বিশ্বমনস্ক কবি মৃত্যুর পূর্বে প্রত্যক্ষ করেছেন মানবসভ্যতার গভীর সঙ্কট। তথাপি তিনি মানুষের মহত্ত্বে চির-আস্থাবান ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অনন্ত জীবন, চিরজীবী মানবাত্মা ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন মহাজীবনের যতি হিসেবে। জীবন-মৃত্যু ও জগৎ-সংসার তাঁর নিকট প্রতিভাত হয় এক অখণ্ড রূপে। তাই তাঁর গানে জীবনলীলার সুর বাজে এভাবে ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ-দহন লাগে/তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে’
অন্তরীক্ষে উদিত রবির কিরণ দ্যুলোক-ভূল্যোক ছাপিয়ে বাংলার দিগন্ত আলোকিত করে নতুন প্রভাতের সূচনা করে। আমাদের সাহিত্যাকাশে রবির উদয় যেন ছিল অবশ্যম্ভাবী। এ উদয় না হলে সূচনা হত না সাহিত্যের নতুন যুগের, সূচনা হত না এক হৃদয় হরা নতুন ধারার। যিনি স্বমহিমায় আবির্ভূত না হলে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনের অনেক দিকই সৃষ্টি হত না, সাহিত্য সম্ভার রয়ে যেত অপূর্ণ, শ্রীহীন। তিনি বিশ্বজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য ধারার স্রষ্টা তিনি। একাধারে কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, বাঊল, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সমাজ সেবক ও সমাজ-সংস্কারক। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা বিস্বয়কর, যা বিশ্বময় স্বীকৃত, এ দ্বারা তিনি সারা বিশ্বকে সম্মোহিত করেছেন, মুগ্ধ করেছেন। ১৯১৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এশিয়ার স্বনামধন্য, বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই পুরস্কার জয়ের গৌরব অর্জন করেন।
রবীন্দ্রনাথের কবিমানস ও সাহিত্যকর্মের স্বরূপ তাঁর জীবনের প্রেক্ষাপটেই অনুধাবন করা সম্ভব। তিনি একটি নক্ষত্রের মত বাংলার আকাশে উদিত হয়েছিলেন। বাংলার সাহিত্যের ঝুলিকে তিনি নিজের সৃষ্টিশীল কর্ম দিয়ে পরিপূর্ণ করেছেন। যুগে যুগে পৃথিবীতে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রূপান্তর ঘটেছে। তেমনি বাংলার ইতিহাসের পর্বে পর্বে সাহিত্যে মানুষের জীবন জিজ্ঞাসা ও দর্শনের পরিবর্তন ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ এর সবকিছুকেই আত্মস্থ করেছেন তাঁর মেধা, মনন, সৃষ্টিশীল চিন্তা, চেতনা, একাগ্রতা, দূরদর্শিতা, গভীর অনুশীলন, ক্রমাগত নিরীক্ষা এবং বিশ্বপরিক্রমার মধ্য দিয়ে। তাই কবিগুরুর জীবনের নানা পর্যায়ে সাহিত্য বিষয় ও আঙ্গিকের নিরন্তর পালাবদল লক্ষণীয়। তাঁর নিজ দর্শন, উপলব্ধি প্রসূত একান্ত প্রচেষ্টার ফসলের প্রতিচ্ছবি তাঁর অসংখ্য কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, ভ্রমণকাহিনী, চিঠিপত্র এবং দেশে-বিদেশে প্রদত্ত বক্তৃতামালা। রবীন্দ্রনাথের সকল কর্ম এক সুনিপুণ সৃষ্টিশৈলী, এক ব্যতীক্রমী ধারা ও ভিন্নধর্মী অন্তর্নিহিত জীবনবোধসম্পন্ন। তাঁর লক্ষ্য ছিল স্থির, অবিচল, দৃঢ়, অপরিবর্তনীয় কিন্তু গতিশীল। তাঁর সকল সৃষ্টিকর্ম কালের নিরন্তর ধারায় বহমান। সেই সাথে প্রকৃতি, জীবন, সভ্যতার যে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, বিবর্তন চলমান তা স্বীকার করে নিয়েও আপন আদর্শে প্রতিষ্ঠিত; অন্যদিকে তাঁর সৃজনশীল রূপটি ছিল চলিষ্ণু ও পরিবর্তনশীল। রবীন্দ্রনাথ কেবল কোনো নির্দিষ্ট কালের কবি নন, তিনি কালজয়ী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর অভিজাত ঠাকুর পরিবারে। তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্দশ সন্তান। নবজাগ্রত বাঙালি সমাজের পুরোধা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন জমিদার, একজন শিক্ষানুরাগী, একজন সমাজ সেবক, ধার্মিক মননশীল মানুষ। তবে এত শানশৌকতে জমিদারি হালতে লালিত রবীন্দ্রনাথ চাইলে তাঁর জীবন জৌলুশ ও প্রাচুর্যের মাঝে কাটিয়ে দিতে পারতেন। কোন অভাব অনটন তিনি কোনদিন উপলব্ধি করেননি। আরাম আয়েশের সকল আয়োজন ছিল যা চাহিবা মাত্রই তিনি ভোগ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি এই সকল ভোগ বিলাসে মত্ত ছিলেন না। এ আনন্দ আয়োজনে দৃষ্টিপাত না করে সুখ স্বাচ্ছন্দের উপকরণকে উপেক্ষা করে তিনি সৃষ্টিশীল জীবনকে বেছে নিয়েছিলেন। সে যুগে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি, মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীল ভাবধারার অন্যতম পীঠস্থান। সেই পরিবেশকে তিনি উপজীব্য করে তাঁর চিন্তা, চেতনা, ধ্যান, ধারণাকে একীভূত করে সৃজনশীল কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষা শুরু করেন কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে। পরে বেশ কয়েক বছর তিনি পড়েন বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত স্কুলে। সেখানেই তাঁর বাংলা শিক্ষার ভিত্তি তৈরি হয়। সবশেষে তাঁকে ভর্তি করা হয় সেন্ট জেভিয়ার্সে। কিন্তু অনিয়মিত উপস্থিতির জন্য তাঁর স্কুলে পড়া বন্ধ হয়ে যায়। তবে বাড়িতে বসে পড়াশোনা চলতে থাকে।
১৮৭৩ সালে পিতার সঙ্গে প্রথম নগরের বাইরে প্রকৃতির বৃহৎ অঙ্গনে পা রাখেন রবীন্দ্রনাথ, শান্তি নিকেতনে পিতার স্নেহসিক্ত সান্নিধ্য লাভ তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। পিতার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের আদর্শ তাঁকে অভিভূত করে। হিমালয়ের নির্জন বাসগৃহে তিনি পিতার নিকট সংস্কৃত পড়তেন। সন্ধ্যায় মহর্ষি তাঁকে চিনিয়ে দিতেন আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র। এভাবে মহর্ষীর প্রকৃতি প্রীতি ও সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে কবির নিবিড় পরিচয় ঘটে। হিমালয় থেকে ফিরে এসে হঠাৎ যেন রবীন্দ্রনাথ শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণ করেন। এরপর থেকে তাঁর শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চা অনেকটাই বাধামুক্ত হয়। এ সময় গৃহশিক্ষকের নিকট তাঁকে পড়তে হয় সংস্কৃত, ইংরেজি সাহিত্য, পদার্থবিদ্যা, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, প্রাকৃতবিজ্ঞান প্রভৃতি। এর পাশাপাশি চলতে থাকে অঙ্কন, সঙ্গীত শিক্ষা এবং জিমন্যাস্টিকস। নিয়মিত স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলেও কবির সাহিত্যচর্চা অব্যাহত থাকে।
দেশে-বিদেশে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই রবীন্দ্রনাথকে বেধে রাখতে পারেনি। বাধাধরা প্রচলিত শিক্ষা প্রক্রিয়ায় তাঁর শিক্ষা গ্রহণে ছিল অনীহা। যে শিক্ষায় বৈষয়িক লাভ এবং অর্থ উপার্যনের উপায় সুগম হয় সে শিক্ষা তাকে টানেনি। তিনি শিখেছেন নিজের জীবনাদর্শের দ্বারা। নিজেই নিজেকে উপলব্ধি করেছেন, নিজের চোখেই সমাজকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, নিজের চিন্তাশক্তি দিয়েই প্রকৃতিকে দেখেছেন, নিজের দর্শনকে দিয়েই মানব জীবনকে অনুধাবন করেছেন। আর এরই ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয়েছে সময়ের বিস্ময়কর সাহিত্যকর্মের; যেখানে অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী বাউল আঙ্গিকের রবিন্দ্রসঙ্গীতের জন্ম হয়। তাঁর হৃদয়স্পর্শী লেখনি ও সুর আমাদের সকলকে মোহিত করে তাঁর গানে তিনি বলেন,
‘আমি কান পেতে রই
ও আমার আপন হৃদয় গহণ দ্বারে বারে বারে
কান পেতে রই।
কে সে মোর কেই বা জানে,
কিছু তাঁর দেখি আভা,
কিছু পাই অনুমানে,
কিছু তাঁর বুঝি না-বা।’
কবি নিজ দর্শন শেষে আত্মকেন্দ্রিক জগৎ থেকে মুক্ত হয়ে এসে দাঁড়ান মানুষের জগতে। এখান থেকেই রবীন্দ্রপ্রতিভার সত্যিকার স্ফূরণ ঘটে। তিনি শুরু করেন তাঁর সাধনা, সৃষ্টি করেন অসাধারন সব গান, কবিতা, প্রবন্ধ, ছোট গল্প, নাটক, উপন্যাস। যা সাহিত্যাঙ্গনে অকৃত্রিম এক যুগের সৃষ্টি করে।
জীবনের এক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি তদারকি উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান শাহজাদপুর, পতিসর, কালিগ্রাম ও শিলাইদহে ঘুরে বেড়ান। এই সূত্রেই শিলাইদহে গড়ে ওঠে একটি কবিতীর্থ। নদীবক্ষে নৌকায় চড়ে বেড়ানোর সময় নদী, বালুচর, কাশবন, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দরিদ্র জীবন এবং সেখানকার সাধারণ মানুষের হৃদয়লীলা কবিকে গভীরভাবে আলোড়িত করে, যা তাঁর সেই সময়ের গল্পে ও কবিতায়, গানে প্রতিফলিত হয়েছে। নদী অববাহিকা বাউল রবিকে যেমন আকর্ষণ করেছে ঠিক তেমনি লালন ফকির, কাঙ্গাল হরিনাথ। কবির বাংলার মানুষের জীবনযাপন ও জীবন দর্শন কবিকে মোহিত ও প্রভাবিত করে।
রাজনৈতিক ইতিহাসেও কবি নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন। তবে তিনি কখনও সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হননি, সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্নও রাখেননি; বরং তিনি ছিলেন স্বাদেশিকতার বরেণ্য পুরুষ। ১৮৯৬ সালে কলকাতায় যে কংগ্রেস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, ‘বন্দে মাতরম’ গান গেয়ে কবি তার উদ্বোধন করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় কবি বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেন। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে কবি তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করেন এবং রাখিবন্ধনের দিনটিকে স্মরণ করে রচনা করেন একটি গান ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল/পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।’
সে সময় কবির স্বদেশ পর্বের বেশকিছু উল্লেখযোগ্য গান রচিত হয়। তাঁর দুটি গান বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা লাভ করে। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ বাংলাদেশের এবং ‘জনগণ মন’ ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। এ সময় রবীন্দ্রনাথ দেশ ও সমাজকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার বিস্তৃত কর্মসূচি তুলে ধরেন তাঁর বিখ্যাত ‘স্বদেশী সমাজ’ (ভাদ্র, ১৩১১) প্রবন্ধে। দরিদ্র প্রজাদের দুর্দশা লাঘবের জন্য তিনি বেশকিছু কর্মসূচি চালু করেন, যার মধ্যে ছিল শিক্ষা, চিকিৎসা, পানীয় জলের ব্যবস্থা, সড়ক নির্মাণ ও মেরামত, ঋণের দায় থেকে কৃষকদের মুক্তিদান প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলনকে সমর্থন করলেও উগ্র জাতীয়তাবাদ কিংবা সন্ত্রাসবাদকে কখনও সমর্থন করেননি।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে রবীন্দ্রনাথ বারবার নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। ১৯০২ সালে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু হয়। এর কয়েক মাসের মধ্যে কন্যা রেণুকা মারা যান। ১৯০৫ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ দেহত্যাগ করেন এবং ১৯০৭ সালে মৃত্যু ঘটে কবির কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের। এতগুলি মৃত্যুর শোক রবীন্দ্রনাথকে বিহবল করে তুললেও তিনি শান্তচিত্তে আশ্রমের দায়িত্ব পালন করে যান। পারিবারিক বিপর্যয়ের সঙ্গে সে সময় কবি চরম অর্থসঙ্কটে পড়েন। কিন্তু সমস্ত সঙ্কট থেকে উত্তরণের এক মহাশক্তি তাঁর মধ্যে ছিল। তাই তাঁর কর্মযজ্ঞে ছেদ পড়েনি, থেমে থাকেনি সাহিত্য সাধনা।
ভারতবর্ষের প্রকৃতি ও তার ইতিহাসের ধারা কবির কাছে হয়ে ওঠে গভীর অর্থবহ, অন্যদিকে বাংলার প্রকৃতি জীবন, দর্শন কবি মনকে প্রভাবিত করে। তাঁর সৃষ্টি কর্মে এ সকল প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই। আর অন্যদিকে অধ্যাত্মভাবনায় তাঁর চিত্ত ধাবিত হয় রূপ থেকে অরূপের সন্ধানে। সাহিত্যের এ পর্বে দুঃখ ও মৃত্যুর তত্ত্বকে কবি জীবনের তত্ত্বে অর্থান্বিত করে তোলেন। তিনি জীবন দর্শনকে মানুষের সামনে নিয়ে এসেছেন এক অনবদ্য ভঙ্গিমায়। যেখানে জীবনের চরম সত্য, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, পরিণয় সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিচিত্র সৃষ্টির অন্যতম ধারা তাঁর অসাধারণ গান। এই সঙ্গীত প্রতিভা পারিবারিক সূত্রেই অঙ্কুরিত ও বিকশিত হয় তাঁর মধ্যে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে গানের বাণী ও সুরে নব নব নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে তিনি নির্মাণ করেন সঙ্গীতের এক স্বতন্ত্র জগৎ, যা একান্তভাবেই তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি এবং কালক্রমে এই রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে ওঠে কালজয়ী।
বিশ্বমনস্ক কবি মৃত্যুর পূর্বে প্রত্যক্ষ করেছেন মানবসভ্যতার গভীর সঙ্কট। তথাপি তিনি মানুষের মহত্ত্বে চির-আস্থাবান ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অনন্ত জীবন, চিরজীবী মানবাত্মা ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন মহাজীবনের যতি হিসেবে। জীবন-মৃত্যু ও জগৎ-সংসার তাঁর নিকট প্রতিভাত হয় এক অখণ্ড রূপে। তাই তাঁর গানে জীবনলীলার সুর বাজে এভাবে ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ-দহন লাগে/তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে।’
রবীদ্রনাথ গান রচনা করেছেন সুর করেছেন এবং গেয়েছেন, তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গীত শিখিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলার সঙ্গীত অঙ্গনে এক অনন্য অসাধারণ জগৎ তৈরি করেছেন, তাঁর এই সঙ্গীত ভূবনে সব চাইতে মোহনীয় কালজয়ী এবং হৃদয়হরা যে অসাধারণ সৃষ্টি তা হল বাউল সংগীত। রবিন্দ্রনাথের এই বাউলাঙ্গিকের গান শুধু বাংলা মানুষকে নয় বিশ্বের বিভিন্ন অংশের বা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের হৃদয়কে এক অব্যক্ত আবেগে নিরন্তর টেনে চলেছে। তিনি হৃদয় হরণ করেছেন সকল মানবতাবাদী মনুষ্য জগৎকে। তিনি সকল দুঃখ, কষ্ট, অন্যায়, অবিচার, অমঙ্গলকে, শৃঙ্খল জয় করে সত্য, সুন্দর, কল্যাণের পথে মানবজাতির মুক্তির অগ্রযাত্রাকে ধাবিত করার প্রয়াশে তাঁর গানে তিনি বলেন, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমাওে ও বন্ধু আমার। বুঝি ঐ রাত, বুঝি ঐ রবির আলো প্রভাতে দেখা দিল গগণ পাড়ে। সমুখে ঐ হেরি পথ তোমার কি রথ পৌঁছবে না মোর দুয়ারে।’
তাঁর বাউল গানে আছে মানবমুক্তির চির আকাক্সক্ষা। এ আবেদনের মাধ্যমে কবি সমগ্র মানবজাতির চিত্তে মুক্তির বাণ ডাকেন, তিনি জয় করেন বিশ্ব, হরণ করেন সকলের চিত্ত।
লেখক : সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
-বাবু/এ.এস