বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫ ২৬ আষাঢ় ১৪৩২
বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫
শিল্পবিপ্লব, বাজার এবং পরিবারতন্ত্র
ইলিয়াজ হোসেন রানা
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৬ মে, ২০২৩, ৪:২৪ PM

শিল্পবিপ্লব শক্তির রূপান্তর এবং নতুন নতুন পণ্য উৎপাদনের নানা উপায় খুঁজে বের করে মানবজাতিকে তার আশেপাশের বাস্তুসংস্থানের উপর নির্ভরতা থেকে অনেকটাই মুক্ত করেছিলো। মানুষ বন কেটে উজাড় করেছে, নদীতে বাঁধ দিয়েছে, সমভূমি প্লাবিত করেছে, স্থাপন করেছে হাজার হাজার কিলোমিটার রেলপথ এবং নির্মাণ করেছে আকাশচুম্বী একেকটা মহানগর। মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য পৃথিবীকে যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে বিভিন্ন আবাসস্থল; বিলুপ্ত হয়েছে অনেক প্রজাতি। আমাদের একদা সবুজ উপগ্রহটি পরিণত হচ্ছে কংক্রিট আর প্লাস্টিকের এক বিপণন কেন্দ্রে। গত পাঁচশত বছর পৃথিবী একের পর এক উত্তেজনাপূর্ণ বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছে। পৃথিবী একীভূত হয়েছে একটি একক বাস্তুসংস্থান এবং ঐতিহাসিক পরিমণ্ডলে।

অর্থনীতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মানবজাতি বর্তমানে যে ধরনের সম্পদ ভোগ করে তেমনটা আগে রূপকথার গল্পে বলা হতো। বিজ্ঞান এবং শিল্পবিপ্লব মানবজাতিকে দিয়েছে অতিমানবীয় ক্ষমতা এবং বাস্তবিকভাবেই সীমাহীন শক্তি। সামাজিকক্রম পুরোপুরিভাবে রূপান্তরিত হয়েছে যেমনটা হয়েছে রাজনীতি, দৈনন্দিন জীবন এবং মানবজাতির মনস্তত্ত্ব। কিন্তু আমরা কী অধিকতর সুখি হতে পেরেছি? গত পাঁচশ বছরে মানবজাতি যে পরিমাণ সম্পদ পুঞ্জীভূত করেছে, তা কি কোনো নবলব্ধ তৃপ্তিতে অনূদিত হয়েছে? অফুরন্ত শক্তি সম্পদের আবিষ্কার কী আমাদের কাছে অফুরন্ত আনন্দের ভাণ্ডার খুলে দিয়েছে? আরো পিছনে গেলে বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের পর থেকে বিগত প্রায় সত্তরটি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সহস্রাব্দ কী পৃথিবীকে আরো বেশি বাসযোগ্য করে তুলেছে? বায়ুশূন্য চাঁদের বুকে যার পদচিহ্ন অক্ষত আছে, সেই নিল আর্মস্ট্রং কি ৩০০০০ হাজার বছর আগে শ্যুভেগুহার দেয়ালে হাতের ছাপ রেখে যাওয়া নাম না জানা শিকারি সংগ্রাহকের চেয়ে বেশি সুখী ছিলেন? যদি তা না হয়, তবে কৃষি, নগর, লেখালেখি, মুদ্রা, সাম্রাজ্য, বিজ্ঞান এবং শিল্পের উন্মেষের ফলে কী লাভ হলো?

শিল্পবিপ্লবের আগে বেশির ভাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ধারা এই তিনটি কাঠামোর মধ্যেই পরিচালিত হতো অণু পরিবার, যৌথ পরিবার এবং স্থানীয় ঘনিষ্ঠ সম্প্রদায়। বেশির ভাগ মানুষ পারিবারিক ব্যবসা যেমন- পারিবারিক খামার কিংবা কারখানা অথবা প্রতিবেশী পরিবারের ব্যবসায়ে নিয়োজিত হতো। পরিবারই ছিল একাধারে কল্যাণমূলক সংস্থা,  স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা, নির্মাণ শিল্প, ট্রেড ইউনিয়ন, অবসর তহবিল, বীমা কোম্পানি, বেতার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, ব্যাংক এমনকি পুলিশও। যখন কেউ অসুস্থ হয়ে পড়তো তখন পরিবারই তার সেবা করতো। কেউ বুড়ো হলে পরিবারই তার সেবা করতো এবং তার ছেলেমেয়েরাই হতো তার পেনশন ফাণ্ড। কেউ মৃত্যুবরণ করলে পরিবারই অনাথের দায়িত্ব নিতো। যদি কেউ একটা কুটির বানাতে চাইতো পরিবার তার অর্থের যোগান দিতো। কেউ বিয়ে করতে চাইলে পরিবার তার জন্য হবু বর বা পত্নী পছন্দ করে দিতো বা অনন্ত মতামত জানাতো। কেউ ব্যবসায় নামলে পরিবার তাকে সাধ্যমত অর্থের যোগান দিতো। কিন্তু যদি কারো অসুস্থতা সামলানো পরিবারের সাধ্যের বাইরে চলে যেতো কিংবা নতুন ব্যবসায় প্রচুর অর্থের প্রয়োজন পড়তো অথবা প্রতিবেশীদের ঝগড়া সংঘর্ষে রূপ নিতো তখন রক্ষাকর্তার ভূমিকায় নামতো স্থানীয় ঘনিষ্ঠ সম্প্রদায়টি।

১৭৫০ সালের দিকে পরিবার এবং সম্প্রদায় খোয়ানো ব্যক্তির অবস্থা হতো প্রায় মৃতবৎ। তার পক্ষে চাকরি, শিক্ষা, অসুস্থতা ও বিপর্যয়ের সময় কোনো সাহায্য পাওয়া সম্ভব হতো না। কেউ তাকে ঋণ দিতো না কিম্বা বিপদে পড়লে রক্ষা করতো না। তখন কোন পুলিশ,  সমাজকর্মী বা কোনো বাধ্যতামূলক শিক্ষার অস্তিত্ব ছিল না। বেঁচে থাকার জন্য সেই মানুষটাকে দ্রুত অন্য কোন পরিবার বা সম্প্রদায়ের আশ্রয় খুঁজে নিতে হতো। যেসব ছেলেমেয়েরা বাডি থেকে পালাতো ভাগ্য ভালো হলে বড়জোর অন্য কোন নতুন পরিবারের ভৃত্য হবার আশা করতে পারতো। আর ভাগ্য খারাপ হলে তাদের ঠিকানা হতো সেনাবাহিনী বা পতিতালয়ে। এই সমস্ত কিছুই বিগত শতকে নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে।

শিল্পবিপ্লব বাজারকে অসীম ক্ষমতা দিয়েছে, রাষ্ট্রকে দিয়েছে নতুন যোগাযোগ এবং পরিবহন ব্যবস্থা, সরকারকে দিয়েছে কেরানি, শিক্ষক, পুলিশ এবং সমাজকর্মীদের এক বিশাল বাহিনী। প্রথমেই বাজার এবং রাষ্ট্র আবিষ্কার করলো যে, তাদের রাস্তায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রথাগত পরিবার এবং সম্প্রদায়গুলো, যারা বাইরের হস্তক্ষেপকে খুব বেশি পছন্দ করে না। পিতামাতা ও সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠরা তরুণ প্রজন্মকে জাতীয়তাবাদী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হতে, বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে অথবা শিকড়বিহীন শহুরে প্রোলেতারিয়েতে পরিণত হতে দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। সময়ের সাথেসাথে রাষ্ট্র এবং বাজারগুলো তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি ব্যবহার করে পরিবার এবং সম্প্রদায়ের প্রথাগত বন্ধনগুলোকে দুর্বল করে তোলে। রাষ্ট্র পুলিশ পাঠিয়ে পারিবারিক ঝগড়া থামাতে এবং আদালতের রায়ের মাধ্যমে সেগুলো নিষ্পত্তি করতে শুরু করে। বাজারগুলো তাদের ফেরিওয়ালার ঢল পাঠিয়ে দীর্ঘ দিনের স্থানীয় ঐতিহ্যগুলোকে উপড়ে ফেলে সেখানে সদা পরিবর্তশীল বাণিজ্যিক ক্রেতা চালু করে।

রাষ্ট্র এবং বাজার জনগণের কাছে এমন এক প্রস্তাব নিয়ে গেল যা তারা কিছুতেই ফিরিয়ে দিতে পারলো না। তারা বলতো যে, ‘স্বতন্ত্র হও’ যাকে ইচ্ছে বিয়ে করো, পিতামাতার অনুমতির তোয়াক্কা করো না। যে চাকরি তোমাকে মানায় তাই করো, এতে মুরুব্বিরা যতই ক্ষুব্ধ হোক না কেন। যেখানে থাকতে ভালো লাগে সেখানেই থাকো, তাতে যদি তোমার সপ্তাহান্তে পরিবারের সাথে রাতের খাবার একত্রে নাও খেতে পারো; তাতেও কিছু আসে যায় না। তুমি তোমার পরিবার বা সম্প্রদায়ের উপর আর নির্ভরশীল নও। তার বদলে আমরা রাষ্ট্র এবং বাজার তোমাকে দেখেশুনে রাখবো। আমরা তোমার খাদ্য, আশ্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি এবং আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করবো। আমরা তোমাকে পেনশন, বীমা এবং প্রতিরক্ষা দিব। বাজার ক্রমশই আরো বেশি প্রভাব ফেলেছে মানুষের প্রেম ও যৌনজীবনে।

ঐতিহ্যগতভাবে যেখানে পরিবারই ছিল প্রধান ঘটক, বর্তমানে বাজারই আমাদের প্রেম ও যৌনজীবনে চাহিদা কাটছাট করে দিচ্ছে এবং এরপর  সেগুলো পূরণে বাড়িয়ে দিচ্ছে সাহায্যের হাত। বলাবাহুল্য, সেটা অবশ্যই মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। আগে পাত্র-পাত্রীর দেখা হতো পারিবারিক বসার ঘরে, আর একজনের পিতার হাত থেকে অন্যজনের পিতার কাছে পণ হস্তান্তরিত হতো। বর্তমানে বার অথবা ক্যাফেতেই প্রেম ভালবাসা হয়, প্রেমিক যুগলদের টাকা হস্তান্তরিত হয় ক্যাফের ওয়েটারদের হাতে। আরো বেশি পরিমাণ অর্থ স্থানান্তরিত হয় ফ্যাশন ডিজাইনার, জিমের ম্যানেজার, পুষ্টি বিশেষজ্ঞ আর প্লাস্টিক সার্জনদের ব্যাংক একাউন্টে। এরা আমাদের সাহায্য করে বাজারের ঠিক করে দেওয়া সৌন্দর্যের আদর্শের যতটা সম্ভব কাছাকাছি একটা রূপ নিয়ে ক্যাফে পর্যন্ত পৌঁছাতে।

বিগত দুই শতক ধরে শিল্পবিপ্লব পরিবারের অন্তরঙ্গ সম্পর্কগুলো বিনষ্ট করে চলছে, আর এই আবেগের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য আমাদের মধ্যে অনেকেই এখন শক্তিশালী  পরিবার এবং সম্প্রদায়ের জন্য হাহুতাশ করছেন, বিছিন্নবোধ করেন এবং নৈর্ব্যক্তিক রাষ্ট্র এবং বাজার  আমাদের উপর যে শক্তি খাটায় তাকে হুমকিস্বরূপ মনে করেন। বিছিন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে যে কল্পিত রাষ্ট্র গঠিত তাতে রাষ্ট্র আর বাজার সহজেই তাদের শক্তি খাটাতে পারে। অন্যদিকে, যেখানে শক্তিশালী পরিবার ও সম্প্রদায় কাঠামো আছে সেখানে এই শক্তি খর্ব বা দুর্বল হয়ে পড়ে। শ’য়ে শ’য়ে অণু পরিবার বসবাস করে এমন একটি অ্যাপার্টমেন্টের অধিবাসীরা প্রায়শই যেখানে দারোয়ানের বেতন কত হবে তা নিয়ে ঐক্যে পৌঁছাতে পারে না, সেখানে কীভাবে আশা করা যায়Ñ এরা রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় ঐক্যবদ্ধ থাকবে? 

লেখক : প্রভাষক, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত