গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো একটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনমুখী হতে হয়। কেননা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার একমাত্র পথ হলো নির্বাচন ব্যবস্থা। নির্বাচনের ধারাবাহিকতা যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুসংহত থাকার পূর্বশর্ত। আর এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনমুখী হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। এক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী দল বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এ মৌলিক দায়িত্বটি পালনে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ।
বিশেষভাবে বিএনপির নির্বাচনবিমুখী আচরণ দেশের গণতন্ত্রের জন্য কিছুটা হলেও অমঙ্গলজনক। বিএনপির নির্বাচনহীন এ আচরণ কার্যত দেশ এবং জনগণ কিংবা মোটাদাগে গণতন্ত্রের সাথে প্রতারণার শামিল। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের মধ্যে দিয়ে বিএনপি দেশে একটি রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছে। যা-ই হোক, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এবারে নির্বাচনের হাওয়া একটু আগে থেকেই বইতে শুরু করেছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিসহ সরকার বিরোধীদলগুলো রাজনীতির মাঠকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার বিরোধীদেও নেতৃত্বে রয়েছে বিএনপি। দেশের রাজনৈতিক ব্যাপারে যারা অভিজ্ঞ তারা মনে করেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের বেশ পূর্বেই নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করার মূল কারণ হলো আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ দেশের রাজনীতিতে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে কিংবা নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হলে দেশের রাজনীতিতে তাদের অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হবে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে। কিন্তু বিএনপির বর্তমান সাংগঠনিক যে অবস্থা তার প্রেক্ষিতে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও তারা নির্বাচনে কতটুকু সাফল্য অর্জন করতে পারবেন তা প্রশ্নের দাবি রাখে।
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। যদিও তিনি সরকারের নির্বাহী আদেশে তার নিজ বাসায় অবস্থান করে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। বেগম খালেদা জিয়ার স্বজনদের আবেদন এর প্রেক্ষিতে তার শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে সরকারের বদান্যতার পরিচয়। সুতরাং বর্তমান বাস্তবতায় আইনগতভাবে বেগম জিয়ার পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সম্ভব নয়। দলের দ্বিতীয় প্রধান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও একাধিক ফৌজদারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। সুতরাং তার পক্ষেও বিদ্যমান সংবিধান ও আইনের আলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অসম্ভব। সুতরাং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য তাদেও যে দৃঢ় নেতৃত্বের অভাব রয়েছে তা স্পষ্ট। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও এটি তাদের নির্বাচনী ফলাফলে ভূমিকা রাখবে। তবুও বিএনপি যে রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তাতে করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এর বাইরে তাদের হাতে অন্য কোনো বিকল্প নেই।
বিএনপি ২০১৪ সালের মত নির্বাচন বয়কট করলে নিঃসন্দেহে তারা জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলবে। আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে নির্বাচনকে প্রতিহত করার মত রাজনৈতিক শক্তিও বর্তমানে তাদেও নেই। তাদের রাজনৈতিক শক্তির যে অভাব রয়েছে তার বড় প্রমাণ হলো সাম্প্রতিক সময়ে রাজপথের আন্দোলনে বিএনপির ব্যর্থতা।
তাদের এ আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। কেননা বিএনপির সভা-সমাবেশ কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা যায় না। সুতরাং বিএনপির হাতে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন এ অংশগ্রহণ এর বাইরে কোনো বিকল্প নেই এ কথা বলা অবান্তর নয়। আবার বিএনপি যদি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে তাদের দলের প্রতিনিধিত্ব করবেন কে এটি নিয়ে বড় একটি প্রশ্ন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কি বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করবেন? কিন্তু বিএনপি জন্মলগ্ন থেকেই একটি গ্রুপিং নির্ভর রাজনৈতিক দল। অভ্যন্তরীণ দলাদলি ও কোন্দল বিএনপিতে খুবই স্পষ্ট। এ কারণেই অনেকেই বিএনপিকে রাজনৈতিক দল না বলে স্বার্থান্বেষী মহলের কোনো ‘ক্লাব’ বলে থাকেন। তাদের দলের অনেক সিনিয়র নেতারাই স্বার্থান্বেষী চরিত্র ধারণ করে। সুতরাং তারা যে মির্জা ফখরুলের নেতৃত্ব মেনে নিবেন তাও বলা যায় না। এ বিবেচনা বলা যায় যে, বর্তমানে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এক মহাসংকটে পতিত হয়েছে।
২০০৭ থেকে অর্থাৎ ১৫ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। দীর্ঘ সময় ধরে একটি দল ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং অন্যদিকে দলের শীর্ষ দুই নেতা ফৌজদারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থান অনেকটাই নড়বড়ে। আর নেতৃত্বহীন অবস্থায় বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের নির্বাচনে সাফল্য কী হবে তাও অনুমেয়। বিএনপি নেতারা আশঙ্কা করছেন বিদ্যমান এ বিষয়গুলো সামনে রেখে বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তাদের ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো ভরাডুবি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিগত ১৫ বছওে দেশের যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তাকে মোকাবেলা করার জন্য বিএনপির সামনে কোনো গঠনমূলক রাজনৈতিতে ম্যানিফেস্টো নেই। সুতরাং জনগণ যে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের উপরেই ভরসা রাখবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। বিএনপির নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক এ বাস্তবতাকে অনুমান করতে পেরেই অগণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করছে। তারা দেশে নতুন করে ‘এক এগারো’র মতো একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। তারা তাদের এ নগ্ন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য দেশবিরোধী বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে অহেতুক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে। বিএনপি স্রেফ রাজনৈতিক স্বার্থে সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অমূলক অভিযোগ উত্থাপন করছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কিছু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও বিএনপির এ যোগসাজশের অংশীদার হচ্ছে। আর দেশের ভেতরের সুশীল নামদারী স্বার্থান্বেষী মহলের অপতৎপরতা তো আছেই। কিন্তু বিএনপির এ রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ জনগণের কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট। অপরদিকে বিএনপি আন্তর্জাতিক বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের কাছে ভুল বার্তা দিতে চেষ্টা করছে।
বিএনপি দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে। এগুলো বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। তবে আশার কথা হলো, বিএনপির এ ষড়যন্ত্র জনগণের নিকট ঘৃণাভরে প্রত্যাখিত হচ্ছে। বিএনপি বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জনগনকে সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দেয়ার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে বিএনপির উদ্দেশ্য হলো, দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা দখল করা। কিন্তু বিএনপির এ অগণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার অভিপ্রায় দিবাস্বপ্ন ব্যতিরেকে কিছুই নয়। তাদের ষড়যন্ত্রমূলক এ অভিলাষ কোনো ক্রমেই জনগণের সমর্থন লাভে সক্ষম হবে না। সুতরাং বিএনপির উচিত হবে আগামী নির্বাচনে তাদের সাফল্য কিংবা ভরাডুবির কথা বিবেচনা না করেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। কেননা এ নির্বাচন রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার একটি বড় সুযোগও বটে। এর বিপরীতে বিএনপি যে অগণতান্ত্রিক উপায়ে হাঁটার চেষ্টা করছে তা বিএনপিকে দেশের রাজনৈতিক মাঠ থেকে চিরতরে দূরে সরিয়ে দিবে। সুতরাং আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত একটি দল হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা যেকোনো ধরনের অগণতান্ত্রিকতা বিএনপিকে দেশের রাজনীতি থেকে যোজন যোজন দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে। আর এটি বিএনপি কিংবা বিএনপির নেতাকর্মী কারো জন্যই সুখকর হবে না।
লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
-বাবু/এ.এস