নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত পত্রিকা ‘স্কোপ ওয়ার্ল্ড’-এ বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে ২৯ মে নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে এবং দেশটির কাছ থেকে একটি শিক্ষা নেওয়া দরকার।
সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের রাজনীতি উত্তাল। ইমরান খানের গ্রেপ্তার কাহিনির প্রেক্ষিতে, এখন পাকিস্তানজুড়ে সংঘর্ষ-হিংসা চলছে। এই ভঙ্গুর দেশের গণতন্ত্র নতুন হুমকির মুখে। পাকিস্তানে গণতন্ত্র সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর সেনাবাহিনীর অবস্থান এখন পরিষ্কার নয়।
পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং এখন উত্তেজনার শীর্ষে থাকা ইমরান খান বলেছেন, বাংলাদেশের সাথে ন্যায়বিচার করা হয়নি। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একাত্তরে বাংলাদেশের সঙ্গে ন্যায়বিচার হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন।
ইমরানের এই মন্তব্যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। শুধু ইমরান খানই নয়, পাকিস্তানের অনেক রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে বারবার বাংলাদেশের ইস্যুটি তুলে আনছেন এবং বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করছেন।
কেন পাকিস্তানের রাজনীতিতে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের ব্যর্থতা ও ভঙ্গুর অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে যেখানে বাংলাদেশ উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, সেখানে উন্নয়নের রোল মডেল দেশ হিসেবে বিশ্বের সামনে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বারবার উঠছে এমন দাবি। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশ বিশ্বের রোল মডেল। অন্যদিকে, পাকিস্তান জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত ব্যর্থ রাষ্ট্র।
পাকিস্তানের নেতৃত্ব বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক পাঠ শিখতে পারে, তবে প্রধান পদক্ষেপটি হওয়া উচিত যে শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, যা প্রতিরক্ষা ও গণতন্ত্র উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
এই সব বাস্তবতায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার প্রসঙ্গ বারবার সামনে আসছে। পাকিস্তানের বিভিন্ন টকশোতে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এখন বাংলাদেশের প্রশংসা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে শেখার কথাও বলা হচ্ছে। পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ খানও বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ হতে চায়। কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে বাংলাদেশ যতই জড়িত থাকুক না কেন, একাত্তরের গণহত্যা ও নিপীড়নের জন্য পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়নি। পাকিস্তান ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক ও স্বাভাবিক হতে পারে না। তদুপরি, পাকিস্তান সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করছে। পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে বারবার বাংলাদেশের প্রশংসার বিষয়টি উঠে আসছে।
১৯৭১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বেশিরভাগ অর্থনৈতিক সূচকে পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে শুরু করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান মাথাপিছু জিডিপির দিক থেকে ৭০ শতাংশ এগিয়ে ছিল। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২৮২৪ মার্কিন ডলার (২০২২), যেখানে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ১৬৭১। পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান বৈদেশিক মুদ্রার মাত্র ১৭ শতাংশ পেয়েছিল এবং অবশিষ্ট ৮৩ শতাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয়েছিল। ব্যাংক আমানতের মাত্র ৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তান এবং ৯২ শতাংশ পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা পেয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ ব্যয় হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে এবং ৭২ শতাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বাঙালির অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। পূর্ব পাকিস্তানে বেসরকারি খাতের কারখানার মাত্র ১১ শতাংশের মালিকানা ছিল বাঙালিদের, বাকি ৮৯ শতাংশের মালিকানা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি বা অবাঙালিদের। বাংলার সম্পদ লুট করে পাকিস্তানের তিনটি বড় শহর করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদ গড়ে তোলা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি শাসকদের পরাজয় নিশ্চিত হলে দেশে অবস্থিত প্রায় সব ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে স্থানীয় অর্থ, স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা পাকিস্তানে পাচার করা হয় যাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি চিরতরে ধ্বংস হয়।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের ৩০৯ মিলিয়ন ডলার, যা ১১ গুণের বেশি। এক ডলার ১০৭.৩৫ বাংলাদেশি টাকার সমান, অন্যদিকে ২৭৬.৫০ পাকিস্তানি রুপি। অর্থাৎ বাংলাদেশের এক টাকা ২.৫৭ পাকিস্তানি টাকার সমান। বাংলাদেশি টাকা বর্তমানে পাকিস্তানি রুপির চেয়ে আড়াই গুণ বেশি শক্তিশালী। বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পায়, পাকিস্তানে ৭৩ শতাংশ। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৮ বছর, পাকিস্তানে ৬৬ বছর। বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ৭৫ শতাংশ, পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২ শতাংশ, পাকিস্তানের ২.১ শতাংশ। বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২১, পাকিস্তানে ৫৯। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৩৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৩ শতাংশ। পাকিস্তানে দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশ, ৪৭ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০৩০ সালে ২৫তম এবং ২০৪১ সালে ২১তম। পাকিস্তানের অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সাহায্য নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৪ বছর ধরে টেকসই প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছেন। আওয়াজ উঠছে পাকিস্তানে, সিঙ্গাপুর বা নিউইয়র্ক নয়, আমাদের বাংলাদেশ বানাও।
লেখক : গবেষক
-বাবু/এ.এস