রবিবার ৬ জুলাই ২০২৫ ২২ আষাঢ় ১৪৩২
রবিবার ৬ জুলাই ২০২৫
নগরীর সড়কজুড়ে চরম বিশৃঙ্খলা
জ্বলেনা হেড ও ব্রেক লাইট, হচ্ছে না ইন্ডিকেটর ব্যবহার
কামরুজ্জামান রনি, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: রবিবার, ২১ মে, ২০২৩, ৯:৫৪ PM আপডেট: ২১.০৫.২০২৩ ৯:৫৮ PM
দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর হওয়ায় চট্টগ্রাম নগরীর সড়কে বড় ও ভারী যানবাহনের সাথে একই সড়কে চলাচল করছে ছোট-বড় সব ধরণের যানবাহন। এছাড়াও সড়কে থেমে নেই অযান্ত্রিক (কায়িক শক্তি চালিত) রিক্সা, ভ্যান ও ঠেলাগাড়ী। দ্রুত ও ধীর গতির যানবাহনগুলো নির্দিষ্ট লেইন ও ট্রাফিক আইন মেনে চলাচল না করায় নগরীর সড়কজুড়ে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। যদিও নগরীর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইতিমধ্যে যুক্ত হয়েছে একাধিক ফ্লাইওভার, ওভারপাস, বাইপাস ও লিংক রোড। একই সাথে নগরীর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সড়ক করা হয়েছে প্রশস্ত। চলছে অত্যাধুনিক ট্রাফিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ। তবে এখনো এই সড়কে চলাচলকারী যানবাহনগুলোর বেশীর ভাগই হেড লাইট, টেইল ও ব্রেক লাইট এবং ইন্ডিকেটর ব্যবহার হয় না।

গত একসপ্তাহ বাংলাদেশ বুলেটিন প্রতিবেদক নগরীর প্রধান প্রধান সড়কের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সরেজমিন ঘুরে এসব সড়কে চলাচলকারী বড়-ছোট সব ধরনের পণ্য ও যাত্রীবাহি যানবাহনগুলোর অব্যবস্থাপনার চিত্রের দেখা পেয়েছে। বিশেষ করে মালবাহী ট্রাক ও যাত্রীবাহী বাস, বিভিন্ন মানের হিউমেন হলার, সিএনজি অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলগুলোর বিশৃঙ্খলা চোখে পড়েছে বেশি। নূন্যতম আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকায় সড়কে যানজটের পাশাপাশি দুর্ঘটনার জন্ম দিচ্ছে এসব যানবাহন চালক। এছাড়া সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চিত্রের দেখা মিলেছে দিনের আলো নিভে যাওয়ার পরে। দিন শেষে আঁধার নামলে এসব যানবাহনের বেশীর ভাগেরই টেইল/ব্রেক লাইট (লাল বাতি) ও ডান-বাম দিক নির্দেশক বা ইন্ডিকেটের (হলুদ বাতি) ব্যবহারের দেখা মেলেনা। অনেক যানবাহনের হেড লাইট (সামনের বাতি) পর্যন্ত জ্বলে না। বিশেষ করে ব্যাটারি চালিত দ্রুতগতির টমটম গুলোকে হেড লাইট নিভিয়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে দেখা যায়। এসব অনুমোদনহীন ব্যাটারি চালিত রিকশা ও টমটমের চালকরা হেড লাইট না জ্বালানো কথা স্বীকার করে বলেন, হেড লাইট জ্বালালে দ্রুত ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যাবে তাই বাতি নিভিয়েই চালাই। তবে প্রায় সকল প্রাইভেট গাড়ীতে সব ধরনের বাতি জ্বলতে ও সংকেত বাতি ব্যবহার করতে দেখা গেছে। 

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে নগরীর বিভিন্ন স্থানে ও স্বল্প দূরত্বে চলাচলকারী ট্রাকগুলোর বেশীর ভাগই চট্টগ্রাম বন্দর, মাঝিরঘাট সহ একাধিক স্থানীয় সমিতির অন্তর্ভূক্ত। এসব লোকাল ট্রাকগুলোর বেশীর ভাগই লক্কর-ঝক্কর ট্রাক হিসেবে পরিচিত। যেসব মডেলের ট্রাক এখানে চলাচল করছে খোঁজ নিয়ে জানা যায় সেগুলোর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বহু বছর আগেই এসব মডেলের গাড়ী উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। মালিক সমিতির ব্যানারে এসব লক্কর-ঝক্কও ট্রাক দিব্যি মালামাল নিয়ে নগরীতে চলাচল করছে। অনেক সময় ড্রাইভারের পরিবর্তে ট্রাকের হেলপাররা এসব ভারী গাড়ি নিয়ে চলাচল করে, ফলে হরহামেশাই এসব ট্রাক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। নগরীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে শত শত যাত্রীবাহী বাস। একাধিক সমিতি ও কোম্পানীর নামে চলা এসব বাসগুলোর বিরুদ্ধে নগরবাসির অভিযোগের শেষ নেই। এই আধুনিক যুগে দেশের ২য় বৃহত্তম শহরে চলাচল করা অনেক বাসের বডির রং পর্যন্ত হারিয়ে গেছে। বেশীর ভাগ বাসের হেড লাইট মিটি মিটি করে জ্বলতে দেখা গেলেও এসব বাসের পেছনে বেশীর ভাগরই টেইল-ব্রেক লাইট ও ইন্টিকেটর লাইট নেই বললেই চলে। যত্রতত্র যাত্রী উঠানামা করানো এখন সিটি বাসগুলোর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। হঠাৎ করে মাঝ সড়কে থেমে যাত্রী উঠা-নামা করাতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে এসব বাস। বিশেষ করে বাসের পেছনে লাল বাতি না থাকায় পেছনে থাকা অন্য গাড়িগুলো কোন কিছু বুঝে উঠের আগেই সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়া গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে বসে। এছাড়া ডানে-বায়ে ইন্ডিকেটর বা সংকেত না দিয়ে গাড়ী চালানোর ফলে আশপাশের গাড়ির সাথে সিটি বাসগুলোর ধাক্কা লাগা এখন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু সিটি বাসই নয় নগরীতে যাত্রীবাহি অন্যান্য হিউমেন হলার ও সিএনজি অটো রিকশাগুলোর কেউই সড়কে ইন্ডিকেটর বা সংকেত ব্যবহার করতে দেখা যায় না। পেছনে বিপদ জনক ভাবে যাত্রী দাঁড়করিয়ে চলাচল করায় অনেক গাড়ীর পেছনের কোন বাতিই দেখা যায় না। আবার অনেক সিএনজি অটোরিকশা সারাদিন ডান কিংবা বাম কোন এক দিকের হলুদ বাতি সারাক্ষণ জ্বালিয়ে রেখে চলাচল করে। ফলে পেছনের গাড়ির চালক একটু অসতর্ক হলেই দুর্ঘটনা ঘটে। রেজিস্ট্রেশন বিহীন ব্যাটারি চালিত টমটম কিংবা ব্যাটারি রিকশাগুলো বিদ্যুৎ খেকো খ্যাতি অর্জনের পর এখন চট্টগ্রামের রাস্তার অঘোষিত রাজায় পরিণত হয়েছে। এসব ব্যাটারি চালিত গাড়ীর কোন প্রকার ডকুমেন্ট, রুট পার্মিট, রেজিস্ট্রেশন বা অনুমোদন নেই। এসব যারা চালায় তাদেরো নেই কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স। সম্পূর্ণ অবৈধ এই বাহনটি এখন নগরীর প্রায় সকল অলিগলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতিদিন নির্ধারিত অংকের চাঁদার বিনিময়ে এসব ব্যাটারি রিকশা ও টমটম চলাচল করে বলে অভিযোগ বেশ পুরনো। এসব টাকার ভাগ চলে যায় স্থানীয় থানা ফাঁড়ি, ট্রাফিক পুলিশের টিআই, সার্জেন্ট, থানার ক্যাশিয়ার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা থেকে পাড়া মহল্লার উঠতি কিশোর গ্যাং এর কাছে।

এদিকে চট্টগ্রাম শহরকে বাংলাদেশের প্যাডেল চালিত রিকশার হোম গ্রাউন্ড বললে ভুল বলা হবে না। দেশে যেসব এলাকায় প্যাডেল রিকশা চলাচল কমে গেছে সেসব এলাকা থেকে হাজার হাজার রিকশা এনে জড়ো করা হচ্ছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে। রিকশার লাইসেন্স দেয়া ও নবায়নের কাজটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এর তত্তাবধানে হয়। তবে কালেভদ্রে নামে মাত্র কিছু রিকশা জব্দ করে দায় সারে চসিকের লাইসেন্স বিভাগ। চট্টগ্রাম নগরীতে যে পরিমান বৈধ রিকশার লাইসেন্স আছে তার চেয়ে অনেকগুন বেশী ভূয়া লাইসেন্স প্লেট নিয়ে লক্ষ লক্ষ প্যাডেল রিকশা চলছে চট্টগ্রাম শহরে। চসিকের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই লক্ষ লক্ষ অবৈধ রিকশা চলাচল করছে বলে স্বীকার করেছে একাধিক রিকশার গ্যারেজ ও মালিকরা।

নগরীর আক্তারুজ্জামান ফ্লাইওভারে নজর রেখে দেখা গেছে বাইকারদের বেলাইনে চলাচলের চিত্র। দুই নাম্বার গেইট থেকে উল্টো পথে বাই গুলোর ফ্লাইওভার পার হয়ে আসাটা এখন হরহামেসাই ঘটছে। ফ্লাইওভারগুলোতে ট্রাফিক পুলিশের কোন নজরদারি না থাকায় যেমন খুশি তেমন ভাবেই মোটর সাইকেল নিয়ে ঢুকে পরছে বেশ কিছু বাইকার। ইতিমধ্যে উল্টো পথে বাইক চালিয়ে অনেক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে অনেক বাইকার। তবে ফ্লাইওভারগুলোতে ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম না থাকায় এসব বাইক চলাচল বন্ধ হচ্ছে না।

সম্প্রতি সিএমপি উত্তর বিভাগের উদ্যোগে নগরীর বেশ কিছু প্রধান সড়কের মোড়গুলোতে ব্লক বসিয়ে আলাদা লেইন তৈরীর মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্ন যানচলাচলের ব্যবস্থা করায় সেসব স্থানে যানজট অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। তবে এসব ভালো উদ্যোগকে ম্লান করে দিচ্ছে নগরীতে চলাচলকারী ট্রাক, বাস, নানান গণপরিবহন ও ব্যাটারি চালিত রিকশা ও টমটম। 

এ নিয়ে বাংলাদেশ বুলেটিনের সাথে কথা হয় সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) ফয়সল মাহমুদ, পিপিএমের সাথে। সড়কে চলাচলকারী সব যানবাহনের হেড লাইট, টেইল ও ব্রাক লাইট এবং ডানে বামে সংকেত দেয়ার হলুদ ইন্ডিকেটর লাইট থাকা ও এসব যথাযথ ভাবে ব্যবহার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে ফয়সাল মাহমুদ বলেন, যানবাহনের সামনের, পিছনের, পাশের সব বাতি অবশ্যই থাকতে হবে। ইন্ডিকেটর ব্যবহার না করে গাড়ী লেইন পরিবর্তন করলে সেটা পেছনের গাড়ীর সাথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। আমরা দ্রুত যানবাহনের এসব বাতি জ্বলে কিনা এবং ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেই বিষয়টি তদারকি করতে অভিযানে নামবো। তবে নিজেদের লোকবল ও গাড়ীর সংখ্যা বিবেচনায় গাড়ীর মালিক ও চালকদের সচেতনতা থাকাটা এক্ষেত্রে বেশী দরকার বলে তিনি মনে করেন। সড়কে অনুমোদনহীন যে কোন যানবাহন চলতে দেয়া হবেনা উল্লেখ করে তিনি জানান, ব্যাটারি চালিত রিকশা, টমটমই শুধু নয় যথাযথ পেপার্স ছাড়া কোন যানবাহনকে রাস্তায় চলাচল করতে দেয়া হবে না। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর গুরুত্বপূর্ণ চৌরাস্তাগুলোতে ব্লক বসিয়ে সুশৃঙ্খল ভাবে গাড়ী চলাচলের উদ্যোগটি পর্যায় ক্রমে পুরো শহরে বাস্তবায়ন করা হবে উল্লেখ করে সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) ফয়সল মাহমুদ বলেন, আমরা নগরবাসির চলাচল নির্বিঘ্ন করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আগামীতে ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হবে। তবে এসবই শতভাগ সফল তখনই হবে যখন নগরবাসী সচেতন হবে। তিনি যত্রতত্র গাড়ী পার্ক না করতে, চলাচলের পথে মালামাল রেখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতে নগরবাসীর প্রতি আহবান জানান।

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত