বুধবার ২ জুলাই ২০২৫ ১৮ আষাঢ় ১৪৩২
বুধবার ২ জুলাই ২০২৫
ছোট্ট জীবন, বৃহৎ কর্ম, মহৎ মৃত্যু
শায়েখ আরেফিন
প্রকাশ: রবিবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৩, ৪:১০ PM

সদ্যকিশোরী থেকে তরুণী হয়ে ওঠা একটি মেয়ে সারাহ ইসলাম, দুরারোগ্য টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস (Tuberous Sclerosis) রোগে থেমে গেল তাঁর জীবন। বিশ বছরের ছোট্ট জীবন, কিন্তু মহৎ, সুন্দর, গৌরবময় ও বিপ্লবী।

দশ মাস বয়সে সারাহের দুরারোগ্য টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস রোগ শনাক্ত হয়। রোগটি সচরাচর দেখা যায় না। আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের বাইরে ও ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে টিউমার তৈরি হতে থাকে। রোগটির সাথে বিশ বছর ধরে লড়াই করছিলেন তিনি। যন্ত্রণাদায়ক এ রোগের মৃত্যুই পরিনতি, জানতেন সারাহ। তবুও থামার আগে জীবনকে থামতে দেননি। সমবয়সী অনেক শিশু তাঁর মুখের টিউমার দেখে ভয় পেত, তার পাশে বসতে চাইত না। সেই বন্ধুর পথে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন। ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রিয় বিষয় ফাইন আর্টসে পড়ছিলেন।

পরিবার সূত্রে জানা যায় ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন ও নারী নিরাপত্তা রক্ষা আন্দোলনে থাকতেন রাজপথে, একটি দৈনিক পত্রিকার সাথে যুক্ত থেকে করেছেন স্বেচ্ছাসেবীর কাজও। পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী ও পরিচিতদের প্রতি তাঁর ত্যাগের টুকরো টুকরো গল্প তো আছেই। সারাহর সবচেয়ে বড় অবদান যা বাংলাদেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে বিরল। মরণোত্তর দেহের সব কার্যকর অঙ্গ দানের ইচ্ছে জানিয়ে গেছেন পরিবারকে। মৃত্যুর পর তাঁর দুটো কিডনি ও দুটো কর্নিয়া সংগ্রহ করা সম্ভবপর হয়েছে। তাঁর দান করা কিডনিতে একটি মাইলফলক সৃষ্টি হয়েছে দেশে প্রথমবারের মতো মৃত ব্যক্তির দান করা কিডনি প্রতিস্থাপন করা হলো অন্য ব্যক্তির দেহে।

আশৈশব দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে বড় হয়েছেন সারাহ। অতিসংক্ষিপ্ত জীবনে পৃথিবীকে উপভোগ করার সুযোগ তাঁর হয়নি। জন্ম থেকে বয়ে চলা রোগটি তাঁকে প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দিয়েছে। সারাহর মা জানিয়েছেন, শিক্ষালয়ে সহপাঠীরা তাঁর সাথে মিশতে চাইতো না, এ নিয়ে সারাহ কান্না করতেন। আর সামাজিক নিগ্রহ, অবজ্ঞা, পীড়নের ঘটনা আরও মর্মান্তিক। তাই সমাজ ও মানুষের প্রতি সারাহর অনুভব, উপলব্ধি ও দায়বদ্ধতাবোধ অন্যদের চেয়ে কমই হতে পারতো। কিন্তু মহাত্মা সারাহর বোধ যেন আরও বেশি। মরণোত্তর অঙ্গদান করে তিনি সমাজকে দিয়ে গেছেন তীব্র শিক্ষা, নিয়েছেন মর্মভেদী প্রতিশোধ। তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে গেছে, কিন্তু জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন চারজন মানুষের জীবনপ্রদীপ, পথ দেখিয়ে গেলেন অগণিত মানুষকে। আর দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে দিয়ে গেলেন সঞ্জীবনী শক্তি।

মহৎপ্রাণ সারাহের মধ্যে পাওয়া যায় এক বিপ্লবীপ্রাণ সারাহকেও। মুসলমান পরিবারে জন্ম তাঁর। প্রথা, ধর্মীয় বিধিনিষেধ ও সামাজিক কুসংস্কারের বাধা ডিঙিয়ে মরণোত্তর দেহদান বিরাট এক বৈপ্লবিক কাজ। সব বাধা পেরুনোর শক্তি তিনি অর্জন করেছিলেন এই স্বল্প দৈর্ঘ্যের জীবনে! তাঁর দুটো কিডনি ও দুটো কর্নিয়া প্রতিস্থাপিত হয়েছে চারজন মানুষের দেহে। সারাহ ইসলাম তাদের মৃত্যুকে বিলম্বিত করলেন। নিয়তি যাদের অন্ধ করেছিলেন, সারাহ ইসলাম তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছেন। সারাহর কর্নিয়ায় দৃষ্টি ফিরে পেয়ে গ্রহীতা আজ হয়তো পাঠ করছেন তার ধর্মশাস্ত্র যেখানে ‘দেখতে পাচ্ছেন’ মরণোত্তর অঙ্গদান ধর্মবিরুদ্ধ। কী পরিহাস! গ্রহীতা এখন কী করবেন?

সারাহ ইসলামের দেওয়া পুরস্কারের চেয়ে মহৎ পুরস্কার আর কী আছে পৃথিবীতে? যুগযুগ ধরে সারাহর মতো মহৎপ্রাণ মানুষেরা মানবতার জয়গান গেয়েছেন, মানবকল্যাণে উৎসর্গ করেছেন নিজেকে, দিয়ে গেছেন মহত্ত্বের শিক্ষা; এবং জিঘাংসা ও প্রতিহিংসা দিয়ে নয়, উদারতা ও মানবতাবাদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মহত্তম উপায়ে নিয়েছেন বিরুদ্ধাচরণের প্রতিশোধ। মানবকল্যাণে সারাহর ত্যাগ অবিনশ্বর হয়ে থাকবে। ছোট্ট জীবন, বৃহৎ চিত্ত, অক্ষয় প্রাণের অধিকারী সারাহ ইসলামকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় প্রণতি জানাতে চাই ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’

লেখক : সমালোচক ও বিশ্লেষক

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত