ত্রিক তাইওয়ানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন পুরো ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলবে,” বলেন তিনি।
“তাইওয়ান পিছপা হবে না। আমরা আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব দৃঢ়ভাবে ধরে রাখবো এবং আমাদের বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য প্রতিরক্ষার লাইনটি ধরে রাখা চালিয়ে যাব,” যোগ করেন তিনি। বিবিসি জানিয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অনেক গণতান্ত্রিক দেশের নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে দৃঢ় ভূমিকা পালন করে আসছে। ওই অঞ্চলের গণতন্ত্রের জন্য ‘প্রতিরক্ষার এই লাইনটি’ ধরে রাখার কথা বলেছেন সাই। জবাবে পেলোসি বলেন, ‘সম মূল্যবোধের’ ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ান ‘সমৃদ্ধ অংশীদারিত্ব’ গড়ে তুলেছে। তাইওয়ানকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা ঐক্যবদ্ধ বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “আমরা তাইওয়ানে এসেছি এটি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিতে যে আমরা তাইওয়ানের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার থেকে সরে আসবো না এবং আমাদের স্থায়ী বন্ধুত্ব নিয়ে আমরা গর্বিত। তাইওয়ানের সঙ্গে আমেরিকার সংহতি এখন যে কোনো সময়ের চেয়েই বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর আজ আমরা এখানে এই বার্তাই নিয়ে এসেছি।”
প্রেসিডেন্ট সাইয়ের সঙ্গে এ বৈঠকের আগে পেলোসি তাইওয়ানের পার্লামেন্ট পরিদর্শন করেন। সফরের পরবর্তী অংশে পেলোসি তাইওয়ানের মানবাধিকার আন্দোলনকারী ও ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন এবং বিকালে তাইওয়ান ছাড়বেন। চীনের হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করে মঙ্গলবার রাতে তাইওয়ানে পা রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার পেলোসি। ২৫ বছরের মধ্যে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের কোনও স্পিকার এই প্রথম তাইওয়ানে গেলেন, যে দ্বীপটিকে চীন নিজেদের অংশ বলেই দাবি করে।
চীন ক্ষিপ্তভাবে পেলোসির এ সফরের নিন্দা জানিয়েছে। এশিয়ার সফরে পেলোসি তাইওয়ানে যাবেন, এমন খবর ফাঁস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেইজিং হুঁশিয়ার করে বলেছিল, ওয়াশিংটন ‘আগুন নিয়ে খেলছে’।
তাইওয়ানে পেলোসির সফরের প্রতিক্রিয়ায় দ্বীপটির আশপাশের জলসীমায় সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে চীন। পাশাপাশি বেইজিংয়ে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠিয়েছে এবং তাইওয়ান থেকে বিভিন্ন কৃষিপণ্য আমদানি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার থেকে তাইওয়ানের চারপাশের সাগরে তিন দিনের সামরিক মহড়া শুরু করার ঘোষণাও দিয়েছে বেইজিং। চীনের পরিকল্পিত এই সামরিক মহড়ার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে তাইওয়ান। এ ধরনের মহড়া ‘তাইওয়ানের অন্তর্ভুক্ত স্থানগুলো আক্রমণের’ এবং তাইওয়ানের ‘আকাশ ও সমুদ্রসীমা অবরোধের শামিল’ বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে স্বশাসিত দ্বীপটির সামরিক বাহিনী।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব : হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের প্রতিবাদে বেইজিং-এ নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকোলাস বার্নসকে তলব করেছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত মঙ্গলবার রাতে পেলোসি তাইপে অবতরণের পরই ব্যাপক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে বেইজিং। এরই অংশ হিসেবে নিকোলাসকে তলব করা হয়েছে।
তাইওয়ানের পণ্য নিষিদ্ধ : পেলোসির এ সফর ঘিরে আগে থেকেই কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছিল চীন। গতকাল বুধবার সকালে তাইওয়ান থেকে লেবুজাতীয় ফল ও দুই ধরনের মাছ আমদানি তাৎক্ষণিক নিষিদ্ধ করে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে দ্বীপটিতে বালু রপ্তানিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার বিস্কুট, কনফেকশনারিসহ অন্যান্য পণ্যেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল বেইজিং।
চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের গভীর বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। তাইওয়ানের রপ্তানির প্রায় ৩০ শতাংশই চীনে হয়ে থাকে। তাইপের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হলো বেইজিং।
এর আগে গতকাল রাতে নির্ধারিত সময়ের কিছুটা আগেই তাইপে পৌঁছান পেলোসি। স্থানীয় সময় রাত ১০টা ৪৪ মিনিটে তাঁর উড়োজাহাজ তাইপের মাটি স্পর্শ করে।
পেলোসির এই সফরে চটেছে চীন। প্রতিবাদ জানাতে বেইজিংয়ে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকোলাস বার্নসকে তলব করেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
চীনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী শিয়ে ফেং বলেন, পেলোসির এ সফর ‘অসদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। কঠিন পরিণতির হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, চীন অলস বসে থাকবে না।পেলোসির সফর ঘিরে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। তাইওয়ানের পূর্বাঞ্চলের জলসীমায় যুদ্ধবিমানবাহী একটি রণতরিসহ চারটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে চীন। আকাশে চক্কর দিয়েছে চীনা যুদ্ধবিমান।
গত ২৫ বছরের মধ্যে তাইওয়ান সফর করা সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ মার্কিন রাজনীতিবিদ পেলোসি। তবে তাঁর এ সফরে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সমর্থন দেননি।
তাইওয়ানকে নিজের ভূখণ্ড মনে করে বেইজিং। কিন্তু তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই দেখে দেশটির জনগণ। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে তাইওয়ানকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে আসছে।
তাইওয়ানের আকাশ ও সমুদ্রসীমায় সামরিক মহড়া : চীনের কঠোর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও তাইওয়ানে অবস্থান করছেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেইজিং তাইওয়ানের সমুদ্র ও আকাশ সীমায় সামরিক মহড়া শুরু করেছে। শুধু তাই নয় যে কোনো সময় হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তাইওয়ান সরকার চীনের এ পরিকল্পনার নিন্দা জানিয়েছে। দেশটির সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, আকাশ ও সমুদ্রসীমা অবরোধ করা হচ্ছে। তাইওয়ানের অঞ্চলে আগ্রাসন চালানো হচ্ছে।
বিবিসির চীনের সংবাদদাতা স্টিফেন ম্যাকডোনেল রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের প্রকাশিত একটি মানচিত্র টুইট করেছেন। এতে চীনের পরিকল্পিত মহড়ার অবস্থানগুলো দেখা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান ছাড়ার পর আজ বৃহস্পতিবার এবং রোববারের মধ্যে হামলা হতে পারে।
এর আগে, মঙ্গলবার রাতে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, তাইওয়ানের উত্তর, দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তরপূর্বাঞ্চলে যৌথভাবে আকাশ ও সমুদ্রে চীনের মহড়া চলবে। তাইওয়ান প্রণালীতে দীর্ঘ পাল্লার ‘লাইভ ফায়ারিং’ করা হবে।
সতর্কতার মাত্রা বাড়াল তাইওয়ানের সেনাবাহিনী : তাইওয়ানের সেনাবাহিনী নিজেদের সতর্কতার মাত্রা বাড়িয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ স্বশাসিত দ্বীপটির চারপাশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে পরিকল্পনা করছে বলে জানিয়েছে তাইওয়ানের মন্ত্রিসভা। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইপে সফরের প্রতিক্রিয়ায় তাইওয়ানের কাছে চীনের একের পর সামরিক মহড়ার ঘোষণা আসার পর বুধবার এসব পদক্ষেপ নিয়েছে তারা, জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। তাইওয়ানের মন্ত্রিসভা আরও বলেছে, একটি জাতীয় স্থিতিশীলতা তহবিল স্টক মার্কেটের পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছে এবং দরপতন হলে হস্তক্ষেপ করবে, তাই নাগরিকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।
-বাবু/শোভা