রবিবার ২২ জুন ২০২৫ ৮ আষাঢ় ১৪৩২
রবিবার ২২ জুন ২০২৫
বৈঠার ভরে ওদের সংসার
নোনাজলে ভাসে মান্তা সম্প্রদায়
মাহমুদ হাসান, রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী)
প্রকাশ: শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৫:১৮ PM
রাশিদা বেগম, বয়স পঞ্চাশ ছাড়াল। রোগাক্রান্ত শরীর নিয়ে বুড়াগৌরাঙ্গ নদীতে ছোট্ট একটি ডিঙি নৌকা নিয়ে ছুঁটে বেড়াচ্ছেন পেটের তাগিদে। মাছ ধরে যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে রাশিদা বেগমের দুই ছেলে ও এক মেয়ের লেখাপড়া এবং পাঁচ সদস্যের সংসার। কৈশোর বয়স থেকেই কোমল হাতে তুলে নিয়েছিল বৈঠা। যে বয়সে সহপাঠীদের সঙ্গে রাশিদার হই-হুল্লোড় আর গোল্লাছুট-কানামাছি খেলার কথা ছিল, সেই বয়সে সংসারের বোঝা কাঁধে নিয়েছে। জীবনের ক্লান্তিলগ্নে এসেও জলকন্যা রাশিদার জীবন-সংগ্রাম থেমে নেই। তার এ সংগ্রামী জীবনের সঙ্গী উজ্জল সরদার। বয়সে ভাটা পরেছে তারও। তবুও দু’জনে মিলে মাছ ধরছে বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর বুকে। রাশিদা-উজ্জল এই জলদম্পতির ঠিকানা বলতে শুধু-ই ছাউনি ঘেরা নৌকা। সারাদিনের কর্মযজ্ঞ শেষে আশ্রয় নেয় পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের স্লুইস খালে।

শুক্রবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বুড়াগৌরাঙ্গ নদীতে ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে একঝাঁক নৌকার বহর। কাছে গিয়ে দেখা যায় নৌকার সামনে বসে আছে এক নারী। কথা বলে জানা গেল তার নাম-রাশিদা। তিনি ওই নৌকার মাঝি। নদীর জীবন নিয়ে কথা হয় তার সাথে। ঘর ছেড়ে নদীতে থাকার গল্প জানতে চাইলে সব ক্লান্তি ছাপিয়ে হেঁসে ওঠে বললেন তার জীবন কাহিনী। বয়স যখন ৮-১০ বছর তখন ভিটেবাড়ি বিলীন হয় নদী ভাঙনে। সহায়-সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পরেছেন। এরপরে ঠাঁই মেলে নৌকায়। সে বয়সেই বাবা-মায়ের সঙ্গে নৌকায় করে মাছ ধরতে ধরতে এখন মাঝি হয়েছেন। এক সময় নদীর এ তীর ওই তীর ঘুরে ফিরে থাকলেও এখন স্থায়ীভাবে থাকছেন রাঙ্গাবালীর চরমোন্তাজের স্লুইস খালে। রাশিদা জানান, শুধু আমিই নই। আমাদের মত ৮৬ পরিবার এখানে আশ্রয় নিয়েছে এখানে। ভিটে-মাটি হারানোর কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ষাটোর্ধ্ব আম্বিয়া। তিনি অশ্রুভেজা চোখে বলেন, ‘বাবারে এক সময় ঘরবাড়ি, জায়গা-জমিও আছিল। নদী ভাঙনে আমাগো সব নিয়া নেছে। এরপর স্বামীরে নিয়া এইহানে (এখানে) ৩০ বছর আগে আইছি। পেটের জ্বালা মিটাইতে মাছ ধরা শুরু করছি।’ এ বয়সে পরিশ্রম করতে কষ্ট হয় কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাগো জীবনটা এরকমই। বইয়া (বসে) থাকলে খামু কী? কে খাওয়াইবে আমাগো?।’ 

স্থানীয়দের তথ্যমতে, শুরুর দিকে পাঁচটি নৌকা নিয়ে ‘মান্তা’ এখানে এসেছিল। বর্তমানে এখন ৮৬টি পরিবারের বসবাস রয়েছে। নদীতে থাকায় তারা এখানে ‘মান্তা সম্প্রদায়’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। মান্তা বহরে শিশু রয়েছে এক শতাধিক। প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, মান্তাদের অনেকে ভোটাধিকার এবং সরকারি বিভিন্ন সহায়তা পাচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৯টি পরিবার মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে তারা পেয়েছে স্বপ্নের নীড়। এখনও ৫৭টি পরিবার রয়েছে ঠিকানাহীন। তাদের কেও পর্যায়ক্রমে সুবিধাভুক্ত করা হবে। চরমোন্তাজ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যন একে সামসুদ্দিন (আবু মিয়া) বলেন, ‘মান্তা সম্প্রদায়ের জীবন-মান উন্নয়নে আমরা কাজ করে আসছি।’ 

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জাগোনারী ডিরেক্টর (যোগাযোগ) ডিউক ইবনে আমীন বলেন, ‘ভাসমান মান্তা ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া ছিল অনিশ্চিত। শিক্ষার আলো ওদের কাছে ছিল বিলাসিতা। কিন্তু সেই মান্তা শিশুরা এখন লেখাপড়া শিখছে। ভাসমান বোট স্কুলের মাধ্যমে জাগোনারী ওদের সে সুযোগ করে দিয়েছে।’ ভাসমান বোট স্কুলের প্রধান শিক্ষক আইয়ুব খান জানান, ‘মান্তারা আগে ডাঙার মানুষের কাছ থেকে বৈষম্যের শিকার হতো। কিন্তু এখন তারা ডাঙার মানুষের সঙ্গে মিশতে শুরু করেছে। দূর হচ্ছে সেই বৈষম্যও।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডাঙার শিশুদের মতো-ই তারাও পড়ালেখা করছে। উচ্চশিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন বুনছে। বাবা-মা কষ্ট করলেও সন্তানদের নতুন জীবন দিতে স্কুলগামী করছে অনেকে।’

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ডা. জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মান্তা সম্প্রদায়ের লোকজন সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় এসেছে। ইতোমধ্যে মুজিববর্ষের ঘরসহ স্থায়ী ঠিকানা পেয়েছে ২৯ জন। ৩০টি ঘরের কাজ চলমান এবং মান্তা শিশুদের শিক্ষার আওতায় আনতে স্কুল নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে।’

বাবু/জেএম

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


Also News   Subject:   মান্তা সম্প্রদায়  







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত