সোমবার ৩০ জুন ২০২৫ ১৬ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ৩০ জুন ২০২৫
রাজনীতির প্রতি অনাস্থা বাড়ল কেন
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: বুধবার, ১০ মে, ২০২৩, ১১:১০ AM

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কিছুদিন আগে বলেছেন যে, ভালো লোকেরা এখন আর রাজনীতিতে আসতে চায় না। কথাটা তিনি না জেনে না বুঝে বলেননি; দুঃখের সঙ্গেই বলেছেন। তাঁর মতে, রাজনীতি নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট রাজনীতি নষ্ট মানুষের জন্ম দিচ্ছে। খুবই সত্য কথা। শুধু বাংলাদেশ বলে নয়, পৃথিবীজুড়েই ওই ঘটনা ঘটছে; কম আর বেশি।

যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য অর্থনীতিই প্রধান অবলম্বন; কিন্তু অর্থনীতির ওপর রাজনীতির যে হস্তক্ষেপ ঘটে না, তা তো নয়। রাষ্ট্র চলে রাজনীতির ধারাতে এবং অর্থনীতি যে রাজনীতির শাসনকে অবজ্ঞা করবে তা পারে না। আসলে রাজনীতি ও অর্থনীতি অঙ্গাঙ্গী জড়িত, আলাদা করা কঠিন। তা বাংলাদেশের রাজনীতিটা ‘নষ্ট’ হলো কীভাবে? কার দোষে? ভাবনা-চিন্তা না করেও বলা যাবে, নষ্ট হয়েছে ব্যবস্থার দোষে। ব্যবস্থাটাই এমন যে, নানান কিসিমের আদর্শের কথা শোনা যায় বটে; কিন্তু নিয়ন্ত্রণ রয়ে যায় ওই টাকার হাতেই। বাংলাদেশের সংসদ সদস্য অধিকাংশই যে হয় নিজেরা ব্যবসায়ী, নয় তো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এটি ঘটনা বটে, তবে দুর্ঘটনা নয়।

নষ্ট রাজনীতি যে ভয়াবহ কাজটা করছে সেটা হলো, জনসাধারণের মধ্যে শুধু রাজনীতিক নন, রাজনীতির প্রতিই অনাস্থা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর প্রমাণ নানাভাবে পাওয়া যাবে, পাওয়া গেল কিছুদিন আগে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া সংসদীয় আসনগুলোর উপনির্বাচনেও। বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, শতকরা পাঁচজন ভোটার ভোট দিয়েছেন। তারা অতিরঞ্জন করেছে। রাজনীতিকরা সেটা করে থাকেন এবং ওই করাটাই অন্যতম কারণ, যে জন্য জনসাধারণ তাদের ওপর আস্থা রাখতে উৎসাহ পায় না। তবে উপনির্বাচনে ভোটাররা যে মোটেই আগ্রহ প্রকাশ করেননি, এটা বাস্তবিক সত্য। দৈনিক পত্রিকার শিরোনামগুলোর দিকে তাকালেও এখন এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।

নিয়ম হচ্ছে, নির্বাচন উৎসবের মতো। যথার্থ নির্বাচন উৎসবই আসলে। তাতে উপস্থিতি, উৎসাহ, উত্তেজনা, কৌতূহলÑ সবকিছুই উপচে পড়ে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল ভোটাররা যদি আগেই জেনে যায়, তাহলে তারা সাড়া দেবে কেন? তদুপরি যদি শঙ্কা থাকে সংঘর্ষের এবং অনিয়মের, তাহলে খরা দেখাটাই তো স্বাভাবিক।

এই রাজনীতি বিমুখতা মোটেই সুসংবাদ নয়। দেশের পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হয়েছে, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসছে। দুই বড় দল পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিচ্ছে, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ আপাতত কথার মধ্যে সীমিত; কিন্তু মানুষ ভরসা পাচ্ছে না, তারা আশঙ্কা করছে সংঘর্ষের। ফলে নির্বাচনে তাদের আস্থা কমারই কথা। নির্বাচনে আস্থা না থাকলে লোকজন ভোটকেন্দ্রে যাবে না। সাম্প্রতিক বিভিন্ন নির্বাচনে তো বটেই; অতি সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি আসনে উপনির্বাচনে সেটির প্রতিফলন ঘটেছে।

জনসাধারণ ভোটকেন্দ্রে না গেলে সিটি নির্বাচনে যেমন-তেমন, বড় সংকট দেখা দেবে জাতীয় নির্বাচনে। শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যদি ক্ষমতার হস্তান্তর না ঘটে, তাহলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হবে, তাতে অতীতে যেমন রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গেছে সামরিক বা বেসামরিক আমলাতন্ত্রের হাতে, এবারও তেমনটা ঘটবে বলে লোকে ধরে নেবে। রাজনীতিকরা যেহেতু আস্থা হারাচ্ছেন, তাই আমলাতন্ত্রের জন্য কর্তা হয়ে যাওয়াতে কোনো অসুবিধা হবে না।

আমাদের রাষ্ট্রের পত্তনটা ঘটেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে, তখন এর চরিত্র স্বভাবতই ছিল আমলাতান্ত্রিক। পাকিস্তানি শাসনামলে সেই চরিত্রে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, কারণ শাসকদের অভিপ্রায় ছিল পূর্ববঙ্গকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করা। রাষ্ট্রের ক্ষমতা ছিল সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের হাতে। আমরা চেয়েছিলাম; সেই পাকিস্তান থেকে বের হয়ে গিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে; সম্ভব হয়নি। কারণ বাঙালি জাতীয়তাবাদীরাও ছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের মতোই রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক চরিত্রটি অপরিবর্তিত রাখতে বদ্ধপরিকর। নিজেদের উন্নতিকেই তাঁরা দেশবাসীর উন্নতি বলে বিশ্বাস করতেন, প্রচারও করেছেন। ওদিকে রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতা রয়ে যাচ্ছিল আমলাদের হাতেই।

এই প্রক্রিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে কয়েকবার সামরিক শাসন এসেছে এবং সামরিক শাসকরাও ক্ষমতার চর্চা করেছে বেসামরিক আমলাদের সাহায্য দিয়েই। মিলেমিশে। ইয়ার-দোস্তের মতোই ব্যবসায়ীরা এখন ক্ষমতাশীল ঠিকই; কিন্তু তাঁরাও কাজ করেন আমলাদের সহযোগিতাতেই, অনেক সময় আমলাদের মাধ্যমেই। এটাই এখন বাস্তবিক সত্য।

উন্নয়ন ও উন্নতির নিরিখ ও প্রতীকগুলো আমাদের চারপাশেই খেলা করছে। আমরা দেখি এবং মেনে নিই, মনে করি এগুলোই স্বাভাবিক। যেমন কিছুদিন আগের একটি ঘটনার কথাই ধরা যাক। সন্ধ্যার অন্ধকারে দু’জন লোক, অত্যন্ত স্মার্ট তাঁরা নিশ্চয়ই, আশি বছর পার হওয়া এক মহিলাকে ফেলে রেখে গেছে ঢাকা শহরের একটি ছোট রাস্তার এক কোণে। মহিলা যে সম্ভ্রান্ত পরিবারের বোঝা যায় তাঁর পরিধেয় দেখে। তাঁর পরনে ম্যাক্সি, ম্যাক্সির ওপরে হলুদ রঙের সোয়েটার। তাঁর চোখে-মুখে বেদনা ও বিষণ্নতার ছাপ। গলায় এক গোছা চাবি। চাবির ওই গোছাতেই হয়তো ব্যাখ্যা আছে তাঁর এই পথপ্রান্তিক দুর্দশার। ওই চাবিগুলো নিশ্চয়ই বিভিন্ন রকমের তালার; তালাতে আবদ্ধ ছিল যে সম্পদ ও সম্পত্তি, সেগুলো হয়তো ইতোমধ্যে তাঁর নিকটজনদের হস্তগত হয়ে গেছে, এখন না আছে তালার কোনো দাম, না তালার না চাবির, না চাবির মালিক মহিলার নিজের। মূল্যহীন মহিলাকে দেখাশোনার দায়িত্ব এখন কে নিতে যাবে? তাই তাঁকে বিদায় করে দেওয়াই শ্রেয়। বাস্তবতা এটাই। উন্নতির মালিকানা লোভনীয়; উন্নতি হয়ে গেলে উন্নয়নের অবলম্বনের মূল্য কী? তাকে পাহারা দেওয়া এক বিড়ম্বনা। তাই ফেলে দিয়ে গেছে। রাজধানীর এক পথে।

উন্নয়নের ও উন্নতির আরেকটি ছবি প্রায় একই সময়ে ঘটা এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছোট সংবাদে পাওয়া যাবে। হাতিরঝিল এলাকায় মোটরসাইকেলের এক আরোহী দুর্ঘটনায় পড়েছেন, রাস্তায় পড়ে রয়েছেন তিনি, রক্তাক্ত অবস্থায়। তাঁর চারপাশে কিছুটা ভিড় জমেছে। কিন্তু তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর কোনো তৎপরতা নেই কারও মধ্যেই, তবে কয়েকজনকে দেখা গেছে মোবাইলে ছবি তুলতে। হাসপাতালে নিতে গেলে অনেক ঝামেলা, ছবি তুললে সেটা হবে একটা ব্যক্তিগত অর্জন। ঝোঁক ওই অর্জনের দিকেই। বর্জন এবং অর্জন উভয়ে একই পথের পথিক বটে। না হয়ে উপায় কী?

রাজনীতির মূল কথা হচ্ছে, নিজে খানিকটা ত্যাগ স্বীকার করে হলেও জনসাধারণের, অন্যের সুবিধাটা দেখা। এখনকার রাজনীতিকরা সবার আগে নিজের স্বার্থ দেখছেন যে কোনো মূল্যে। এতে করে জনসাধারণের বড় অংশ রাজনীতিকদের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন। আর একটি অংশ ওই রাজনীতিকদেরই অনুসরণ করে নিজেরটা দেখছেন সবার আগে।
 
লেখক :  ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত