বুধবার ২ জুলাই ২০২৫ ১৮ আষাঢ় ১৪৩২
বুধবার ২ জুলাই ২০২৫
সত্য অন্বেষণ করাই মানবিক কর্তব্য
রিয়াজ মাহমুদ
প্রকাশ: রবিবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৩, ৪:১৭ PM আপডেট: ২৫.০১.২০২৩ ৪:০৫ PM

কবিতা লিখতে পারার যোগ্যতা কী? কিংবা কোন পেশায় থাকলে শিল্প-সাহিত্য চর্চা করা যাবে? এই সমস্ত প্রশ্নের যথোপযুক্ত জবাব পাওয়া মুশকিল। একাডেমিক যোগ্যতা দিয়ে কবিতা বা সাহিত্যের উচ্চমান নির্ধারিত হয় না। অন্যদিকে কে কোন পেশায় নিয়োজিত সে বিবেচনায় ও সাহিত্যমান বিবেচনা করা বোকামি।

রবি ঠাকুর পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি দেখাশুনা করতেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর আয়ের একটা বড় অংশ উপার্জিত হত ইউরোপে বক্তৃতার সম্মানী থেকে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সরকারি আমলা ছিলেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিছু কাল রেলওয়ের অডিট পদে চাকরি করেছিলেন। তার পরবর্তীতে তিনি বার্মার পাবলিক অ্যাক্যাউন্টস অফিসে চাকরি করেছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছিলেন। জীবনান্দদাশ কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতার পত্রিকা অফিসে কাজ করেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম তো বাহারি রকম কাজে যুক্ত ছিলেন। প্রথম যৌবনে সৈনিক, পরবর্তীতে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। একবার নির্বাচন কওে বিপুল ভোটে হেরেছেন। ফলে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। হুমায়ন আজাদ ও হুমায়ন আহমেদ উভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। বাঙালির মনস্তত্বে কে বা কারা এক অযাচিত চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ফলে তারা এখন সাহিত্য না পড়ে, সাহিত্যের শিল্পমান যাচাই না করে, পেশায় নিযুক্ত থাকা বা না থাকার ওপর নির্ভর করেসাহিত্যিককে মূল্যায়ন করেন। অনেকের আক্রোশ দেখে চক্ষু-চড়ক গাছ। হর- হামেশাই বলে বেড়াচ্ছে চাকরি করে কবি হওয়ার শখ জেগেছে!

বাংলাদেশিদের জনমানসে আরেকটি ভুল চিন্তা শক্ত আসন গেড়েছে। ছাত্রজীবনে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, মালিকি রাষ্ট্র খতম করতে চেয়েছে। এখন নিজেই কোম্পানিতে চাকরি করছে। দিন শেষে সবারই এখানে আসতে হয়! কিংবা সারাজীবন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছে এখন আমেরিকায় পাড়ি জমায়। কেউ কেউ তো স্বাভাবিকতার ঊর্ধ্বে উঠে বলতে থাকে কৃষক-শ্রমিকের রাজনীতি করে নিজে স্যুট-বুট পরে চলাচল করেন। বিষয়গুলো জঘন্য রকমের অপপ্রচার। যা সীমানা অতিক্রম করেছে। ফলে জনসাধারণ এই সমস্ত অপপ্রচারের বিভ্রান্ত হচ্ছে। বাস্তবে বিষয়গুলোর গভীরতা আঁচ না করেই কিংবা পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিতে অপপ্রচার চালাচ্ছে কিছু মহল।

ইতিহাস আমাদের জানিয়ে দেয়, সমাজ বিকাশের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় আজ তা পুঁজিবাদী সমাজে উপনীত হয়েছে। সামন্তীয় সমাজের অভ্যন্তরেই  গোড়াপত্তন হয় পুঁজিবাদী সমাজের। সামন্তীয় রাজারা ঘোষণা করেছিল তারা ঈশ্বরের প্রতিনিধি। ফলে তারা যা করবে তাই বৈধ। যুক্তিবাদী মনন ধ্বংস করার, অবৈধ কাজের বৈধতা দেওয়ার মোক্ষম হাতিয়ার খুব সহজেই হাতে তুলে নেয় সামন্তীয় রাজারা। সমাজ যুক্তি ও বিবেচনাহীন হয়ে গেলে সমাজে বৈষম্য তৈরি হয়, ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ ও একতা বিনষ্ট হয়।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, সামন্তীয় সমাজ ভাঙার লড়াইটা শুরু হয়েছিল সমান্তীয় সমাজের অভ্যন্তরে। সমান্তীয় সমাজ থেকে পালিয়ে গিয়ে সে সমাজ ভাঙার লড়াই শুরু হয়নি এবং তা সম্ভবও ছিল না। কিংবা তারও পূর্বে দাসপ্রথা ভাঙার লড়াইটা দাসদেরকেই করতে হয়েছে। স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাসদের বিদ্রোহের ইতিহাস দুনিয়ার দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটাও এই সমাজের অভ্যন্তর থেকেই শুরু করতে হবে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা সিনেমার নায়কদের মত ছুৎমার্গ দিয়ে করা সম্ভব নয়। অব্যাহত ধারাবাহিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ইতিহাস পাল্টে দিতে হবে। ফলে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সম্ভারের আয়োজন নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করাটা দোষের নয়। আবার কোনো পেশায় যুক্ত হলেই লড়াই থেমে যাবে সেটাও সঠিক নয়।  অন্যদিকে পুঁজিবাদ যেহেতু একটা বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থা। ফলে এই ব্যবস্থার পরিচালনা পদ্ধতি, শোষণের ধরন ও প্রক্রিয়া সর্ম্পকে সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরি।

মার্কসীয় দর্শনের অন্যতম কাণ্ডারী ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস কারখানায় কাজ করার সুবাধে শ্রমিকদের অবস্থা সূক্ষ্মভাবে প্রত্যক্ষ করেন, বই লিখে পেলেন ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা’। পুঁজিবাদের নৃশংস পরিণতি বুঝার জন্য এই বই এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। পুঁজিবাদ যেহেতু একটি উৎপাদন-বিলি-বণ্টন ব্যবস্থা, সেহেতু লড়াইটা বিলি-বণ্টনের সমতা নিয়ে। ফলে পুঁজিবাদি সমাজ থেকে পালিয়ে গিয়ে তাকে ভাঙা বাস্তবসম্মত নয়। সহজ করে বললে পালিয়ে যাবে কোথায়! তাছাড়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণের  কলাকৌশলের ব্যবহারিক প্রয়োগ জানা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। জীবিকার্জনের পাশাপাশি শোষণের হাল হাতিয়ারের বিষয়ে তীব্র সচেতন হয়ে উঠে পরিবর্তনকামী যোদ্ধারা। বিপ্লব করার জন্য দক্ষ মানুষ যেমনি দরকার; তেমনি বিপ্লব পরবর্তীতে নতুন সমাজ গড়ে তোলার জন্য একদল দক্ষ লোকের দরকার হবে যারা প্রশাসন পরিচালনা করবে, আইন-আদালতের কার্যক্রম সচল রাখতে ভূমিকা রাখবে।

সমাজের শ্রেণিবৈষম্য বিলোপ করার জন্য লড়াই করার অর্থ এই নয় তাকেও গরিব মানুষ হয়ে যেতে হবে। সমাজের গরিবি অবস্থার উচ্ছেদের লড়াইয়ের জন্য নিজেকে গরিব হতে হবে? এটা কোনো যৌক্তিক কথা নয়। অথাৎ রোগীর অসুখ সারাতে হলে ডাক্তারকে আগে রোগী হতে হবে। অন্যথায় অসুখ সারানো যাবে না? এটা কোনো যৌক্তিক কথা হতে পারে না।বাংলাদেশিদের মনোস্তত্ত্বে অহরহ এই আলোচনাই চলছে সর্বহারার রাজনীতি করলে গাড়িতে চড়া যাবে না। সুন্দর পোশাক পরা যাবে না ইত্যাদি। মানুষের মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত রাখাটা গৌরবের। তার অর্থ এই নয় নিজেকেই আগে বন্দি করতে হবে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে উঠে। আন্দোলনকারীদের সবার নামে কি পাকিস্তানি শাসকরা মামলা দিয়েছে? বিভ্রান্তকারীদের যুক্তি বিচারে যারা বন্দিদের মুক্তির জন্য লড়াই করেছে তারা অসম্ভব রকমের অপরাধ করেছে। কারণ তারা বন্দি হয়নি।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও বীভৎস চিন্তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাংলাদেশের মাটিতে যারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে তারা আমেরিকা বা ইউরোপে যায় কেন? সাম্রাজ্যবাদের নিষ্ঠুর ও নৃশংসতার মূর্তরুপ হল-যুদ্ধ যুদ্ধ উন্মাদনা। বিরাট পরিসরে যুদ্ধ বাঁধানো। সেজন্য মহামতি লেনিন বলেছেন সাম্রাজ্যবাদ আছে মানে, যুদ্ধ অনিবার্যভাবে আছে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির স্বপক্ষের লড়াই স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় নিয়ে সংগঠিত হয় না। বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। একই রকমভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই মার্কিন দেশেই চলমান। ইউরোপের দেশে দেশে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ও পরদেশ দখলের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত আছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর ইরাক যুদ্ধের  সময় সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ আসে মার্কিন সিনেট থেকে।

প্রায় পৃথিবীর সমস্ত দেশে নানা নামে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বাম-প্রগতিশীল, কমিউনিস্ট সংগঠনের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। যেহেতু সাম্রাজ্যবাদের চরিত্রটা আন্তর্জাতিক ফলে তার বিরুদ্ধে লড়াইটাও চালাতে হবে সর্বত্রই। দুনিয়ার যে প্রান্তে যে-জন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়বে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়বে তাদের সবার শক্তিশালী মিত্রতা গড়ে উঠবে; বিষয়টা স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাভাবিক বিষয়টা নিয়ে অস্বাভাবিক মুখভঙ্গি লড়াইয়ের ময়দান থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার সূক্ষ্ম নীলনকশা তৈরির আয়োজন। যদিও বাংলাদেশি বিরোধিতাকারীরা পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ক জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা থেকে কিছু প্রলাপ বকে যায়। যার ফলে এই দেশের লড়াকু তরুণ-যুবক যারা শান্তির পক্ষে, মেহনতি মানুষের মুক্তির পক্ষে কাজ করবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়; তারা সহজেই একটা কঠিন বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। যেহেতু সু-পরিচিত, নিকটাত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই (যারা সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে) উচ্চশিক্ষার জন্য, জীবিকার্জনের জন্য ইউরোপ-আমেরিকাতে পাড়ি জমিয়েছে। সেহেতু তারা এ কাজটাকে একটা বিরাট অন্যায় মনে করে। বাস্তবে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা দুনিয়ার সমস্ত মুক্তিকামী মানুষের। কোনো ব্যক্তি-বিশেষের নয়। ফলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই লড়াইয়ে যুক্ত থাকা সম্ভব। ফলে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে সত্য অন্বেষণ করাই মানবিক কর্তব্য। সেই কর্তব্য সম্পাদনে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে এগিয়ে আসবে এটাই আশার কথা।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত