বদলে যাওয়াই ভাষার ধর্ম। ভাষিক যোগাযোগ ও সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের ভাষিক পরিবর্তন সূচিত হয়। কোনো দেশের ভাষা-পরিস্থিতি যদি বহুভাষিক (multi-lingual) বা দ্বিভাষিক (bi-lingual) হয়, তাহলে সে দেশের ভাষাসম্প্রদায় পরস্পর দ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করে এবং তার ফলে উভয় ভাষা থেকে বিভিন্ন শব্দ, উপাদান গৃহীত হতে থাকে; সৃষ্টি হয় এক ভিন্ন ধরনের মিশ্রভাষার। এভাবেই মানুষের প্রয়োজনে পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন সংযোগভাষা (lingua-franca)। আবার এই ভাষাই পরবর্তী পর্যায়ে ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করতে শুরু করে। সাধারণত অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ দেশের সংস্কৃতি দ্বারা অপেক্ষাকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি প্রভাবিত হয়, ফলে ভাষাও বিপন্ন হতে থাকে।
মানুষের ভাষা পরিবর্তনশীল ও বৈচিত্র্যময়। মানুষের মুখে মুখে ভাষা ব্যবহৃত হতে হতে বৈচিত্র্য লাভ করে। বিহারিদের ভাষা ব্যবহারেও বৈচিত্র্য দেখা যায়। শিক্ষা, শ্রেণি, বয়স ও লিঙ্গভেদে বিহারিদের ভাষা ব্যবহারে বৈচিত্র্য দেখা যায়। মূলত তিন প্রজন্মের বিহারিদের ভাষা ব্যবহারের বৈচিত্র্য দেখা যায়। পূর্ব-প্রজন্ম, মধ্য-প্রজন্ম ও আধুনিক প্রজন্ম এই তিন প্রজন্ম শিক্ষার ভিত্তিতে, সামাজিক শ্রেণিবিভেদের ভিত্তিতে, বয়সভেদে এবং লিঙ্গ অর্থাৎ নারী-পুরুষ ভেদে বিহারি ভাষাকে বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশ্রণ ঘটিয়েছে যদিও কখনো এরা নিজেদের ভাষাই ব্যবহার করছে। ফলে বিহারিদের ভাষায় এসেছে বহুমাত্রিক ভাষাবৈচিত্র্য।
বিহারিদের ভাষার মিশ্রণটি ঘটেছে মূলত রাজনৈতিক চাপ, সামাজিক চাপ এবং ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বিহারিদের এদেশে থেকে যাবার ফল হিসাবে আজকে তারা রাজনৈতিক চাপের মধ্যে আছে। ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’ বিহারিদের হয়েছে এমন অবস্থা যে তারা আজ পাকিস্তান বা ভারতেও প্রত্যাশিত নয়, আবার বাংলাদেশেও পরবাসী। রাজনৈতিকভাবে এরা কোনো সরকারের কাছেই গৃহীত হয়নি; ফলে একটা রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে থেকে গেছে বিহারি প্রসঙ্গ। আর এই রাজনৈতিক চাপের ফলে বিহারিদের ভাষার সঙ্গে বাংলাভাষার মিশ্রণ প্রায় অবধারিত ও ত্বরান্বিত হয়েছে।
জাতিগত দাঙ্গার পর যখন বিহারিরা ভাগ্যান্বেষণের উদ্দেশ্যে এদেশে এসে বসবাস শুরু করে তখন একটা পর্যায়ে তারা নিজেদের কিছুটা গুছিয়ে নেবার কারণে কিংবা আবারও আবাস বদলের অনিশ্চয়তার দোলাচলে এদেশেই থেকে গেছে। তাছাড়া মুসলিম প্রধান এই দেশ ত্যাগ করতে স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে অনেক বিহারির মনই সায় দেয়নি। এই সামাজিক চাপের ফলেও বিহারিদের ভাষার সঙ্গে বাংলাভাষার মিশ্রণ এড়ানো সম্ভব ছিল না।
বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হবার কারণে বিহারিরা এদেশে থেকে যাওয়া কার্যফলই শুধু নয়, বরং শতকরা ৯০ শতাংশ বিহারি মুসলমান হওয়ার কারণে ধর্মীয় কিছু শব্দ এবং অনুষঙ্গের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের অনেক ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ভাষা মিলে যাবার কারণেও বিহারিদের ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার মিশ্রণ সহজ হয়েছে। মূলত ভাষার এ মিশ্রণ কয়েকটি প্রজন্মে ধীরে ধীরে ঘটেছে, ঘটছে এবং ভবিষ্যতে আরও ঘটবে।
একটা সময় ছিল যখন বিহারিরা তাদের ভাষাতেই সর্বত্র কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। ইচ্ছে করেই তারা বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দেয়নি বা শেখার প্রয়োজন মনে করেনি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আজ এমনই অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে বিহারিরা বাংলা শিখতে, বলতে এবং লিখতেও বাধ্য হচ্ছে। রাজনৈতিক চাপ, সামাজিক চাপ এবং ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে তারা অনেকেই আজ বাঙালিদের মতোই ঘরের ভিতরে না হলেও ঘরের বাইরে বাংলা ভাষায় কথা বলছে বা বলতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলা বলতে না পারলে কর্মসংস্থান হচ্ছে না, বাংলা লেখা পড়া শিখতে না পারলে মানসম্মত কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলা শুদ্ধ এবং সুন্দরভাবে না বলতে পারলে যখনই তারা বিহারি হিসেবে বিভিন্ন স্থানে চিহ্নিত হচ্ছে তখনই তারা বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। ভাল চাকরির ক্ষেত্রে জাতীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অনেকের মনে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তাতে করে বিহারিদের সম্মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিবিধ কারণে বিহারিরা এদেশে থেকে এদেশের ভাষা ব্যবহার করে অজান্তেই নিজেদের ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার মিশ্রণ ঘটাচ্ছে।
ভারতীয় বিহারীদের যেসব উত্তরসূরি বাংলাদেশে বসবাসরত তারাও এই দুই ভাষার মিশ্রণে তৈরি একটি ভাষায় কথা বলে। বাংলাভাষায় যেমন একটা মানভাষা বা Standerd language ব্যবহার করা হয় শিক্ষিত বিহারিরাও কেউ কেউ মনে করেন শুদ্ধ উর্দু হচ্ছে তাদের মানভাষা। তবু খুব কম বিহারি আছে শুদ্ধ উর্দুতে কথা বলে।
বাংলাভাষায় আঞ্চলিকতা বা উপভাষাগত কারণে যেমন ভাষায় ধ্বনিগত পরিবর্তন সাধন করা হয়, বিহারিরাও এমন পরিবর্তিত অনেক রূপের সমন্বয়ে তাদের মিশ্র বাংলাভাষা আত্মীকরণ করছে। যেমন- বিয়া, মেট্টিক, করছি, খাইছি, গেছি, আইতাছি, করতাছি, গ্যাছে গা, গেছি, আমাগো, তোমাগো, কান্দেনা, হইছে, কাইলকা, বোইন, পোলা, মাইয়া, ইস্কুল, পড়তাছে, লাইগা, পইরা, আইছেন ইত্যাদি ভাষিক ব্যবহার। একটা বিষয় লক্ষণীয় তাদের ভাষাপ্রয়োগে ‘ছ’ এবং ঘৃষ্ট ‘জ’ ব্যবহারের প্রবণতা খুব বেশি।
নতুন প্রজন্মের বিহারিরা (১৯৭১-এর পর যাদের জন্ম) এদেশে জন্মগ্রহণের ফলেই হয়তো বা এদেশেই অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ গঠন পরিকল্পনা করে জীবনকে সাজাচ্ছে। বেশিরভাগ নতুন প্রজন্মের বিহারিরাই এদেশে থেকে সুস্থ-সুন্দর, নির্বিঘ্ন জীবন-যাপন করতে চায়, চায় এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদেরকে মিশিয়ে ফেলতে।
আসলে এরা নিজেদের মূল ভাষাকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করতে পারছে না। আবার বাংলাদেশে বসবাস করে বাঙালিদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ওঠা বসা করতে হচ্ছে, ফলে বাংলা ভাষাকেও অবহেলা করতে পারছে না। এ কারণে এদের ভাষার কোনো স্পষ্ট অবয়ব এই মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুটা বাংলা, কিছুটা হিন্দি, মাগধী, মৈথিলি বা ভোজপুরিয়া ভাষার মিশ্ররূপ বিহারিদের বর্তমান ভাষায় দেখা যাচ্ছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এমন একদিন আসতেও পারে, যখন বিহারীদের মূল ভাষা বাংলা ভাষা হবে কিনা তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে। তখন উর্দু বা হিন্দি তাদের প্রথম-শেখা ভাষা থাকবে কিনা তা সময় ও পরিস্থিতিই নির্ধারণ করে দেবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ
-বাবু/এ.এস