সোমবার ২৩ জুন ২০২৫ ৯ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ২৩ জুন ২০২৫
নতুন অধ্যায়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
অলোক আচার্য
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩, ৮:৩৮ PM
নতুন বছরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন গতি পেয়েছে। ইউক্রেনের জন্য সরবরাহকৃত ভারি অস্ত্র বিশেষত ট্যাঙ্ক নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই বিষয়টি আলোচনায় ছিল। যুদ্ধে কি ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে অথবা ইউক্রেনের যুদ্ধ অবস্থানের সুবিধা কতটুকু হতে পারে এসব বিষয় ছিল আলোচনায়। বিগত কয়েক মাস ধরেই যুদ্ধের দিকেই চোখ থাকে সবার। যুদ্ধ থামার কোনো সম্ভাবনা আছে নাকি তা আরও বাড়বে এসব প্রশ্ন মনে। সে কেবল যুদ্ধের জন্যই নয় বরং যুদ্ধের ফলস্বরূপ বিশ্ব অর্থনীতিতে যে উত্থান-পতনের খেলা চলছে সেই নিয়ে।

গত কয়েকদিনে ইউক্রেনকে ট্যাংক সরবরাহ নিয়ে যে ঘটনাক্রম এবং তা সরবরাহের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাতে স্পষ্টতই এই যুদ্ধ আরও ভয়াবহ হতে যাচ্ছে বলেই অনুমেয়। যুদ্ধের মূল হলো অস্ত্র যা বরাবরই ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছ থেকে পেয়েছে এবং এখনো পাচ্ছে। এভাবে আরও সামরিক সহায়তা ইউক্রেন পাবে অন্তত যতক্ষণ যুদ্ধের বন্ধের ব্যাপারে কোনো সমাধানে না পৌছাতে পারে। সেক্ষেত্রে ইউক্রেন পরাশক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো মোটামুটি যুতসই অস্ত্র পাচ্ছে এবং এর ফলশ্রুতিতে এই যুদ্ধ আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে এটা বলাই যায়। এই যুদ্ধ হচ্ছে ইউক্রেনের মাটিতেই, যুদ্ধ করছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী কিন্তু অস্ত্র, অর্থ ও অন্যান্য জিনিসের যোগান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর প্রক্সিযুদ্ধ মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গণমাধ্যমের বিভিন্ন বিশ্লেষণে এমনটাই উঠে এসেছে।

সুতরাং অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র একটি যুদ্ধ ততক্ষণ চলবে যতক্ষণ উভয়পক্ষের সম্মতিতে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে রাজি করানো যায় এবং তা আলোচনার মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত মনে হয়েছে অস্ত্র নয় আলোচনাতেই সমাধান আসবে। সেই সুরও মাঝে মধ্যেই শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর হয় না। চলমান যুদ্ধে ইতিমধ্যেই উভয়পক্ষের বহুসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়েছে। ইউক্রেনের শহরের পর শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। রাশিয়ার দখলেও গেছে কিছু অংশ। এই যুদ্ধে কে জয়লাভ করবে শেষপর্যন্ত তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরাজিত হবে মানুষ। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রতিযোগীতাপূর্ণ মনোভাব এবং আধিপত্য ধরে রাখার লড়াইে এখন অস্ত্র এবং কৌশলগত শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটছে। 

এতদিন বহু অস্ত্র দিলেও সম্প্রতি ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি তাদের অত্যাধুনিক ট্যাংক পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে যার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের নতুন মাত্র শুরু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সিএনএন-এর বিশ্লেষণ বলছে, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের ভারি ট্যাংক সরাসরি রুশ সেনাদের ওপর আঘাত হানতে ব্যবহার করা হবে। ফলে বলা চলে, অনেক দিক থেকেই ঘুরে গেছে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট। ট্যাংকের পর আবার যুদ্ধ বিমান চাওয়ার পরিকল্পনা করছে ইউক্রেন এমনটাই জানা গেছে।

জানা গেছে, মিত্রদের কাছে চতুর্থ প্রজন্মের মার্কিন এফ-১৬ যুদ্ধবিমানও চাইবে ইউক্রেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের আব্রামস ট্যাঙ্কগুলো বাইডেনের দেওয়া বক্তব্য অনুসারে বিশ্বের সবচেয়ে ভালো ট্যাঙ্ক। আর যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানির পর কানাডাও ইউক্রেনকে লেপার্ড-২ ট্যাঙ্ক দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। এর ফলে বর্তমান যুদ্ধ যে এক চরম উত্তেজনাকর মাত্রায় রূপ নিতে যাচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।  বিষয়টি সম্ভবত একটি প্রেস্টিজ ইস্যুতেও পরিণত হয়েছে যেখানে ইউক্রেনকে বিজয়ী করতে এবং রাশিয়ার পরিকল্পনা আরও কঠিন করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে ইউক্রেনকে সহায়তাকারী দেশগুলো। যদিও শুরুতেই জার্মানি তাদের ট্যাঙ্ক পাঠাতে রাজি হয়নি। এ নিয়ে তাদের কিছুটা চাপের মুখেও থাকতে হয়। তারপর যখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের আব্রামস ট্যাংক দিতে রাজী হয় তখন জার্মানিও রাজী হয়। জার্মানির শর্তও ছিল এটা। কিন্তু এই ভারি অত্যাধুনিক অস্ত্র ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর মধ্য দিয়ে তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পাবে। এরপর যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোভুক্ত সদস্য দেশগুলোও যাদের এসব ট্যাঙ্ক রয়েছে তারা তাদের কিছু ট্যাঙ্ক পাঠায় তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেন সুবিধা পাবে। 

প্রশ্ন হলো, এসব সিদ্ধান্ত বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাকে কতটা নিকটে আনছে সেটা নিয়েও রয়েছে। কারণ যুদ্ধের একেবারে শুরুতে যুদ্ধ শুরুর একটি কারণ ছিল ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তি নিয়ে যা রাশিয়ার আপত্তির এবং উদ্বেগের বিষয় ছিল। ন্যাটোর সম্প্রসারণ রাশিয়ার উদ্বেগের কারণ। রাশিয়ার ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রথম থেকে কৌশলগতভাবে অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমেই পূর্ণমাত্রায় সামরিক অভিযান শুরু করেনি। প্রথমে যুদ্ধ সম্পর্কে যা অনুমান করা হয়েছিল তা ঠিক হয়নি। সহজেই ইউক্রেনকে দমাতে পারেনি। এর কারণ ইউক্রেনের যুদ্ধ কৌশল এবং পশ্চিমা বিশ্ব এবং মিত্র দেশগুলোর অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা। রাশিয়ার এ অভিযানে উদ্দেশ্য কি কিয়েভ দখল করা না ইউক্রেনকে ন্যাটো যোগদান থেকে বিরত রাখা এসব প্রশ্নই থেকে গেছে। এখন পর্যন্ত রাশিয়ার যুদ্ধ কৌশল সফল হয়েছে।  দীর্ঘায়িত হওয়ার সাথে সাথে এখন যুদ্ধ আরো তীব্র মাত্রায় হওয়ারও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষত এসব অত্যাধুনিক ট্যাংক হাতে পেলে তা রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। কিন্তু এই পশ্চিমা অস্ত্র দিয়ে কতদিন যুদ্ধ চলবে? কারণ অস্ত্র ভাণ্ডারেও তো টান পরে। আবার রাশিয়ার অবস্থাও একই। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচুর অস্ত্রের দরকার হচ্ছে? কারণ যুদ্ধে জয়লাভের জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র। সেই অস্ত্র তৈরি করতেও তো সময়ের দরকার। এখনও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ইউক্রেনকে দেওয়া হচ্ছে কিন্তু নিজের দেশের অস্ত্র ভাণ্ডারও তো সুরক্ষিত রাখতে হবে। কারণ নিজ দেশের নিরাপত্তাই সর্বাগ্রে। 

ইউক্রেন ইস্যুকে কেন্দ্র করে অস্ত্রের পাশাপাশি চলছে মনোস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও। দুটি দেশ যুদ্ধে জড়ালেও বাস্তবিক পক্ষে এর সাথে পরোক্ষভাবে অন্য দেশও জড়িত। পরস্পর নির্ভরশীল বিশ্বে কেউ কাউকে পুরোপুরিভাবে এড়িয়ে চলা প্রায় অসম্ভব। এতে যেমন ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটে তেমনি উন্নয়নশীল বিশ্ব এর ফল ভোগ করে। এক দেশের কোনো সম্পদের ওপর অন্য এক বা একাধিক দেশ নির্ভর করে। উপরন্তু সেই দুটি পক্ষ যদি হয় পরাশক্তি। সেই বহুবছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে আসছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের রাজনীতি পাল্টে দিয়েছে। মাঝে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব এলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। এর আগে আলোচনার প্রস্তাবে রাশিয়ার গণভোটকৃত স্বীকৃতি দেওয়ার শর্ত রাখে। বিপরীতে তারা অস্ত্র সহায়তা পাচ্ছে যা দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। কিন্তু কতদিন? যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো কতদিন সহায়তা অব্যাহত রাখতে পারবে এবং রাশিয়াও কতদিন সময় নিবে ইউক্রেন দখল করতে। নতুন শক্তির এই অস্ত্রগুলো ইউক্রেনকে সুবিধা অবশ্যই দিবে কিন্তু কতটুকু তা নিয়েও বিশ্লেষণ হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্যাঙ্ক পেলেও তা পরিচালনা করার জন্য পর্যাপ্ত দক্ষতা অর্জন করতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। সুতরাং এর জন্য সময় দরকার। তাছাড়া ইউক্রেনের যে চাহিদা ছিল সেই চাহিদার খুব কম অংশই তারা পাচ্ছে। যুদ্ধ যে ক্রমেই আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে সে কথা নিঃসন্দেভাবে বলা যায়। এবং সেই সাথে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে। 
 
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

বাবু/জেএম

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


Also News   Subject:  রাশিয়া   ইউক্রেন   যুদ্ধ   







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত