গত একযুগের মধ্যে পুরো বিশ্বই এখন সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে প্রধানত করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাব, ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য, পরিবহন খরচ ব্যাপক বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা যায়। অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, সারের মূল্যবৃদ্ধির পশাপাশি সরবরাহ কোনোভাবে অপর্যাপ্ত না হয় বা ঘাটতি না পড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। কৃষক ফসল উৎপাদনে যেন সার কম না পায়, সে জায়গা নিশ্চিত করতে হবে। নইলে সারের সংকট হলে উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেটা কৃষক এবং ভোক্তার জন্য দুর্ভাবনার কারণ বেশি হবে। তবে কেউ কেউ বলছেন, উৎপাদন খরচ কিছুটা বাড়লেও খুব বেশি আশঙ্কার কারণ নেই। অবশ্য কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দাম কিছুটা বৃদ্ধির ফলে কৃষকদের মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহারের প্রবণতা কমবে। অপরদিকে দাম ভালো পেলে কৃষকরা তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। সারের দাম বৃদ্ধির আদেশে বলা হয়েছে, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় সারের আমদানি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা এবং সারের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সারের মূল্য পুনঃনির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে কৃষক পর্যায়ে প্রতিকেজি ইউরিয়ার বর্তমান দাম ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা, ডিএপি ১৬ টাকার পরিবর্তে ২১ টাকা, টিএসপি ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা এবং এমওপি ১৫ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়। একইভাবে ডিলার পর্যায়েও প্রতিকেজি ইউরিয়ার বর্তমান দাম ২০ টাকার পরিবর্তে ২৫ টাকা, ডিএপি ১৪ টাকার পরিবর্তে ১৯ টাকা, টিএসপি ২০ টাকার পরিবর্তে ২৫ টাকা এবং এমওপি ১৩ টাকার পরিবর্তে ১৮ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে।
২০২১ সালের অক্টোবওে দেশে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেছিলেন, ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা প্রতিনিয়ত মিটিং করে যাচ্ছি। যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে বলে কথা বলা হচ্ছে, যেমন- তেল, চিনি প্রত্যেকটা পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেড়েছে। তাই আমাদেরও দেশে এর প্রভাব পড়েছে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে গরিব কিংবা স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য টিসিবির মাধ্যমে কম দামে পণ্য বিক্রির চেষ্টা করছি।’ প্রকৃতপক্ষে কেবল টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় নয়, বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত সারের দাম কমিয়ে দেন। ওই সময় সেচকাজে ডিজেল ও বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়া হয়। এতে দ্রুত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং মাত্র পাঁচ বছরে দেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশ আবার আগের খাদ্য ঘাটতি এবং খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক ধারায় ফিরে যায়। পরে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার কৃষি ও কৃষকবান্ধব নীতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন শুরু করে। সার, সেচ, বীজ, বালাইনাশকসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ উৎপাদন, আমদানি, বিতরণসহ সার্বিক ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে। কৃষি উপকরণের দাম যেমন কমিয়েছে, তেমনি সহজলভ্য করে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। দেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বৈশ্বিক বাস্তবতায় দ্রব্যমূল্য কিছুটা বৃদ্ধিও যৌক্তিক কারণও আছে। বিশেষত কোভিড পরিস্থিতির প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সারের মূল্য অস্বাভাবিক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে যা ২০২১ সালের তুলনায় প্রায় তিনগুণ।
তাছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় জাহাজ ভাড়াও প্রায় দুইগুণ পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। তবে আওয়ামী লীগ সরকার সারের উৎপাদন ও আমদানি অব্যাহত রেখেছে। গত ১৩ বছরে সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের কোনো সংকট হয়নি। চলতি (২০২১-২২) অর্থবছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্য বিগত বছরের চেয়ে প্রায় তিনগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেলেও বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার অভ্যন্তরীণ বাজারে অর্থাৎ কৃষক পর্যায়ে সারের মূল্যবৃদ্ধি করেনি। অব্যাহতভাবে ভর্তুকি দিয়ে সুলভ মূল্যে সার সরবরাহের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনের ধারা বজায় রেখেছে। বিএনপির শাসন আমলে সারসহ কৃষি উপকরণের চরম সংকট ছিল। সারের জন্য কৃষকদের জীবন দিতে হয়। সারের জন্য বিএনপি সরকার ১৯৯৫ সালে ১৮ জন কৃষককে গুলি করে হত্যা করে। গত ১৩ বছরে এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় বর্তমানে প্রায় ২৭ (সাতাশ) গুণ বেশি ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কৃষকরা সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন। সরকার ইতোমধ্যেই সয়াবিন তেল আমদানিতে শুল্ক কমিয়েছে। এক কোটি পরিবারের মধ্যে সুলভ মূল্যে পণ্য বিতরণ করছে। রোজার আগে চারটি পণ্য এবং রোজায় মোট ছয়টি পণ্য টিসিবির মাধ্যমে খোলা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। বাজারে অতিরিক্ত মুনাফা ঠেকাতে সক্রিয় করা হয়েছে ভোক্তা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থাকে। মূল্যস্ফীতির ধকল কমাতে বাজার ব্যবস্থায় মনিটরিং আরও জোরদার করা দরকার যাতে করে মানুষ বাজারে যে দামে আসে সেই দামের চেয়ে বহুগুণ বেশি টাকা দিতে না হয়। পণ্য যে মূল্যে আনা হয় আর বাজারে যে মূল্যে থাকা উচিৎ সেটিই যেন থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ মজুতদারি, পণ্য বন্দরে রেখে দেওয়া, লোকাল মার্কেটে (স্থানীয় বাজার) চাঁদাবাজি, পুলিশি হস্থক্ষেপ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে দাম বেড়ে যাওয়া ঠেকালে মানুষ স্বস্তি পাবে।
সারের বাইরেও সরকার অন্যভাবেও প্রণোদনা দিয়েছে কৃষককে। চলতি বোরো মৌসুমে ২৭ লক্ষ কৃষকের জন্য প্রায় ১৭০ কোটি টাকা সমমূল্যের প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক। এর আওতায় দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ৬ লক্ষ ৮৬ হাজার ৭০০ কৃষককে বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে বীজ, সার ও পরিবহন ব্যয় বাবদ নগদ অর্থ সহায়তা। বিশেষ করে খরিপ মৌসুমে গম, ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী, চীনাবাদাম, শীতকালীন মুগ, পেয়াজ, তিল ইত্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেওয়া হয়েছে এই সহায়তা। এর পাশাপাশি দেশের মানুষের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ সুষম খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শস্য বহুমুখীকরণসহ উন্নত ও আধুনিক যন্ত্রকৌশল অবলম্বন, উচ্চফলনশীন ও হাইব্রিড জাত প্রতিস্থাপন, সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজনও জরুরি।
লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
-বাবু/এ.এস