মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম (এসপি মাহবুব নামে পরিচিত) পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তা হয়েও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে ভর্তি হন, এ সময় তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি তৎকালীন ঢাকা হল (শহীদুল্লাহ হল) ভিপি নির্বাচিত হন। তিনি আট নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদাহসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পাঁচটি সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বীর বিক্রম খেতাব অর্জন করেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি ছিলেন ঢাকা জেলার প্রথম পুলিশ সুপার (এসপি) ও জেলা প্রশাসক (ডিসি)। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে এবং দেশ স্বাধীনের পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে তাঁর। তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কয়েকটি বইও লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য বইগুলো হল ‘স্মৃতির পাতায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব গাঁথা’, ‘ বঙ্গবন্ধুকে যেমন দেখেছি’ ও ‘কুষ্টিয়ার জনযুদ্ধ’। তিনি কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে চিনলেন, জানলেন এবং বঙ্গবন্ধু কেমন মানুষ ছিলেন এ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন দৈনিক বাংলাদেশ বুলেটিন-এর সাথে। তার আলাপচারিতার সার-সংক্ষেপ তুলে ধরেছেন ইমামুল ইসলাম।
বাংলাদেশ বুলেটিন : কেমন আছেন আপনি? বাংলাদেশ বুলেটিনের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি শুভকামনা।
মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম : জি ভালো আছি। আপনার জন্যেও শুভকামনা।
বাংলাদেশ বুলেটিন : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার কখন, কীভাবে এবং কোথায় সাক্ষাৎ হয়?
মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম : ১৯৬৪ সালে আমি যখন ঢাকা হলের (শহীদুল্লাহ হল) সহসভাপতি ছিলাম তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের জন্য তিনি তিন নেতার মাজারে আসেন। এখানেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তখন তিনি আমাদেরকে কিছু দিকনির্দেশনামূলক কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে বলেন, ‘সামনে কঠিন সময় আসছে, তোমরা প্রস্তুত থেকো।’ এ সময় ছাত্রলীগের অনেক বড় বড় নেতারা ছিলেন। তাদের সামনেই বঙ্গবন্ধু এমন নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ বুলেটিন : প্রথমবার সাক্ষাতের পরে বঙ্গবন্ধুর পরে আবার কখন আপনার সঙ্গে কোথায় সাক্ষাৎ হয়েছে?
মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম : বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি গণ-অভ্যুত্থানের ফলে জেল থেকে মুক্তি পান। ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে বিশাল জনসভায় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়। এ সময় আমি পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের এডিসি হিসেবে কাজ করি। গভর্নর ছিলেন একেএম আহসান। একেএম আহসান আমাকে একটা গুরুদায়িত্ব দিলেন গভর্নর হাউসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার জন্যে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে একেএম আহসান অন্যান্য গভর্নরের চেয়ে অনেকটা উদার ছিলেন। ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী ও নেতা থাকার কারণে এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকার ফলে এ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আমার কাঁধে পড়ে। ২৩ কিংবা ২৪ ফেব্রুয়ারি রাত তিনটায় বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসা থেকে গাড়িতে করে গভর্নর হাউসে নিয়ে আসি। এরপর খুব ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে আমি তাঁর বাসায় পৌঁছে দেই। বঙ্গবন্ধু এবং একেএম আহসানের মধ্যে কী আলাপচারিতা হয়েছে তা তখন জানতে পারিনি। পরে জানতে পেরেছি একেএম আহসান পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সমঝোতা করার জন্য ডেকেছেন।
বাংলাদেশ বুলেটিন : বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আপনাকে কীভাবে অণুপ্রেরণা দিয়েছিল। তাঁর এ ভাষণ নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?
মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম : একাত্তরের ৩০ জানুয়ারি আমি চট্টগ্রামের সাতকানিয়াতে চলে যাই। এখানেই আমি ৭ মার্চ পর্যন্ত অবস্থান করি। ৮ মার্চ আমি ঢাকায় এসে ১৭ মার্চ পর্যন্ত আমি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে অবস্থান করি। তবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ দেশ স্বাধীনের সবুজসংকেত দিয়েছে। এ ভাষণের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই পরিচালিত হয়; এমন বার্তা প্রতিটি বাঙালির কাছে পৌঁছে যায়। এ ভাষণের আরেকটি তাৎপর্য ছিল এ ভাষণ শুনে ধনী-গরিব, মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, কৃষক-শ্রমিক, শিক্ষক-ছাত্র-জনতা সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হন। অর্থাৎ বাঙালি এ ভাষণেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সসস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়। এ বার্তা পেয়ে আমি ১৮ মার্চ ঝিনাইদাহ চলে যাই এবং সেখানে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সসস্ত্র সংগ্রামের জন্য জনমত গঠন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেই।
বাংলাদেশ বুলেটিন : মুক্তিযুদ্ধ শেষে কবে ঢাকায় ফিরে আসেন এবং কখন আবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ?
মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম : যুদ্ধ শেষে ২৮ ডিসেম্বর ঢাকায় এসে তৎকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সচিব এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের খানের নিকট রিপোর্ট করি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেন। তাঁর দেশে ফেরার একদিন কিংবা দু’দিন পরে অর্থাৎ ১১ বা ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বাসভবনে আমার আবার সাক্ষাৎ হয়। দীর্ঘদিন পাকিস্তানে কারাভোগের ছাপ বঙ্গবন্ধুর শরীরে দেখা গেলেও তাঁর মনোবল ছিল দৃঢ় এবং অটুট। আমাকে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই এখনো বেঁচে আছিস।’ আমি বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নের উত্তরে হেসে বললাম, ‘আল্লায় বাঁচায়ে রাখছে।’
বাংলাদেশ বুলেটিন : বঙ্গবন্ধু আপনাকে কোনো বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন এবং আপনার জীবন চলার পথে আপনাকে বঙ্গবন্ধু কোনো উপদেশ দিয়েছেন?
মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম : ১৯৭৩ সালে ১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে পাঠালেন। তখন হোম মিনিস্টার আব্দুল মান্নান এবং বঙ্গবন্ধুর পিএস ফরাস উদ্দিন। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ‘তোকে ঢাকার এসপি হতে হবে।’ আমি তখন ডেপুটি সেক্রেটারি। বঙ্গবন্ধুকে বললাম, ‘আমি এখন ডেপুটি সেক্রেটারি, আমি এসপি (এ পদ তখন ডেপুটি সেক্রেটারির নিচে) হব কেন?’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি বলছি তোকেই ঢাকার এসপি হতে হবে, ঢাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তোকেই দরকার।’ বঙ্গবন্ধুর এ কথার প্রেক্ষিতে আমি বললাম, ‘আমারও একটা কথা আছে।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কী কথা?’ আমি বললাম, ‘আপনার অনুসারীরা যেন আমার পেছনে না লাগে (তৎকালীন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফাসহ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন)।’ এ সময় বঙ্গবন্ধু উপস্থিত কয়েক জনকে বললেন, ‘কেউ ওর সাথে লাগবি না।’ এরপর বঙ্গবন্ধু সবাইকে চলে যেতে এবং আমাকে থাকতে বললেন। তখন বঙ্গবন্ধু আমাকে একটা উপদেশ দিয়ে বললেন, ‘ভালোভাবে চাকরি করবি। কিন্তু ঘুষ,
বাংলাদেশ বুলেটিন : পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এ হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আবারো পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়। এ বিষয় নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম : বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু আমরা অভিভাবক হারাইনি। বাংলাদেশ তার স্থপতিকে হারিয়েছে, বিশ্বের নিপীড়িত মানুষ হারিয়েছে তাদের এ মহান নেতাকে। বঙ্গবন্ধু শুধুই বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা নন, তিনি বিশ্বনেতা; তাঁর নেতৃত্বগুণ, মানবিকতা, রাজনৈতিক দর্শন, সাদামাটা জীবনাচারণ এবং মানুষকে নির্মোহ ভালোবাসা আজও বিশ্বাঙ্গনে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করছে। বিশ্বনেতৃত্ব তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষা অনুসরণ-অনুকরণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের এ পলল ভূমিতে প্রজন্মের ভিত নির্মাণে বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছেন তা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতেই তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী চেতনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এখনো চলমান। আমরা অহর্নিশ মুক্তিযুদ্ধ করছি, মুক্তিযুদ্ধ এখনো চলমান।
বাংলাদেশ বুলেটিন : বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর আপনাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। এ নিয়ে কিছু বলবেন?
মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম : বঙ্গবন্ধুকে হত্যার রাতেই আমাকে আটক করা হয়। প্রায় একমাস নির্যাতন শেষে আমাকে ১৮ সেপ্টেম্বর জেলহাজতে পাঠানো হয়। আমার চোখের সামনে ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হল। পরে আমি তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে মুক্তি পাই কিন্তু চাকরি আর ফিরে পাইনি।
বাংলাদেশ বুলেটিন : বাংলাদেশ বুলেটিনকে সময় দেওয়ার জন্য আপনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম : আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
বাবু/জেএম