সোমবার ৩০ জুন ২০২৫ ১৬ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ৩০ জুন ২০২৫
প্রয়াণ দিবসে আহমদ শরীফের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
শায়েখ আরেফিন
প্রকাশ: শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৫:৩০ PM
বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত গবেষক, পণ্ডিত, বিদগ্ধ লেখক-চিন্তাবিদ, আলোচিত-সমালোচিত-বিতর্কিত দ্রোহী ব্যক্তিত্ব ও আমূল দার্শনিক আহমদ শরীফের মৃত্যুদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি। তাঁর জন্ম ১৯২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, মৃত্যু ১৯৯৯ সালের এইদিনে, ২৪ ফেব্রুয়ারি।

ড. আহমদ শরীফ দীর্ঘসময় (১৯৫০-১৯৮৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন, অধ্যাপনা করেছেন বাংলা বিভাগে। এর আগে অল্প সময়ের জন্য দুর্নীতি দমন বিভাগে, সংবাদপত্রে ও বেতারে কাজ করেছেন; কয়েকটি কলেজেও শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৬৭ সালে ‘সৈয়দ সুলতান, তাঁর যুগ ও গ্রন্থাবলী’ গবেষণা গ্রন্থ রচনা করে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৮তে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘বিচিত চিন্তা’। তারপর থেকে প্রকাশিত হতে থাকে একের এক গ্রন্থ। তাঁর বিশেষ দখল ছিল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে; বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বাংলার উভয় অংশ মিলিয়েই অপ্রতিদ্বন্দ্বী তিনি; এক্ষেত্রে তিনি নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যেখানে আছেন শুধু তিনি আর পাশে তাঁর বই, অন্য কেউ নেই সেখানে।

সাহিত্য, ভাষা, দেশ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন, নৃতত্ত্ব, রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম বিষয়ে নিরন্তর লিখেছেন আহমদ শরীফ। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিনিষ্ঠ, প্রগতিশীল লেখক; সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, স্বৈরতন্ত্রের তীব্র সমালোচক। বিংশশতকে বাংলা ভূখণ্ডে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাত থেকে সমাজকে প্রগতির দিকে নিয়ে যেতে যে-কজন হাতেগোনা মুক্তমনা মানুষ সংগ্রাম ক'রে গেছেন, আহমদ শরীফ তাঁদের পুরোধা, প্রাগ্রসর।

আহমদ শরীফ শুধু বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই নয়, ঐতিহাসিকভাবেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ভূখণ্ডের নাম বঙ্গ, বাংলা, পূর্ববঙ্গ, পূর্বপাকিস্তান হয়ে হয়েছে আজকের বাংলাদেশ; এই ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ড. আহমদ শরীফ। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের পর অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার (সংক্ষেপে বলা হতো ‘অপূর্ব সংসদ’) প্রথম লিখিত আকারে স্বাধীনতার প্রথম ইশতেহার প্রকাশ করেছিল যা রচনা করেছিলেন আহমদ শরীফ। ইশতেহারে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নাম ‘বাংলাদেশ’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত করার প্রস্তাব করেন। রাজনীতিবিদগণ পরে তা বক্তৃতা, আলোচনায় ব্যবহার করতে থাকেন এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন করেন।

লেখক হুমায়ুন আজাদের শিক্ষক ছিলেন আহমদ শরীফ। শিক্ষকের মৃত্যুর পর তিনি স্মৃতিচারণ করে লিখেছিলেন একটি লেখা ‘ডক্টর আহমদ শরীফ : বামনের দেশে মহাকায়’। তাঁর লেখা থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি- ‘আমরা তুচ্ছদের মৃত্যু নিয়ে মাতামাতি করতে অভ্যস্ত। ডক্টর আহমদ শরীফের মতো মহান মানুষদের মৃত্যু হচ্ছে নীরবে অনুপস্থিতি, মূর্খ রাষ্ট্র তা বুঝেও উঠবে না, এতোটা মগজ নেই রাষ্ট্র ও জনগণের; কিন্তু যতোই সময় কাটবে, ততোই বড়ো হয়ে দেখা দেবে এই মৃত্যু। এই মৃত্যুতে পতাকা অর্ধনমিত হয় না, সম্পূর্ণ নমিত হয় হৃদয় ও মনন।...অনেক 'বিশিষ্ট' ব্যক্তি আর 'সর্বজনশ্রদ্ধেয়' আমি দেখেছি, দেখে দেখে চোখ অন্ধ হয়ে গেছে অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, কবি, ঔপন্যাসিক, আচার্য, উপাচার্য, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি, সেনাপতি ও আরো অনেক; দূর থেকে চোখে বিভ্রম জাগে, তাঁদের বেশ বড়ো দেখায়,  কাছে থেকে ধরা পড়ে তাঁরা বামন মাত্র। এমন অনেক বিখ্যাত বামনের ক্ষণিক সংস্পর্শে আমি এসেছি, বুঝতে পেরেছি এটা বামনের দেশ। একজনকেই মনে হয়েছে বামনের দেশে মহাকায়, তিনি ডক্টর আহমদ শরীফ; পর্বতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন সমতলভূমিতে, মাথা গিয়ে ঠেকেছিলো মেঘে ও নীলে।...এদেশে পণ্ডিত বলতে যে-অপরিচ্ছন্ন দীর্ঘ পাঞ্জাবি পাজামা টুপি দাড়ি ব্যাগ বোঝায়, তা ছিলো না তাঁর মধ্যে; পোশাকে আচরণে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল আধুনিক।’

জনপ্রিয় হওয়াকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন আহমদ শরীফ। জনপ্রিয় হওয়ার জন্য যে-স্তরে নামতে হয় এবং বিসর্জন দিতে হয় স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা, তা তিনি চাননি। জীবনে চর্চিত স্বঘোষিত নাস্তিক আহমদ শরীফ মৃত্যুতেও অস্বীকার করে গেছেন ধর্মকে। তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন জানাজা, কবর। মৃতদেহ দান করেছেন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের শিক্ষার উপকরণ হিসেবে। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী একটি কর্নিয়া স্থাপন করা হয়েছে এক অন্ধ কোরানে-হাফেজের চক্ষুকোটরে। মৃত্যুর পরও যেন তিনি ধর্মকে করে তুলেছেন উপহাস্য, হাস্যস্পদ আর ধর্মানুসারীদের করে তুলেছেন পরিহাস্য। আহমদ শরীফ অস্বীকার করেছেন পুণ্যলোক, প্রেতলোক, দেবলোক, বিধি, বিধাতা, পূর্বকাল, পরকাল সবকিছু।

ধর্মকে বাদ দিয়ে মানবতার কথা বলতে অনেকদিন পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসেনি। একজন এসেছিলেন হঠাৎ, যিনি একাই একটা সংগঠন, একটা প্রতিষ্ঠান, একটা আন্দোলন, একটা অধ্যায়। তিনি আহমদ শরীফ। সাহস, চিন্তা ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ে উন্মোচন করেছেন অজ্ঞতা মূর্খতার রূপ, নির্মাণ করে দিয়ে গেছেন চিন্তার নতুন গতিপথ ও ভবিষ্য লড়াইয়ের ভিত্তি। লেখায় জ্ঞানগত দায়বদ্ধতা তাঁকে আমৃত্যু সক্রিয় রেখেছিল। তাঁর গ্রন্থরাজি আজও ব্যাপক পরিচিতি পায়নি, এ সমাজ তাঁর গ্রন্থ পাঠের উপযোগী হয়নি এখনো। ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে, তাঁর গ্রন্থপুঞ্জ দূরে দীপ্যমান, আগামীর মুক্তচিন্তা বিকাশে অসামান্য অবদান রাখবে।

লেখক : সমালোচক ও বিশ্লেষক 

বাবু/জেএম

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


Also News   Subject:  শ্রদ্ধাঞ্জলি  







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত