মঙ্গলবার ৮ জুলাই ২০২৫ ২৪ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ৮ জুলাই ২০২৫
স্মার্ট বাংলাদেশ আগামীর অনিবার্য
ড. মীজানুর রহমান
প্রকাশ: বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৫:০০ PM

দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি ঢাকায় কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে ১০ দফা ও ২৭ দফার মাধ্যমে ‘রাষ্ট্র মেরামত’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এর আদল অনেকটা মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচির মতো। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের নিয়ে জাতি পুনর্নির্মাণের একটা ইঙ্গিত ১৯ দফাতেও ছিল। ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল ঘোষিত দফাগুলোতে রাজাকার-আলবদরদের নিয়ে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করার যে ঘোষণা জিয়াউর রহমান (১৯৩৬-১৯৮১) দিয়েছিলেন, তারই আজকের রূপ হচ্ছে ‘রেইনবো নেশন’।

২৭ দফার দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশকে একটা ‘রংধনু জাতিতে’ পরিণত করার ঘোষণা দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডক্টর খন্দকার মোশারফ হোসেন। কয়েক বছর আগের ব্যাপক সাড়া জাগানো অথচ কার্যত ব্যর্থ সড়ক আন্দোলনের স্কুলছাত্রদের স্লোগান ধার করে ‘রাষ্ট্র মেরামতের’ এই অন্যতম দফাটিতে বলা হয়েছে, ‘প্রতিহিংসা এবং প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রেইনবো নেশন প্রতিষ্ঠা করা’ হবে। যেমনটি ঘোষণা করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা (১৯১৮-২০১৩)। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার প্রথম মাসেই তিনি এই ঘোষণা দেন। মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশপ ডেসমন্ড টুটোই (১৯৩১-২০২১) ১৯৯৪ সালে প্রথম এই দুই শব্দের বাক্যাংশটি চয়ন করেছিলেন। এ বিষয়ে তিনি কয়েকটি টিভি অনুষ্ঠানে তাঁর ধারণা বিস্তৃত করেছিলেন। লক্ষণীয়, বিএনপি ঘোষিত রেইনবো নেশনেও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদের কি অবস্থান হবে তা বলা হয়নি!

বহু জাতি-গোষ্ঠীতে বিভক্ত বহু ভাষাভাষী (দক্ষিণ আফ্রিকায় রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ভাষার সংখ্যা ১৩টি) একটা দেশকে সুসংগঠিত করার জন্য ম্যান্ডেলার ওই উদ্যোগ যথার্থই ছিল। ম্যান্ডেলা তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহু বর্ণে বর্ণিল একটি রংধনু জাতি হিসেবেই দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ম্যান্ডেলা তখন কল্পনাও করতে পারেন নি, অল্প কিছু কালের মধ্যেই তাঁর বর্ণিল রংধনু জাতি একটি বিবর্ণ জাতিতে রূপান্তরিত হবে। দক্ষিণ আফ্রিকা বর্তমানে আইনশৃঙ্খলার বিবেচনায় পৃথিবীর ১৩৭তম দেশ। ২০১৮ সালের গ্যালাপ জরিপে ১০০-এর মধ্যে মাত্র ৫৮ স্কোর পেয়ে পৃথিবীতে নিচের দিক থেকে কেনিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে ষষ্ঠ অবস্থান পায়। সাব-সাহারা অঞ্চলে এই দেশটির আইনশৃঙ্খলা সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে। তাদের পিছনে পৃথিবীর আর মাত্র পাঁচটি দেশ অবস্থান করছে (গ্যাবন, দক্ষিণ সুদান, আফগানিস্তান এবং ভেনিজুয়েলা)। একই জরিপে ৫০ শতাংশ মানুষ বলেছে, বিগত এক বছরে সে কোনো না কোনো অপরাধকর্মের শিকার হয়েছে। প্রতি এক লাখের মধ্যে ৩৩ জন খুন হয়েছে। পৃথিবীর ভয়ংকর জায়গাগুলোর একটি হচ্ছে আজকের দক্ষিণ আফ্রিকা। সম্প্রতি এই খুনের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এই সংখ্যা এখন প্রতি লাখে ৩৬ জন, প্রতিদিন গড়ে ৫৭ জন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন দেশের মতো হতে চাওয়া অথবা বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের মতো হয়ে যাবে এরূপ বলা তেমন নতুন কিছু নয়। এই যেমন কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কা যখন চরম আর্থিক দুর্দশায় পড়েছিল, তখন অনেকেই বলেছিল আমরা শ্রীলঙ্কার মতো হয়ে যাব। কখনও কখনও যারা দেশকে অনেক উন্নত দেখতে চায়, তারা সুইজারল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরের মতো হতে চায়। এসব আলোচনায় এতদিন আমরা এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যেই ছিলাম। এই প্রথম আমরা আফ্রিকা পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম, তাও আবার দক্ষিণ আফ্রিকার অনুকরণে ‘রেইনবো ন্যাশন’ হওয়ার নামে। সংবিধানের ২৮ (১) ধারাটি এখনও অক্ষুণ্ন আছে। যাতে বলা আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ সংবিধানের এই ধারাটিতে সব নাগরিকের সম-অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। অতএব এটি মেরামত করে এখানে ‘রেইনবো নেশন’ তৈরির একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের জন্য একটি বিশেষ অবস্থান তৈরি করা।

‘রেইনবো নেশন’ থিওরির বিপরীতে ২০২২ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের প্রত্যয় ঘোষণা করেন। এটা করেছেন তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপান্তরের ধারাবাহিকতায়। অনেকটা বলা যায় আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের অনিবার্যতাই হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধাক্কায় ডিজিটাল, ভৌতবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের দেয়াল ধসে যাচ্ছে। অসংখ্য কাজই করা যাচ্ছে সশরীরে উপস্থিত না থেকে, স্পর্শবিহীনভাবে। এটাই এখন বৈশ্বিক বাস্তবতা, যার ছোঁয়া লেগেছে আমাদের জাতীয় ও দৈনন্দিন জীবনে। ২০১৪ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে সিঙ্গাপুর পৃথিবীর প্রথম স্মার্ট জাতি হিসেবে যাত্রা শুরু করে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি, যেমনÑ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এনএলপি, সেন্সর, রোবটিক্স, আরোপিত বাস্তবতা (এআর), ভার্চুয়াল বাস্তবতা (ভিআর), ইন্টারনেট অব থিংস, ডাটা অ্যানালিটিকস, ব্লক চেইন ইত্যাদি জাতীয়ভাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। স্মার্ট জাতি রূপান্তরের প্রধান লক্ষ্য ছিল সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, সিঙ্গাপুরবাসীদের জীবনমান বৃদ্ধি, দেশের মেধা দেশে রাখা এবং বিদেশি মেধাকে সিঙ্গাপুরে আকর্ষণ করা। সিঙ্গাপুর স্মার্ট জাতি হওয়ার চেষ্টায় তিনটি মূলস্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এগুলো হচ্ছেÑ ডিজিটাল অর্থনীতি, ডিজিটাল সরকার এবং ডিজিটাল সমাজ।

ডিজিটাল দুনিয়ায় বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন এবং উৎপাদন ব্যবস্থা বদলে যাচ্ছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনবলকে এই পরিবর্তনের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। ডিজিটাল সরকার স্মার্ট জাতি তৈরির অন্যতম নিয়ামক। প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তির সুবিধা ভোগ করবে এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত হবে, স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ বোধ করবে। ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষা স্মার্ট জাতি গঠনের অন্যতম চাবিকাঠি। নাগরিকদের প্রত্যেকে প্রযুক্তি ব্যবহারের সম-অধিকার ভোগ করবে এবং প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে এবং প্রযুক্তির নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকবে। অর্থাৎ ই-সিটিজেন, ই-ইকোনমি, ই-গভর্নমেন্ট, ই-সোসাইটির সম্মিলিত ফলই হচ্ছে স্মার্ট রাষ্ট্র। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ যেমন আজকের বাস্তবতা, স্মার্ট বাংলাদেশও তেমনি আগামীর অনিবার্যতা।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত