# পকেটভারি ফুটপাতের চাঁদাবাজদের
# পুলিশের দেয়া সুযোগের অপব্যবহার
# মানবিক কারণে বসতে দেয়া হয়েছে, চাঁদাবাজি হলে ব্যবস্থা : পুলিশ
এবারের রমজানে পকেট ভারি হয়েছে ফুটপাতের চাঁদাবাজদের। রমজানের শুরু থেকে পুরো রাজধানী জুড়েই ফুটপাতের পসরা থাকবে ঈদ জুড়ে। আর এখান থেকেই পোয়াবারো। বিভিন্ন হিসাব মতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হবে এসব দোকান থেকে।
তবে সংশ্লিষ্টদের হিসাব মতে ৫০০ কোটি টাকার চাঁদার টাকা অসাধু রাজনৈতিক নেতাকর্মী, পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের লোকজনের পকেটে যায়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কেএম হাফিজ আক্তার বলেন, এবারের রমজানে শুধু মানবিক কারণে হকারদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর বাইরে কেউ এখান থেকে চাঁদাবাজি করলে আমাদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
তিনি আরও বলেন, সারা বছর যেসব হকার ফুটপাতে ব্যবসা করেন তাদের রমজানে উচ্ছেদ করা হবে না। তবে রাস্তার ওপর কোনও হকার বসতে পারবে না।
জানা গেছে, একজন লাইনম্যানের অধীনে একটি করে ‘ফুট’ থাকে। একটি ‘ফুটে’ সর্বোচ্চ ৩০০ হকার বসতে পারে। তাদের একটি করে চৌকির জায়গা (দুই হাত বাই চার হাত) বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে ফুটপাত ছাড়াও সরাসরি রাস্তায়ও হকারদের বসতে দেয়া হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, রমজান মৌসুমে শুধু নিউমার্কেট কেন্দ্রিক চাঁদা তোলা হয় দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। গুলিস্তান কেন্দ্রিক তোলা হয় ১৮ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা। মতিঝিল জোনে তোলা হয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এছাড়া উত্তরা থেকে ১০ লাখ, গাবতলী ১৫ লাখ, মালিবাগ ১০ লাখ, ফার্মগেট থেকে ১০ লাখ ও মিরপুর এলাকায় ৯ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয় প্রতিদিন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শহরে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ হকার আছে। তাদের কাছ থেকে অন্য সময়ে সর্বনিম্ন প্রতিদিন ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা নেয়া হয়। এটা এলাকা এবং দোকানের আকারের ওপর নির্ভর করে। গড়ে কমপক্ষে ৩০০ টাকা চাঁদা আদায় হয় প্রতিদিন প্রতিজন হকারের কাছ থেকে। আর রমজানের এক মাস এই রেট বেড়ে যায়। ঈদকে টার্গেট করে চলতি মাসে ৫০০ কোটি টাকা টার্গেট নিয়ে চাঁদা তোলা হচ্ছে হকারদের কাছ থেকে।
জানা যায়, ঢাকার নিউমার্কেট ও আশপাশের এলাকায় মোট ৫ থেকে ৬ হাজার হকার আছে। এখান থেকে প্রতিদিন চাঁদা আসে কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকা।
হকার ব্যবসায়ী মসলেম উদ্দিন বলেন, মার্কেটের বিষয়গুলো দেখভাল করলেও বাইরের হকারদের সমিতির নেতারাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
কীভাবে চাঁদা তোলা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমত আমরা একজন লাইনম্যান নিয়োগ দিয়ে থাকি। প্রতিটা পয়েন্টে লাইনম্যান রয়েছে। ওই লাইম্যানদের মাধ্যমে চাঁদা তোলা হয়।
তিনি জানান, প্রতিটা দোকানে আলাদা আলাদা স্পেস বরাদ্দ দেয়া আছে। কোনো কোনোটা ৩ ফিট আবার কোনোটা ৬ ফিট। ৩ ফিটের জন্য দৈনিক ৫০০ টাকা। আর ৬ ফিটের জন্য চাঁদা নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার টাকা। এর মধ্যে লাইনম্যানকে আলাদা অর্থ দিতে হয়। বিদ্যুতের লাইন না থাকলেও ‘অবৈধভাবে ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ।’
নিউমার্কেট থেকে ঢাকা কলেজ পর্যন্ত প্রতিদিন ২৫ লাখ টাকা তোলা হয়। তবে ঈদ মৌসুমেই এই চাঁদা তোলা হয়। ঈদের পর কিছুটা কমে আসবে বলে বলেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই চাঁদার টাকা তোলেন সেখানকার প্রভাবশালী নেতারা। আওয়ামী লীগ অফিসের লাগোয়া বিভিন্ন সংগঠনের নামে ওই চাঁদা তোলা হয়।
এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিদিনের চাঁদার টাকা রাখা হয় কয়েকটি ভাগে। একটি ভাগ পান আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। আরেকটি ভাগ পায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। পুলিশের চাঁদার টাকা আওয়ামী লীগ নেতারাই দিয়ে থাকেন।
রাজধানী সুপার মার্কেট থেকে বেল্টপট্রি এলাকা পর্যন্ত ২০০টি দোকানের লাইনম্যান বাবুল ও বকুল। ওই ফুটপাতের একাধিক দোকানদার জানিয়েছেন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় আগে লাইনম্যানরা ১০০ টাকা করে চাঁদা নিয়ে যেত। বর্তমানে ৩০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হচ্ছে। বেঁধে দেয়া রেট অনুযায়ী চাঁদা না দিলে দোকান ভেঙে দেয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন লাইনম্যান জানান, তিনি আগে ফুটপাতে হকারি করতেন। তিনি এখন লাইনম্যান। তার কাজ শুধু হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা। এই টাকার ভাগ স্থানীয় নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের সদস্যদের বণ্টন করতে হয়। এদিক সেদিক করলে ধরপাকড় চালানো হয়।
তিনি আরও জানান, গুলিস্তানে রাজধানী মার্কেটের সামনে ফুটপাতের লাইনম্যানের নাম সুলতান মিয়া, মতিঝিল এলাকার লাইনম্যান মধুমতি সিনেমা হলের টিকেট ব্ল্যাকার যুবলীগ নেতা সাইদ বঙ্গভবন এলাকার লাইনম্যান, ফকিরাপুলে গফুর, দিলকুশায় নুরু মিয়া আর আওয়ামী লীগ অফিসের সামনের অংশে চাঁদা তোলে সালাম। যাত্রাবাড়ীর সাতটি ফুটপাতের সর্দার সোনা মিয়া, ফার্মগেট এলাকায় লাইনম্যান শাহ আলম ও আবদুর রাজ্জাক দুলাল। নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট ও ঢাকা কলেজের সামনের অংশে নিয়ন্ত্রণ করছে হোসেন মিয়া। মিরপুর এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করছে জয়নাল ও আয়নাল। বিমানবন্দর এলাকার ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলে আলী।
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার ফুটপাত একসময় যারা নিয়ন্ত্রণ করতো স্থানীয় কাউন্সিলর। তবে এবার নেপথ্যের কারিগর হিসেবে কাজ করছেন স্থানীয় নেতা।
স্থানীয়রা জানান, ইন্দিরা রোডের ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন দুলাল, সেজান পয়েন্টের সামনে সেলিম, বাটা বাজারের সামনে মোবারক ওরফে জুতা মোবারক, হারুন, ফুটওভারব্রীজের ওপরে জসিম, তেজগাঁও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েল সামনে কালাম, শামসু, আনন্দ সিনেমা হলের সামনে অবৈধ মজমা বসিয়ে স্থানীয় ক্ষদে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিন চাঁদা নেয় হারুন ও হায়দার। এর আগে দোকান প্রতি দৈনিক ৩০০ টাকা চাঁদা তোলা হলেও এবার ঈদকে সামনে রেখে চাঁদার পরিমান বেড়েছে।
ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার কারণে গত দুবছর ব্যবসা করতে পারেননি। এবার ছোট পরিসরে হলেও ব্যবসা শুরু হয়েছে। ঈদ সামনে রেখে স্থানীয় প্রভাবশালীরা যেভাবে টাকা তুলছে তাতে আর সংসারের খরচ মেটানো সম্ভব হবে না। ছেলে মেয়েদের পোশাক কিনে দেওয়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলছে সব ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি এ নিয়ে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে মারধরের শিকার হতে হয়েছে কয়েক ব্যবসায়ীকে।
ডিএমপির একটি সূত্র জানায়, সারা বছর রাজধানীর বিভিন্ন ফুটপাতে ব্যবসা পরিচালনা করেন হকাররা। তাদের উচ্ছেদে অভিযানও চালানো হয় বিভিন্ন সময়। তবে রমজান মাসে বিশেষ দৃষ্টিতে ফুটপাতে ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ দেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। কিন্তু কোনও হকারকে ফুটপাত ছাড়িয়ে রাস্তার ওপর বসতে দেওয়া হবে না। সেই সঙ্গে ফুটপাতে কোনও ইফতার সামগ্রীর দোকানও বসতে দেওয়া হবে না। যারা সিলিন্ডার গ্যাস দিয়ে রাস্তার পাশে ইফতার সামগ্রী বানায় তা বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার ডিসিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ডিএমপি’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষরা রমজান ও ঈদ উপলক্ষে কোনও ধরনের সমস্যার সম্মুখীন যেন না হয় সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ফুটপাতে ব্যবসা পরিচালনা করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফুটপাত থেকে অনেকে কেনাকাটা করেন। তবে ফুটপাত ছেড়ে কোনও ব্যবসায়ী যাতে রাস্তার ওপরে বসতে না পারে সে ব্যাপারে থানা পুলিশকে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর ৫০টি থানায় এই নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
বাবু/এসআর