ফুটবলে অনেকেই নাম করেছেন। কালজয়ী ফুটবলারেরও লম্বা তালিকা আছে। পেলে এবং তাঁকে মুগ্ধ করা অনেক তারকা মাতিয়েছেন ফুটবল মাঠ। লিওনেল মেসিকে ফুটবলের বিখ্যাত ম্যাগাজিনে সর্বকালের সেরার মর্যাদাও দিয়েছে; কিন্তু ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা সব কিছুর ঊর্ধ্বে।
আক্ষরিক অর্থে আজ তাঁর সব কিছুর ঊর্ধ্বে চলে যাওয়ার দ্বিতীয় বার্ষিকী; কিন্তু না থেকেও যেন আরো প্রবলভাবে কাতার বিশ্বকাপে আছেন ম্যারাডোনা, ফুটবলভক্তদের মনজুড়ে। এই উপস্থিতি অমরত্বের স্মারক। অমরত্বের এই মর্যাদায় একজন ডিয়াগো ম্যারাডোনা সত্যি সত্যিই ধরাছোঁয়ার বাইরে।
২০১৬ সালে ম্যারাডোনা জীবিত। খেলা ছেড়েছেন বেশ আগে। যতদূর মনে পড়ে, কোচিংয়েও তিনি নেই তখন। তবু বুয়েনস এইরেসে বোকা জুনিয়র্সের প্রবেশপথে বেঞ্চে আসীন ব্রোঞ্জের মূর্তির ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসিতে ম্যারাডোনা বসে। সেই হাসির অর্থ বহুমুখী। দুই পাশে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকা রিকুয়েলমে, তেভেজ, পালের্মোদের অভিভাবক তিনি? নাকি বোকার ফুটবলারকুলের শিরোমণির অহংকার ঠিকরে পড়ছে হাসিতে? তবে সেই বেঞ্চের সামনে-পেছনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা ব্রাজিল, বতসোয়ানা কিংবা বাংলাদেশি পর্যটকের কাছে ম্যারাডোনার ধাতব হাসির মানে একটাই—আমি দেখছি, তোমরা খেলে যাও! বোকার মাঠের একটি বক্স ম্যারাডোনার জন্য বরাদ্দ। যেকোনো টিভি দর্শকই আন্দাজ করতে পারেন, ম্যাচ-ডেতে সেই বক্স কতটা সরগরম করে রাখতেন ম্যারাডোনা।
একই বছর সাও পাওলোর বিখ্যাত ফুটবল মিউজিয়াম দেখা হয়েছে। রিও ডি জেনেইরোর কুখ্যাত বস্তি রোচিনহার পথে-দেয়ালে হাজারটা গ্রাফিতিতে ব্রাজিলীয় ফুটবলের বীরত্বগাথা দেখেছি। অবধারিতভাবে পেলে শিল্পীর তুলিতে আছেন। তবে ব্রাজিল ঘুরে মনে হয়েছে, স্থানীয়দের ফুটবল-প্রার্থনায় পেলের সঙ্গে গ্যারিঞ্চার নামও উচ্চারিত হয়। নেইমার নিয়ে এ প্রজন্মের হুল্লোড় দেখে ব্রাজিলের প্রবীণরা মুচকি হাসতেন। পেলে-গ্যারিঞ্চা দূরের কথা, ‘দ্য ফেনমেনন’ রোনালদো কিংবা রোনালদিনহোর চেয়েও নেইমার পিছিয়ে প্রবীণ ব্রাজিলিয়ানদের কাছে। তেমনি বুয়েনস এইরেস থেকে মেসির শহর রোজারিও—আর্জেন্টিনার সব শহরে একচ্ছত্র আধিপত্য ম্যারাডোনার। জীবিত তো বটেই, ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর আচমকা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ম্যারাডোনার তুলনা শুধু তিনি নিজে।
মনে পড়ে না ব্রাজিল ম্যাচে গ্যালারিতে পেলের কোনো পোস্টার কিংবা ব্যান্ডানা দেখা গেছে। আর্জেন্টিনার সব ম্যাচে ম্যারাডোনা থাকেন। অবসরে যাওয়ার পর বক্সে, পরলোকের ম্যারাডোনা জায়গা করে নিয়েছেন ২২ নভেম্বরও ভক্তের জার্সিতে, উল্কিতে। মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচের দিন গ্যালারিতে ম্যারাডোনার ব্যবহৃত একটি জার্সি গায়ে কিংবদন্তিকে স্মরণ করেন হাভিয়ের মালুফ। ১৯৮০ সালে ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই জার্সি গায়ে খেলেছিলেন ম্যারাডোনা। ফুটবল স্মারক সংগ্রহে খ্যাতনামা মালুফের সংগ্রহে ১৯৭৮ বিশ্বকাপে মারিও কেম্পেসের একটি জার্সিও আছে। তবে ম্যারাডোনার যেকোনো স্মারক তাঁর কাছে অনন্য কারণ, ‘আমরা সবাই তাঁর (ম্যারাডোনা) সম্পর্কে জানি। আমরা জানি, ফুটবল খেলাটার ওপর কী অসীম প্রভাব রেখে গেছেন তিনি। ’
অবিশ্বাস্য সেই প্রভাব। তিন বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড গড়ার পথে দুর্দান্ত সব ফুটবলারকে পাশে পেয়েছিলেন পেলে; কিন্তু ১৯৮৬ বিশ্বকাপ মানেই ম্যারাডোনা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করেছেন তিনি ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ উপহার দিয়ে। নিশ্চিত থাকুন, পদার্থবিদ্যাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ছয় ইংরেজকে কাটিয়ে ম্যারাডোনা যদি দ্বিতীয় গোলটি না করতেন, তাহলে ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের মহিমা শেষ হয়ে যেত সেদিনই।
পরের বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনার ফাইনালে ওঠার স্থপতি সেই ম্যারাডোনা। জার্মানির কাছে হারের পর রেফারির পক্ষপাত নিয়ে অশ্রুসিক্ত ম্যারাডোনা কাঁদিয়েছিলেন হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশকে।
ভিনদেশের কোনো শহরে ম্যারাডোনার মতো প্রভাব আর কোনো ফুটবলার রেখে গেছেন বলেও মনে হয় না। ইতালির ছোট্ট শহর নেপলস ম্যারাডোনা ইস্যুতে চট করে আর্জেন্টিনার কোনো শহরে পরিণত হয়ে যায়! কারণ আছে। ইতিহাসে মাত্র দুটি সিরি এ এবং একটি ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছে নাপোলি। তাদের এই তিন সাফল্যেরই কারিগর ম্যারাডোনা। অখ্যাত একটি দলকে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরিয়ে পুরো এস্টাবলিশমেন্টকেই যেন কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। জুভেন্টাস কিংবা দুই মিলানের রাজত্বে নাপোলির অভ্যুত্থান কেউ ভাবেনি, সম্ভবত মেনেও নিতে পারেনি। তাই মিলান কিংবা তুরিনে ম্যাচ থাকলে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হতেন ম্যারাডোনা। সেসবের দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন অবিশ্বাস্য সব সাফল্যের গল্পে।
ম্যারাডোনা ছিলেন, আছেন। যেমনটি আছেন আর্জেন্টাইনদের মানসপটে, লিওনেল মেসিদের সঙ্গেই। শনিবার রাতে লুসাইল স্টেডিয়ামে মেসির দল যখন মেক্সিকোর বিপক্ষে বাঁচা–মরার লড়াইয়ে মাঠে নামবে, তখন ম্যারাডোনা প্রবলভাবেই থাকবেন। কেবল অনুপ্রেরণা হয়ে নয়, তাঁর অস্তিত্ব লড়াইয়ের রসদ হয়েই থাকবে।
সৌদি আরবের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার হারটা অভাবনীয়ই। ম্যাচের আগে পাঁড় আর্জেন্টিনা–বিরোধী ফুটবল দর্শকও ঘুণাক্ষরে ভাবেননি, এমন কিছু ঘটতে পারে। ম্যাচ শুরুর পর আর্জেন্টিনার এগিয়ে যাওয়া, এরপর সেমি অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তির খপ্পড়ে পড়ে তিন–তিনটি গোল বাতিল হওয়া—ম্যাচে আর্জেন্টিনার আধিপত্যই প্রমাণ করছিল।
আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা তো বটেই, বিরোধীরাও মনে করছিলেন, গোলসংখ্যা বাড়াটা কেবল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গোটা দৃশ্যপটই বদলে গেল। খেলার দ্বিতীয় ভাগে মাত্র পাঁচ মিনিটের ঝড় উড়িয়ে দিল আর্জেন্টিনার সবকিছু। সৌদি আরব পেয়ে গেলে ২–১ ব্যবধানের অবিশ্বাস্য এক জয়।
হৃদয়ভাঙা এক হার—আর্জেন্টিনার সৌদি–বিপর্যয়কে বর্ণনা করা যায় এই বাক্য দিয়েই। যে দল টানা ৩৬ ম্যাচে অপরাজিত থেকে আকাশসম আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাতারে এসেছে, যে দল ১৯৮৬ সালের পর আবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে বিভোর, সেই দলই সৌদি আরবের বিপক্ষে এক হারের পরই অনিশ্চয়তার চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে। বিশ্বকাপ দূরের কথা, প্রথম রাউন্ডের বাধা পেরোনোই এখন কঠিন এক পরীক্ষা।
ঠিক এ সময় মেসি, দি মারিয়া, আনহেল কোরেয়া, লাওতারো মার্তিনেজ, ক্রিস্তিয়ান রোমেরো, মার্কোস আকুনিয়া, নিকোলাস তালিয়াফিকোদের পরস্পরের হাত ধরে থাকতে হবে শক্ত করে। আর এই অনিশ্চয়তার চোরাবালি থেকে আর্জেন্টিনা দলকে টেনে তুলতে আরও একটি হাত থাকছেই। সেটি ‘ঈশ্বরের হাত’ নয়, ম্যারাডোনার অপার্থিব হাত। যে দেশের ফুটবলের সঙ্গে ব্যক্তি ম্যারাডোনা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, সেই দেশের ফুটবল অনিশ্চয়তা আর বিপর্যয়ের সময় তাঁর পরম্পরাকে আঁকড়ে ধরবে না, এটা হতেই পারে না।
মেসি তো আরও বেশি করে ম্যারাডোনার দিকে তাকাবেন এ সময়। ১৯৯০ ইতালি বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা নিজেও যে আর্জেন্টিনা দলকে নিয়ে এমন একটা বিন্দুতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ৩২ বছর আগে মিলানের সান সিরোতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসেবে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ খেলতে নেমে আর্জেন্টিনা আচমকা হেরে বসল ক্যামেরুনের কাছে। এবারের সৌদি আরবের বিপক্ষে হারের মতোই—ম্যাচের আগে কেউই ভাবতে পারেননি ম্যারাডোনা, ক্যানিজিয়া, বুরুচাগা, বাতিস্তা, ভালদানোদের আর্জেন্টিনা ক্যামেরুনের মতো অখ্যাত ফুটবল–শক্তির কাছে হেরে যাবে।
কিন্তু সেই ম্যাচ হারার পরও আর্জেন্টিনা পরের রাউন্ডে তো গিয়েছিলই, দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিল, কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোস্লাভিয়া আর সেমিতে ইতালিকে হারিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপার খুব কাছে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জার্মানির বিপক্ষে পেনাল্টি গোলে হেরে তা হয়নি, সে না–ই হতে পারে। কিন্তু ১৯৯০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সেই প্রায় অসম্ভবের পথে যাত্রাটা তো আর হালকা কিছু নয়! সেই সংগ্রামের গল্পটা তো আর ফেলনা নয়, ২০২২ সালে মেসির আর্জেন্টিনা সেই সংগ্রামের গল্পকেই তো কৌশলের রসদ বানাবে। সেই রসদের বিরাট একটা অংশই যে ম্যারাডোনা।
আচ্ছা, ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ম্যারাডোনা যদি দূরলোকের বাসিন্দা না হতেন, তা হলে ম্যারাডোনা নিশ্চয়ই গত ২২ নভেম্বর সৌদি আরবের বিপক্ষে ম্যাচটি গ্যালারিতে হইহই করতে করতেই উপভোগ করতেন!
দল হেরে যাওয়ার পর তাঁর মন খারাপ হতো। তিনি হয়তো আবেগের বশে অনেক কিছুই বলতেন। মেসি–স্কালোনিদের মুণ্ডুপাতও করতেন। সৌদিদের হাইলাইন ডিফেন্সের কৌশলে স্কালোনি কেন ‘ধরা’ খেলেন, কেন আর্জেন্টিনা কোচ সেই কৌশলকে পাশ কাটাতে পাল্টা কিছু দিতে পারলেন না, সেসব বিষয় নিশ্চয়ই সাংবাদিকেরা ম্যারাডোনার কাছে জানতে চাইতেন! ম্যারাডোনাও নিশ্চয়ই মিডিয়াতে ঝড় তোলা সব বক্তব্য রাখতেন। সাংবাদিকেরাও খুব ব্যস্ত সময় কাটাতেন।
মেসি বা স্কালোনি যে ম্যারাডোনাকে ফোন দিতেন না, সেটি কে বলতে পারবে! তখন হয়তো ম্যারাডোনা হয়ে পড়তেন স্নেহশীল। নিজের চোখের দেখা থেকে পরামর্শ দিতের আর্জেন্টিনা থিংক ট্যাংককে। মেক্সিকো বা পোল্যান্ড ম্যাচের আগে আর্জেন্টিনা ম্যারাডোনার শরণাপন্ন হতেই পারত। কিন্তু দুই বছর আগের এক রাত এসবের কিছুই হতে দেয়নি।
১৯৯০ বিশ্বকাপজয়ী জার্মান অধিনায়ক লোথার ম্যাথাউস কিছু দিন আগে এক টুইটে আক্ষেপ করে ম্যারাডোনার স্মৃতি স্মরণ করে লিখেছিলেন, ‘এই প্রথম বিশ্বকাপে তুমি নেই।’ মেসি এমন কিছু লেখেননি, কিন্তু এটা তো তাঁরও মনের কথা। তবে তিনি সৌদি আরব ম্যাচের আগেই বলে দিয়েছিলেন, ‘ম্যারাডোনা আমাদের সঙ্গে সব সময়ই আছেন।’
আগামীকাল রাতে লুসাইলে মেক্সিকো আর্জেন্টিনা দলকে নিয়ে কৌশল সাজাবে। কিন্তু সেটি তো রক্ত–মাংসের আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের শক্তি–দুর্বলতা বিচার করে। কিন্তু তাঁদের অদৃশ্য শক্তি, অদৃশ্য প্রেরণাকে কীভাবে সামাল দেবে মেক্সিকো! ম্যারাডোনার কিংবদন্তি যে আর্জেন্টিনার জন্য বাড়তি কিছু নিয়ে অপেক্ষা করে সব সময়ই। ম্যারাডোনা না থেকেও থাকেন তাদের সঙ্গে। তিনি না থেকেও আর্জেন্টিনা দলের কোচ, অধিনায়ক, ম্যানেজার অনেক কিছুই হয়ে ওঠেন। হয়তো সামনের দিনগুলোতেও হবেন।
রাজনৈতিক বিশ্বাসেও প্রথাবিরোধী ছিলেন ম্যারাডোনা। ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন তাঁর পরম বন্ধু। মেসির শহরের চে গুয়েভারার ভঙ্গিতে চুরুটে টান দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা (ফিফা) কিংবা আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (আফা) শাপশাপান্ত করতেন তিনি। পাপারাজ্জিদের লক্ষ্য করে এয়ার গানের গুলি ছুড়তে বুক কাঁপেনি। তবু মিডিয়া তাঁর পিছু ছাড়েনি। ফিফা কিংবা আফা-ও ম্যারাডোনার ইমেজ ব্যবহারের শত চেষ্টা করে গেছে নিয়ত; কিন্তু আপস তাঁর চরিত্রে নেই। ম্যারাডোনার শুধু আপস করেছিলেন ফুটবলের সঙ্গে। তাঁর সবটাজুড়ে ছিল ফুটবল। আর ফুটবলের অন্তরজুড়ে ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ছিলেন, আছেন এবং থাকবেনও।