প্রতিবছরের মতো এবারও আগামী বছরের বাজেট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। গত বছর বাজেটের মূল প্রেক্ষাপট ছিল বিশ্বজুড়ে কভিড-১৯-এর উন্নত দেশগুলোতে চাহিদাজনিত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, উচ্চ জ্বালানি মূল্য। ওই সময় আন্তর্জাতিক বহুপক্ষীয় সংস্থা আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক সংস্থা বিশ্বজুড়ে যে মন্দা সংঘটিত হতে পারে সে বিষয়ে পূর্বাভাস দিয়েছিল। তাছাড়া তখন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রণীত খাদ্যমূল্য সূচক বিগত ৬০ বছরে সর্বোচ্চ পরিমাণ রেকর্ড করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেছিলেন যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই অগ্রাধিকার দেবেন। বাংলাদেশের জন্য ওই সময়ের বাস্তবতা ছিল বৈদেশিক রিজার্ভ দ্রুত পড়ে যাওয়া, সার্বিক মূল্যস্ফীতি, আমদানি বৃদ্ধি, রপ্তানি তুলনামূলক হ্রাস, বিশ্ববাজার থেকে উচ্চমূল্যে জ্বালানি তেল ক্রয় এবং সেই সঙ্গে প্রবাসী আয় কমে যাওয়া। তাছাড়া ওই সময় সরকার সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনসহ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে আইএমএফের কাছে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা চাওয়া।
বিশ্বজুড়ে গত বছরের আর্থিক বাস্তবতার সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতার খুব একটা ফারাক নেই। তবে আগের যে তীব্রতা ও গভীর সংকট ছিল, সেই অবস্থা থেকে কিছুটা উত্তরণ ঘটেছে। যেমন: উন্নত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে, যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি মার্চ ২০২৩ সালে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যদিও অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে মার্চে গড় মূল্যস্ফীতি এখনো ৭.৭ শতাংশ রয়েছে (ওসব দেশের জন্য এটা অত্যধিক বিবেচিত)। যদিও গত বছর জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তা গড়ে ১০ শতাংশের ওপর ছিল। আইএমএফের সর্বশেষ ‘গ্লোবাল ইকোনমিক আউটলুক’ এপ্রিল ২০২৩ সংস্করণে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২৩ সালের ২.৮ শতাংশ থেকে কিছুটা বেড়ে ৩ শতাংশ হবে। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও কিছুটা কমবে, তবে যতটা আশা করা হয়েছে তার চেয়ে কম হবে। এদিক থেকে কিছুটা স্বস্তি পেলেও এ বছর নতুন সমস্যার আবির্ভাব হয়েছে, সেটা হলো বিশ্বজুড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ব্যাংকব্যবস্থার ভঙ্গুরতা। সিলিকন ভ্যালি ও ফরচুন ব্যাংক বন্ধ হয়েছে। আমেরিকা ও ইউরোপের আর্থিক খাতে বেশ কিছু ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বর্তমান বাস্তবতায় এবারের বাজেটবাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলোর মধ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে এপ্রিল ২০২৩-এ মূল্যস্ফীতি ৯.২৪, যদিও এ বছর মার্চে তা ছিল ৯.৩৩। এখানে উল্লেখ্য যে গত বছর আগস্টে দেশের মূল্যস্ফীতি ৯.৫ শতাংশ ছুঁয়েছিল। প্রবাসী আয়ের ধারা ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও চলতি অর্থবছরে জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত বিগত অর্থবছরের তুলনায় এখনো ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। একইভাবে তা রপ্তানির বেলায়ও সত্য। জুলাই-মার্চ সময়ে বেড়েছে ৭.৮ শতাংশ। ওই একই সময়ে আমদানি কমেছে ১২.৩ শতাংশ। ডলারের সংকটের কারণে আমদানির ক্ষেত্রে সরকার কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করেছিল, বিশেষত বিলাসী পণ্যের ক্ষেত্রে। সরকারের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বলা যায়। কারণ শুধু ফেব্রুয়ারিতেই আমদানি কমেছে ৩৮ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব ব্যুরোর রাজস্ব আহরণ প্রবৃদ্ধি জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে, তবে তা গত বছরের তুলনায় এবার কমেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নতুন বাস্তবতা হলো, গত ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ কর্তৃক বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন এবং একই সঙ্গে কিছু সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ। ঋণ সাতটি কিস্তিতে সাড়ে তিন বছর (৪২ মাস) সময়ে বাংলাদেশকে প্রদান করা হবে। প্রথম কিস্তির ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ এরই মধ্যে গ্রহণ করেছে। আইএমএফ যে উদ্দেশ্যে ঋণ অনুমোদন করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, অরক্ষিতদের সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তভুক্তিমূলক ও সবুজ প্রবৃদ্ধি ত্বরান্ব্বিত করা। সংস্কার পদক্ষেপের মধ্যে যে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে সেটি হলো সামাজিক ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় বাড়ানোর জন্য আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি।
বাংলাদেশ সরকার ও আইএমএফের মধ্যে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশকে যে লক্ষ্যমাত্রাগুলো পূরণ করতে হবে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, চলতি জুনের মধ্যে কর জিডিপির হার ০.৫ শতাংশ উন্নীত করা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্ষেত্রে নন-পারফরমিং লোনের পরিমাণ ১০ শতাংশের নিচে এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা, ডিসেম্বরের মধ্যে ত্রৈমাসিক জিডিপি প্রকাশ করা, ব্যাংক কম্পানি আইন সংশোধন করা, আয়কর আইন সংসদে পাস করা, জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা, বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানো, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো, সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো, বাজেট ঘাটতি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখা, যাতে সরকারকে চাপে পড়তে না হয়।
সম্প্রতি (০১ মে, ২০২৩) আইএমএফ এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য ‘রিজিওনাল ইকোনমিক আউটলুক’ প্রকাশ করেছে। তাতে হিসাব করা হয়েছে চলতি বছর এ অঞ্চল বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ অবদান রাখবে এবং প্রবৃদ্ধি আগের বছরের ৩.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে চলতি বছর ৪.৬ শতাংশ হবে। এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয়, প্রবৃদ্ধির যে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ২০২৩ সালে চীনকে এবং ২০২৪ সালে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। চলতি বছর প্রবৃদ্ধি কমে ৫.৫ হওয়ার কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলছে, চাহিদা ব্যবস্থাপনায় (ডিমান্ড ম্যানেজমেন্ট) পদক্ষেপ।
এপ্রিল মাসে আইএমএফের প্রতিনিধিদল যে তিনটি চ্যালেঞ্জের কথা বলছে সেগুলো হলো ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক আর্থিক খাতের অস্থিরতা ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদারদের প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি। এই তিনটির মধ্যে দুটির নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ সরকারের হাতে নেই, সেগুলো বৈশ্বিক সমস্যা। মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বৈশ্বিক, কারণ এখানে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। অনেকের মনে থাকতে পারে, গত অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্য। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বড় সমস্যা। যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশেও এখন মূল্যস্ফীতির হার ৮.৯ শতাংশ, যা সে দেশের জন্য এখনো অতি উচ্চে।
আগামী ১ জুন যে বাজেট উপস্থাপিত হবে তার আকার গত বছরের চেয়ে ১২-১৩ শতাংশ বেশি হতে পারে। এর জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশ হতে পারে। এবারের বাজেট আলোচনায় আইএমএফের সঙ্গে যে লক্ষ্যমাত্রাগুলো অঙ্গীকার করা হয়েছে সে বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব পেতে পারে। এবারের বাজেট বাস্তবতা হবে অনেকটা দড়ির ওপর ভারসাম্য রাখার মতো। একদিকে যেমন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, আবার অন্যদিকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এবারের যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে সেগুলো হলো জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখা, বিনিময় হার পতন ঠেকানো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বিস্তৃত করা ও ন্যায্য মূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি করা, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, সার ও কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ উন্নয়ন। তবে সব কিছু ছাপিয়ে প্রায় সারা বছরই আমাদের রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি আলোচনায় থাকে। তার কারণ আমাদের কর জিডিপির অনুপাত দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর চেয়ে অনেক কম। তাই এ বিষয়টি নিয়ে অর্থনীতিবিদ, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা জাতীয় রাজস্ব ব্যুরোর সক্ষমতা ও অভিপ্রায় নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ পান।
জাতীয় রাজস্ব ব্যুরোর সংস্কার নিয়ে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। পুরো কর প্রশাসনকে অটোমেশন করার কথা বলা হয়েছে, যা বাস্তবায়নে যেতে হবে। এমনিতে জনসাধারণ বিশেষত ব্যবসায়ীদের মধ্যে কর না দেওয়ার প্রবণতা থাকে। আমাদের সামনে বড় যে চ্যালেঞ্জটি রয়েছে সেটি হলো অভ্যন্তরীণ আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানো। জিডিপির অনুপাতে রাজস্বের পরিমাণ বাড়াতে প্রস্তাবিত সংস্কার কার্যক্রম আরো বেগবান করতে হবে। সম্প্রতি আইএমএফ ঋণের জন্য যে করণীয় প্রস্তাব দিয়েছে তার বেশির ভাগই যৌক্তিক এবং তা অনুসরণ করলে আমাদের অর্থনীতির জন্য বরং ভালো হবে। যে প্রস্তাবটি জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে সেটি হলো কাস্টমস ও আয়কর আইন সংসদে পাস করা। এ ছাড়া ২০১২ সালের ভ্যাট আইন কার্যকরের জন্য অটোমেশন, ই-পেমেন্ট, ইলেকট্রনিক ডিভাইস চালু করার পদক্ষেপ জোরদার করতে হবে। এ ছাড়া করের আওতাভুক্ত জনগোষ্ঠীর পরিধি বিস্তৃত করা দরকার। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে টিআইএনধারীদের মধ্যে রিটার্ন জমা দেওয়ার হার সবচেয়ে কম আমাদের। ৭৪ লাখের বিপরীতে মাত্র ২৩ লাখ অর্থাৎ ৩১ শতাংশ। অথচ শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভারত, ভুটান, পাকিস্তানে এই হার যথাক্রমে ৮৮, ৭২, ৭১, ৪৪ ও ৩৩ শতাংশ।
তাছাড়া আমাদের এখন সরাসরি কর আর মূল্য সংযোজন করের হার যথাক্রমে বর্তমানে ৩৫ আর ৬৫, অথচ বেশি হওয়া উচিত ছিল উল্টোটা। এর জন্য বাজেট প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও করনীতি নির্ধারণে জনপ্রতিনিধিদের অংশীদারি বাড়ানো যেতে পারে। বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক অংশীদারি বাড়ানো গেলে সংস্কার পদক্ষেপ ত্বরান্বিত হবে। এ জন্য বাজেট আলোচনার সেশন ভবিষ্যতে এক মাসের পরিবর্তে দেড় মাস করা যেতে পারে, মানে বাজেট আলোচনা মধ্য মে থেকে শুরু করার কথা ভাবা যায়। এতে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জনপ্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টতা বাড়বে এবং সংশোধিত বাজেট মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ এবং প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
-বাবু/সাদরিনা