মেট্রোরেলের মাধ্যমে আধুনিক যোগাযোগের যুগে প্রবেশ করলো বাংলাদেশ। এটা ছিলসরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর জন্য সরকার প্রশংসার দাবিদার। মেট্রোরেল হবে এটা হয়ত আমাদের পূর্ব পুরুষ কখনও চিন্তা করেনি। কিন্তু সেটা বর্তমান সরকারের আমলে সম্ভব হয়েছে। স্বপ্নের মেট্রোরেলের কাজ প্রায় শেষ। তবে ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধনের মাধ্যমে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে। এটা আমাদের দেশের জন্য সরকারের নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। অর্থাৎ এই প্রকল্পের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন হবে। মেট্রোরেলের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। যদিও কোন আলাদা কোন গবেষণা নেই যে মেট্রোরেল অর্থনীতিতে কীভাবে ভূমিকা রাখবে। তবে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী টানেল এবং মেট্রোরেল দেশের জিডিপিতে ২ শতাংশ যোগ করবে। কিন্তু মেট্রোরেল ঢাকার প্রায় ২-৩ কোটি মানুষের সময় সাশ্রয় করবে। অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুনভাবে গতি আসবে। যা দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করবে। যার সুফল পাবে সাধারণ জনগণ। মূল কথা মেট্রোরেল দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
শহুরে যোগাযোগের আধুনিকীকরণ, দ্রুততম এবং জনপ্রিয় মাধ্যম হল মেট্রোরেল। মেট্রোরেল এখন দৃশ্যমান বাস্তবতার অপর নাম। ঢাকা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল মেগাসিটি। ঢাকা শহরের যানজট সমস্যা নিরসনে মেট্রোরেল প্রকল্প ছিল একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। যার জন্য বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। মেট্রোরেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থায় প্রবেশ করলো। যা স্বাধীনতার ৫১ বছরে এক বিশাল প্রাপ্তি বাংলাদেশের জনগণের জন্য। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০০৪ সালে ঢাকায় রাস্তায় যানবাহনের গড় গতি ছিল প্রায় ২১.২ কিমি পার ঘণ্টায়, কিন্তু ২০১৫ সালে হ্রাস পেয়ে তা দাঁড়ায় ৬.৮ কিমি প্রতি ঘণ্টায়। অর্থাৎ উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে বাসে সময় লাগত ৩-৪ ঘণ্টা। যা এখন লাগবে ৪০ মিনিট। কারণ, মেট্রোরেলের ফলে যানজট থাকবে না। এতে মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন আসবে এবং কর্মীদের কাজের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
যানজট দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় অনেক। ২০১৮ সালে বুয়েটের এক জরিপে ঢাকা শহরে যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচ হয়। যা দেশের সামগ্রিক বাজেটের ১৫ শতাংশের চেয়ে বেশি। এছাড়া ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। এই কর্মঘণ্টার নষ্ট হওয়ার কারণে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।এখন মেট্রোরেলের কারণে এসব নেতিবাচক প্রভাব ইতিবাচক প্রভাবে রূপান্তর হবে। উত্তরা-মতিঝিল রুটে বিদ্যুত চালিত ট্রেনগুলো যা আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাস র্যা পিড ট্রানজিট লাইন-৬ বা এমআরটি লাইন-৬ নামে পরিচিত। যার ফলে অন্যান্য যানবাহনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে এবং এভাবে ২.০২ লাখ টন কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে দেবে প্রতিবছর। যা জলবায়ুতে ব্যাপক পজিটিভ প্রভাব পড়বে। ঢাকার রাস্তায় চলমান সমস্ত যানবাহন জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভর করে,যা পরিবেশ দূষণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। এছাড়াও, ঢাকা ও এর আশপাশে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন উদ্যোগ চলছে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা ধারাবাহিকভাবে শীর্ষে রয়েছে। মেট্রোরেল রাজধানীর পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকা শহর থেকে জনসংখ্যার ঘনত্ব কমানো যাবে। মানুষের বাসা ভাড়া খরচ কমে যাবে। অনেক কম খরচ করে শহরের বাইরে থাকতে পারবে এবং অফিস ও অন্যান্য কাজে সহজে ঢাকায় আসতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, গাজীপুর বা নারায়ণগঞ্জ এলাকায় বসবাসকারী লোকেরা সমস্ত রুট সম্পূর্ণ হয়ে গেলে এক ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে মূল শহরে যেতে পারবে। প্রতিটি মেট্রোরেল রুটেই ভবিষ্যতে সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। সুতরাং, পুরো ট্রানজিট ব্যবস্থাটি কাছাকাছি শহরে প্রসারিত করা যেতে পারে। বর্তমানে এসব এলাকায় বসবাসকারী লোকজনও মূল শহরে বসবাস না করেও রাজধানীতে কাজে যোগদান করতে পারবে। ফলে দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হবে।
তাছাড়া, অন্যদিকে অনেক বাণিজ্যিক উন্নয়ন ঘটবে এবং রুটের চারপাশে সুবিধার জন্য ঐসব এলাকার বাসা ভাড়া বাড়বে। যা আবাসন ব্যবসায় ব্যাপক গতি আসবে। দ্বিতীয়ত, আবাসিক ভবন বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য পুনর্নির্মাণ করা হবে। ফলস্বরূপ,ঐসব এলাকায় বসবাসকারী লোকজন কম ভাড়ার জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হবে এবং শেষ পর্যন্ত মানুষ কেন্দ্রীয় শহর থেকে বিকেন্দ্রীভূত হবে। মেট্রোরেলের কারণে রাজধানীর বিকেন্দ্রীকরণ করা সম্ভব হবে। যা হবে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মেট্রোরেল আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি নতুন যুগে আবদ্ধ করবে। অন্যান্য উন্নত দেশে মেট্রোরেল এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন মাধ্যমগুলোকে একত্রিত করে একটি উন্নত রুট সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে যাতে মানুষ শুধুমাত্র একটি পেমেন্ট কার্ডের মাধ্যমে তাদের গন্তব্যে ভ্রমণ করতে পারে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে মেট্রোরেলে এই নতুন ব্যবস্থার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সিস্টেমটি ধীরে ধীরে সব ধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে প্রসারিত করা যেতে পারে। এটি দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশন আনার পাশাপাশি ধীরে ধীরে নগদবিহীন অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। যা খুবই ভালো এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
গণমাধ্যমে জানতে পারি, মেট্রোরেলে মহিলা যাত্রীদের চলাচলের সুবিধার্থে প্রতিটি ট্রেনের একটি করে বগি শুধুমাত্র মহিলা যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। ট্রেনটি একবারে সর্বাধিক ৩৯০ জন মহিলা যাত্রী বহন করতে সক্ষম হবে। নারী যাত্রীরাও ইচ্ছা করলে অন্য কোচে যাতায়াত করতে পারবেন। মেট্রো স্টেশনগুলোতে মহিলা যাত্রীদের জন্য আলাদা বাথরুম এবং শিশুর ডায়াপার পরিবর্তনের জন্য বিশেষ সুবিধা রয়েছে। গর্ভবতী মহিলা এবং বয়স্ক যাত্রীদের জন্য মেট্রোট্রেনের বগিগুলোর মধ্যে আসন সংরক্ষিত থাকবে। অর্থাৎ এটি একটি নারীবান্ধব মেট্রোরেল প্রকল্প। যা নারীদের হয়রানি এবং ভোগান্তি কমাতে কাজে আসবে।
বিশেষজ্ঞরা একটি সমীক্ষার ফলাফলের মাধ্যমে বিশ্বাস করেন, একবার এমআরটি লাইন- ৬ চালু হলে এটি ভ্রমণের সময় ব্যয়ে ৮.৩৮ কোটি টাকা এবং যানবাহনের পরিচালনা ব্যয়ে দৈনিক ১.১৮ কোটি টাকা সাশ্রয় করবে, যা বছরে ৩৪৮৯.৪০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়াবে। মেট্রোরেলের কারণে ফ্ল্যাট ব্যবসায় প্রভাব পড়েছে ইতিবাচকভাবে,কারণ এখন মিরপুর এবং উত্তরার ফ্ল্যাটের চাহিদা বেড়ে চলছে। অর্থাৎ রাশিয়া ওইউক্রেন যুদ্ধ এবং করোনা কারণে আবাসন ব্যবসায় কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব ছিল। কিন্তু এখন মেট্রোরেলের কারণে উত্তরার অনেক জায়গায় ফ্ল্যাট এর চাহিদা বেড়ে যাওয়া ইতিবাচক। এভাবে ধারাবাহিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে আরেকবার। অর্থাৎ এই উন্নয়নের ফলে দেশে টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে যাতে এই ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের দিকে বাংলাদেশ আরও ধাবিত হতে পারে। উন্নত মেট্রোপলিটন রাজধানীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে নতুন ভবিষ্যতের অপরিহার্য অংশ মেট্রোরেল প্রকল্প। পদ্মাসেতু এবং মেট্রোরেল পুরোদমে বাংলাদেশে উন্নয়নের নতুন ছোঁয়া লাগাবে বলে বিশ্বাস করি। বদলে যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা। এটি জিডিপি প্রবৃদ্ধির উপর স্পষ্ট প্রভাব ফেলবে। শুধু জিডিপি বাড়াবে না বরং দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে মেট্রোরেল। একই সঙ্গে মেট্রোরেল দেশের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিবে অনেকগুণ। গড়ে উঠবে অনন্য বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
বাবু/জেএম