শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করার মত এত বড় সু-মহান অর্জন পৃথিবীতে বিরল। এই অর্জন আমাদের দেশের ইতিহাসকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। অন্যায়ের কাছে নত না হয়ে বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াইয়ের মাইলফলক সৃষ্টি করেছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি যে দিনটিকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করছি সে দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য গৌরব উজ্জ্বল দিন। ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ ভালোবাসার গণ্ডি পেরিয়ে অরুণোদয়ের মূর্তপ্রতীক হয়ে আছে। দেশ ও দশকে ভালোবেসে জীবন বিসর্জন দেওয়ার শিক্ষা এর মর্মবস্তুতে নিহিত আছে।
সকল কুৎসিত সাধনার জিঞ্জির ভেঙে ও অন্যায়ের বুহ্য ভেদ করে শির উচু করে বাঁচার প্রেরণা যোগায় শিক্ষা। এছাড়া যুক্তির কষ্ঠিপাথরে যাচাই-বাছাই করে সত্য-সুন্দরের জয়ধ্বনি করার সাহস ও শক্তি যোগায় শিক্ষা। সেজন্য সকল স্বৈরশাসক জনগণকে শিক্ষার আলো এবং উত্তাপ থেকে বঞ্চিত করতে নয়া নয়া ফন্দি আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে। ইংরেজ শাসকরা আমাদের এমন শিক্ষা দিতে চেয়েছে যার মধ্য দিয়ে রক্তে-মাংসে ভারতীয় থাকলেও শিক্ষা এবং রুচিতে হবে ব্রিটিশ। এই রকম শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দিয়ে তারা ভারতবাসীকে শাসন করেছে। ইংরেজ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান; ক্ষমতা দখলের দুই মাসের মাথায় শিক্ষার উপরই আঘাত হানতে শিক্ষা সচিব এস.এম. শরীফের নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। সে কমিশনে বলা হয়েছে সস্তায় শিক্ষা পাওয়া যাবে না। যেমন দাম তেমন জিনিস। অর্থাৎ আলু-পটলের ন্যায় শিক্ষাকে কিনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলেম সৃষ্টির কাজ করবে। তার প্রতিবাদে ১৯৬২ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর পুলিশের গুলিতে জীবন দেন মোস্তফা, বাবুল, ওয়াজিউল্লাহসহ অনেকে। তার-ই ধারাবাহিকতায় স্বৈরাচার এরশাদ মজিদ খান শিক্ষা কমিশন গঠন করে আমাদের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিতে চাইলো। কিন্তু এই বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে স্বৈরশাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়ে ধরণীকে জঞ্জাল মুক্ত করেছে এবং শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে।
কী ছিল সেই শিক্ষানীতিতে? যার জন্য মানুষ জীবন দিতে গেল। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলেও দেশের মানুষের মৌলিক ও মানবিক অধিকারের নিশ্চয়তা আসেনি। ক্ষমতা দখলের মদমত্তায় কখনো সামরিক, কখনো বেসামরিক শাসকদের দ্বারা স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা হতে থাকে। জনগণের স্বার্থ বা দেশগঠন গৌণ উপরন্তু যেকোনো উপায়ে ক্ষমতা দখল করাই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াল। এদেশের মানুষ বারবার সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হতে থাকল। তেমনি এক পালাবদলে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে। ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক মাসের মাথায় তিনি শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। তার শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের নেতৃত্বে একটা শিক্ষা কমিশন গঠন করে শিক্ষানীতি প্রণয়নের প্রস্তাব পেশ করে। সে শিক্ষানীতিতে বলা হলো The post-secondary education would be highly selective and free in order of merit or on minimum 50% cost basis. অর্থাৎ উচ্চশিক্ষাটা হবে সীমিত, যারা মেধাবী তাদের জন্য ফ্রি অথবা ৫০ ভাগ ব্যয় বহন করতে পারবে যারা তারা উচ্চশিক্ষা পাবে। শিক্ষার্থীরা এ রকম গণবিরোধী সিদ্ধান্তের তিব্র প্রতিবাদ জনায়। কারণ মেধার কথা বা পঞ্চাশ ভাগ ব্যয় নির্বাহের কথা বলা মানে আমাদের দেশের যে অর্থনৈতিক বৈষম্য আছে তাকে স্থায়ী করে দেওয়া।
অন্যদিকে ওই কমিশনে বিজ্ঞান শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করে এবং ধর্মীয় কূপমণ্ডুক শিক্ষাকে উৎসাহিত করা হয়। পাশাপাশি প্রথম শ্রেণি থেকে আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করা হয়। শিক্ষার্থীরা মজিদ খান কমিশনের গণবিরোধী এই নীতিকে প্রতাখ্যান করে তার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। মজিদ খানের এই কুখ্যাত শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দি ছাত্রদের মুক্তি ও দমননীতি বন্ধ, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের দাবিতে সচিবালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল ও ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মিছিল সচিবালয়ের দিকে এগুতে থাকে। এ যেন জনতার সমুদ্রের ঊর্মিমালা অপূর্ব শৃঙ্খলায় এগিয়ে চলছে। কিন্তু হাইকোর্টের সামনে পুলিশি বাধার মুখে পড়ে। এবং বিনা উস্কানিতে বিশ্ব বেহায়া এরশাদের পেটুয়া পুলিশ বাহিনি বেপরোয়া হিংস্র নেকড়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনরত নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদর উপর। নির্দয় পাষাণ দানবের মত রঙিন গরম পানি ছুঁড়তে থাকে, তারপর লাঠিচার্জ ও এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ করতে থাকে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী জয়নাল গুলিবিদ্ধ হয়। তারপর তাকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়। দিপালী সাহার লাশ গুম করে ফেলে। প্রায় পঞ্চাশেরও অধিক লাশ গুম করে ফেলে। গণহারে গ্রেপ্তার করা শুরু করে। সরকারি প্রেসনোটে বলছে ১৩৩১জন গ্রেপ্তার হয়। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি শহরে-গ্রামে, জনপদে। মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে। দীর্ঘদিনের চাপা পড়া ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ শিক্ষার্থীদের হাতেই প্রথম জ¦লে উঠে। চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালায় তাতে নিহত হন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী কাঞ্চন। কাঞ্চনের মৃত্যু বারুদে আগুন দেওয়ার মত বিস্ফোরণ তৈরি করে। শিক্ষার্থীদর আন্দোলন জনবিক্ষোভে ফুঁসে উঠে। মানুষ স্বৈরাচার সরকারকে ধিক্কার জানাতে থাকে। জনমতের চাপে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা ভাষার দাবি আদায় করলাম। এ ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষার সর্বজনীন অধিকারের দাবি আদায় হলো ।
স্বৈরাচার তার শাসন ক্ষমতাকে নির্বিঘ্নে পরিচালনা করতে হুমকি মনে করে জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে। আর জনগণকে বিছিন্ন বিক্ষিপ্ত করা ও অন্ধত্ববাদ দ্বারা পরিচালিত করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তোলা যাতে সহজেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মগজ ধোলাই করে নিজেদের অনুগত বাহিনী বানানোর যায়। ‘রাজার কথায় উঠি বসি, রাজার কথায় কান্দি হাসি’ এই মনস্তত্ত্ব সর্বত্র গড়ে উঠে। অন্যদিকে মুক্তিকামী মানুষ শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপোসহীন লড়াই পরিচালনা করে। সেই লড়াইয়ের অন্যতম পীঠস্থান এই বাংলাদেশ। ১৯৮৩ সালে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে শিক্ষার সর্বজনীন দাবি আদায় হলেও তার বাস্তবায়ন আজো হয়নি। বছরে ছত্রিশ লক্ষ শিশু জন্মগ্রহণ করলেও প্রাথমিক বিদ্যালয় পার হতে পারে মাত্র বাইশ লাখ শিশু। উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে তার ৪-৫ ভাগ। শিক্ষার সর্বজনীন অধিকার প্রতিষ্ঠার এমন মহত্তম সংগ্রামের ইতিহাসকে ফুল, চকলেট, জুয়েলারি ও গিফট আইটেমের রমরমা বাণিজ্যের আড়ালে ঢেকে দেওয়ার হয়েছে।
১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে গোটা দুনিয়াতে তিনটা C দিয়ে চিহিৃত করা হয়। এক. Culture সংস্কৃতিতে একটা ধস নামাও। দুই. Commerciality বাণিজ্যকে অবারিত কর। তিন. Christianity খিস্টান ধর্মকে প্রমোট কর। ভালোবাসা মানুষের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে এটাই স্বাভাবিক। আজ চটকদার বিজ্ঞাপনে আছন্ন রেখে বাণিজ্যকে নিরবিচ্ছিন্ন করতে ভালোবাসাকে হাতিয়ার করা হয়েছে। গোটা দুনিয়ায় তার পিছনে ছুটছে। কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসা কি? গৌতম বুদ্ধের মতে When you like a flower, you just pluck it. But when you love a flower, you water it daily.
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক