শনিবার ১৬ আগস্ট ২০২৫ ১ ভাদ্র ১৪৩২
শনিবার ১৬ আগস্ট ২০২৫
বাংলাভাষা ও বাঙালির আন্দোলন
আব্দুল্লাহ আল-মামুন
প্রকাশ: শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৫:২২ PM আপডেট: ১৮.০২.২০২৩ ৫:৪১ PM

মূলত ভাষা আন্দোলনে সফলতার পরই বাঙালির স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের পালে হাওয়া লাগে। এই আন্দোলন বাংলার মাটিতে এমন এক সংগ্রামের বীজ বপন করে দেয়, যা পরবর্তীকালের আন্দোলন-সংগ্রামগুলোতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় কাজ করে।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর যে সংবিধান প্রণীত হয়, তা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলাভাষায় প্রণীত সংবিধান। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা তিনি পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বসভায় বাংলাকে এর আগে কেউ এভাবে তুলে ধরেননি।

বাঙালি জাতির প্রকৃত ভিত্তিসূত্র বাংলা ভাষা।‘অমর একুশ’-এর সূত্র ধরে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং বাঙালি জাতিকে গৌরবান্বিত করার শ্রেষ্ঠ সন্তানের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঐতিহাসিকভাবে বাংলা যেমন শোষিত শ্রেণির ভাষা, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনও আজীবন শোষিত শ্রেণির মুক্তির জন্য লড়াই করা। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও বাংলাদেশের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এমনি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে একটি ভিন্ন অন্যটি কল্পনারও বাইরে। ভাষা আন্দোলনের পটভূমি বেশ দীর্ঘ। এই আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে কলকাতায় একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। এতে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালের ৬-৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন আহ্বান করা হয়। ঐ সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেন সেই দিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা-সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হোক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক’(‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ গাজীউল হক, ভাষাসংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু, পৃষ্ঠা-৯)।

শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগ ও স্বাক্ষরে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নামে ১৯৪৮ সালের ১৩ জানুয়ারি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার জন্য একটি লিফলেট প্রচার করা হয়। এই লিফলেট সম্পর্কে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘I have the honor to report the particulars of the members of the Provisional Organizing committee of East Pakistan Muslim Students League as follow. They were the signatories the leaflet which advocated Bengli to the State Language for Pakistan.’

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘Sheikh Mujibur Rahman, who was one of the signatories of the leaflet which advocated Bengali to be the Students League of Pakistan.’ (Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation BANGABANDHU SHEIKH MUJIBUR RAHMAN,VOL-১ (১৯৪৮-১৯৫০), Sheikh Hasina(ed.)

১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিসের আহ্বানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। এ ধর্মঘটে শেখ মুজিবুর রহমান সাহসী ভূমিকা রাখেন। মিছিলের সব ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এই হরতালে তরুণ শেখ মুজিব নেতৃত্ব দেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছিল আট দফা চুক্তি। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে প্রথম বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক শেখ মুজিবসহ অন্য ভাষাসৈনিকরা কারামুক্ত হন। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা ভাষার আন্দোলন সমগ্র পূর্ব বাংলায় একটি গণ-আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। জনসভা, মিছিল আর স্লোগানে সমগ্র বাংলা মায়ের মাটি যেন প্রকম্পিত হতে লাগল! রাস্তায়, দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর নেতৃত্বে উপস্থিত ছাত্র-জনতা তীব্র প্রতিবাদ করেন (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-৯৯)।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ও ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, আব্দুস সালাম, অলিউল্লাহ (মতান্তরে ওহিউল্লাহ) প্রমুখ। বহু নেতা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। প্রতিবাদে সারা বাংলায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২৭ এপ্রিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। সেদিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আরমানীটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন বজ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আজ পাকিস্তান সরকারের সম্মুখে শুধুমাত্র দুইটি পথ খোলা রহিয়াছে হয় তাঁহারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে মানিয়া লইবেন, নতুবা গদি ছাড়িবেন’ (বাংলাদেশ : প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বিবৃতি, বাণী, নির্দেশ ও সাক্ষাৎকার, শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি, পৃষ্ঠা-১১৭)।

মূলত ভাষা আন্দোলনে সফলতার পরই বাঙালির স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের পালে হাওয়া লাগে। এই আন্দোলন বাংলার মাটিতে এমন এক সংগ্রামের বীজ বপন করে দেয়, যা পরবর্তীকালের আন্দোলন-সংগ্রামগুলোতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় কাজ করে! স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর যে সংবিধান প্রণীত হয়, তা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা তিনি পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বসভায় বাংলাকে এর আগে কেউ এভাবে তুলে ধরেননি। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন তারই সুযোগ্য কন্যা ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে ১৯৯৬ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের ৫১তম অধিবেশনে প্রথম বাংলায় বক্তব্য দেন। এর পর থেকে তিনি প্রতি বছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় বক্তব্য প্রদান করে আসছেন।

ভাষাশহিদদের স্মৃতি চিরস্মরণীয় করে রাখতে তিনি ২০১০ সালে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের দ্বিতীয় তলায় ভাষা আন্দোলন জাদুঘর (Language Movement Museum) উদ্বোধন করেন।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্বে মাতৃভাষার জন্য সেদিন যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল, সে চেতনায় ধাবিত হয়ে বাংলার মানুষ আজ অর্জন করছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাংলা ভাষায় প্রদত্ত তার ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেসকোর

ঐতিহাসিক দলিলের (UNESCO added the Memory of the World Register as a Documentary Heritage)স্বীকৃতি পেয়েছে।

বর্তমানে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রে পালিত হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের প্রথম ভাষা বা মাতৃভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষামাধ্যম হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে। পৃথিবীর বহু দেশে এ ভাষার অনুশীলন হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তিতেও বাংলার ব্যবহার বেড়েছে। এখন বাংলা ভাষায় তৈরি হচ্ছে নানা রকম অ্যাপ্লিকেশন। এসব অ্যাপস স্মার্টফোন কিংবা ট্যাবলেট কম্পিউটারে সহজেই ব্যবহার করা যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, বাংলা ভাষার চেতনাকে বুকে ধারণ করেছিলেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তার মতো এমন মহানায়ক আর কে আছেন বাংলায়! ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘...ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা’ (বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, তথ্য মন্ত্রণালয়, পৃষ্ঠা-২০)। তাই তো বঙ্গবন্ধু, বাংলা ভাষা ও বাঙালির আন্দোলন অবিচ্ছেদ্য।

লেখক : পুলিশ সুপার, চুয়াডাঙ্গা

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত