প্রায় এক দশক পর সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে এই দেশ যে অসাধারণ রূপান্তর অর্জন করেছে তা আমার কাছে তুলে ধরেছে। ঢাকা কর্মকাণ্ডে গুঞ্জন ছিল, কিছু এলাকা বিস্তৃত নির্মাণস্থলে পরিণত হয়েছে। রাজধানী সবদিকে প্রসারিত হচ্ছে এবং নতুন ফ্লাইওভার, সেতু এবং বাণিজ্যিক সাইটগুলো ধূলিকণা এবং ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত একটি আর্থস্কেপ থেকে উঠে আসছে, যা ভারতের দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলোর মতো নয়। অবশ্যই দুশ্চিন্তা আছে। ২০২১ সালে মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় যেখানে ২,৫০৩.০৪ ডলার, যেখানে ভারতের ২,২৭৭.৪৩ ডলার। তৈরি পোশাক শিল্প যা তার মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশ; ২০২২ সালের মহামারি, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, পশ্চিমা বাজারে চাহিদা হ্রাস এবং ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হওয়ার কারণে শিল্পটি কিছুটা হুমকির মুখে ছিল। এ হুমকি কিছুটা মোকাবিলা করে আবার কিছুটা ঘুওে দাঁড়িয়েছে। আয়ের আরেকটি প্রধান উৎস ১ কোটি ৩০ লাখ প্রবাসীর কাছ থেকে প্রাপ্ত রেমিট্যন্স। ২০২১ সালের ২২ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে এ বছর আনুমানিক ২১ বিলিয়ন ডলার আসছে এ খাত থেকে। এই প্রতিকূল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, ১৯৭২ সালে হেনরি কিসিঞ্জার এটিকে ‘আন্তর্জাতিক বাস্কেট কেস’ হিসাবে বর্ণনা করার সময় থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
মানব উন্নয়ন সূচকে দেশের র্যাংকিংয়ের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষণীয়। এটি ১৯১টি দেশের মধ্যে ১২৯তম স্থানে ভারতের চেয়ে সামান্য এগিয়ে রয়েছে; ভারতের অবস্থান ১৩১। লিঙ্গ-সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। মাতৃমৃত্যু হার ২০১০ সালে প্রতি হাজারে ২৫৮ থেকে কমে প্রায় ১৭০ জনে দাঁড়িয়েছে। এক দশক আগে সাক্ষরতার হার ৮৬.৯৩ শতাংশ; ১৫-২৪ বছর বয়সি নারীর সাক্ষরতার হার এখন ৯৫.৮৬ শতাংশ, যা একই বয়সের পুরুষদের তুলনায় ৩ শতাংশ বেশি। ভারতে মোট নারী শ্রমশক্তির ২৮ শতাংশের তুলনায় বাংলাদেশে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ মোট শ্রমশক্তির ৪৬ শতাংশ। বাংলাদেশে পোশাক খাতে নিযুক্ত শ্রমিকদের একটি বড় অংশ তথা ৮০ শতাংশ নারী। লিঙ্গ-সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অর্জন ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ওপরে।
তবে বাংলাদেশে রাজনীতিতে অস্থিরতা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের অভাব কিছু সমস্যা রয়েছে। যাওয়া এবং বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের কঠোর আচরণের কারণে বিক্ষোভ হয়েছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং শেখ হাসিনার নেতৃ ত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল এ সুযোগে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। বিএনপির সাথে একযোগে কাজ করে, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল জামায়াত যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ নিয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার বর্তমান মেয়াদে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তাদের সেরা বছর দেখেছে। বেশ কয়েকটি পরিবহন সংযোগ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে বিদ্যমান রেল ও নদীপথের পুনরুজ্জীবন। ভারতের এখন বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যবহারিক ট্রানজিট রয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি রাজ্য পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারে। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের পণ্য সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ রুট ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভারত বাংলাদেশের প্রধান বিদ্যুৎ সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়েছে। এটি বর্তমানে ১১৬০ মেগাওয়াট এবং আরও ১৫০০ মেগাওয়াট বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সম্প্রতি আদানি ঘোষণা করেছেন যে তিনি ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় ১৬০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছেন।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার, রপ্তানিতে ১৬.২ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানিতে ২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের বৃহৎ বাণিজ্য ঘাটতি একটি চিরস্থায়ী আলোচনার বিষয়। যাই হোক, এটি প্রতীয়মান হয় যে উভয় দেশ তাদের বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রচারের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সুবিধা দেখছে। ভারতে সাম্প্রদায়িক অনুভূতির উত্থানের বিষয়ে বাংলাদেশে নেতিবাচক জনপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ক্রমাগত উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
রাজধানীর উপকণ্ঠে অবস্থিত মুক্তি জাদুঘরের প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রাচীন অতীত থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এখানে মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিবেদিত একটি পুরো গ্যালারি রয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক পুরুষ-নারী-শিশুদের উপর যে বর্বরতা চালানো হয়েছে তার চিত্র ছিল এ প্রদর্শনীতে। যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা, বিশেষত ইন্দিরা গান্ধীর অবদান সম্পূর্ণরূপে স্বীকৃত দেওয়া হয়েছে।
প্রদর্শনীগুলো দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের উপর জোর দেয়। একটি গ্রন্থাগার এবং গবেষণা বিভাগ রয়েছে যেখানে যুদ্ধ সম্পর্কিত নথি ও ফটোগ্রাফ, ব্যক্তি ও পরিবারের ব্যক্তিগত রেকর্ড সক্রিয়ভাবে অনুসন্ধান, সংগ্রহ এবং অধ্যয়ন করা হয়। ভারতীয় আর্কাইভে গবেষণা এবং অনেক সাবেক বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তার সাথে মতবিনিময়ের জন্য কয়েকজন বাংলাদেশি গবেষককে ভারতে আসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমার প্রস্তাবটি উৎসাহের সাথে গ্রহণ করা হয়েছে। এ ধরনের বিনিময়কে সহজতর করা হয় আমাদের স্বার্থে।
লেখক : শিক্ষক (ভারতের ‘ট্রিবিউন ইন্ডিয়া’-এ প্রকাশিত লেখার অবলম্বনে)
-বাবু/এ.এস