রবিবার ১৩ জুলাই ২০২৫ ২৯ আষাঢ় ১৪৩২
রবিবার ১৩ জুলাই ২০২৫
জ্বালানি সংকট নিরসনে কাতার-বাংলাদেশ চুক্তি
ইরিনা হক
প্রকাশ: শনিবার, ৩ জুন, ২০২৩, ২:৪১ PM

কাতার থেকে বছরে ১.৮ মিলিয়ন ে টন (এমএমটি) করে ১৫ বছর পর্যন্ত তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। ১ জুন এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রতিবছর অতিরিক্ত ১.৮ এমএমটি এলএনজি পাবে, যা ২০২৬ সালে শুরু হবে। দোহায় কাতার এনার্জির সদরদপ্তওে পেট্রোবাংলা এবং কাতার এনার্জির এলএনজি ট্রেডিং শাখার মধ্যে এই দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি বিক্রয় ও ক্রয় চুক্তি (এসপিএ) স্বাক্ষরিত হয়।

বাংলাদেশের জন্য এটা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। বিশ্বের অনেক দেশই বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ঘাটতির সঙ্গে লড়াই করছে। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং পশ্চিমাদের রাশিয়ার উপর পরবর্তী নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ব দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে। তেল ও গ্যাসের ক্রমবর্ধমান মূল্য এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত সব তেল ও গ্যাস আমদানিকারক দেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির জন্য ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্থিতিশীল জ্বালানি সরবরাহের জন্য গ্যাস ও তেলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংকট প্রকট হচ্ছে।
গতবছর থেকেই এ সংকটের শুরু। মাঝে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও আবার অবনতি হচ্ছে। জ্বালানি পণ্য সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানির কাছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের বকেয়া দিন দিন বাড়ছে। সারাবিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশও যখন জ্বালানি সংকটে টালমাটাল, তখন এই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি একধরনের আশার আলো দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ যখন জ্বালানিসংকটে হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে জ্বলে উঠেছে আশার আলো। বিদ্যুতের বর্ধিত উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিগত এক দশকে দেশের শিল্পখাতের সমৃদ্ধি ঘটিয়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে।

কোভিড-১৯ মহামারি এবং চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস ও তেল সরবরাহকে যথেষ্টভাবে ব্যাহত করেছে। দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাস দ্বারা চালিত হয়। বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের মতে, দেশের ১৫২টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ২৪টি বর্তমানে গ্যাস সরবরাহের ঘাটতির সম্মুখীন। উচ্চমূল্য এবং গ্যাস সরবরাহে বাধার পাশাপাশি, বিশ্ব উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে অনেক দেশে স্থানীয় মুদ্রার ক্রমবর্ধমান অবমূল্যায়ন প্রত্যক্ষ করছে। এটি বিশ্বে বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে যা উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় দেশকেই জর্জরিত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুরস্ক, জার্মানি থেকে শ্রীলঙ্কা, প্রতিটি দেশ খাদ্য ও শক্তি উৎপাদন ও সরবরাহের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্য করছে। অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং পাকিস্তানের মতো দেশগুলো ইতিমধ্যে লোডশেডিংয়ের আশ্রয় নিয়েছে।

কাতারের এই সহায়তা আমাদের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বিশ্ব জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন। আমরা জ্বালানি চাহিদা পূরণের মাধ্যমে আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে পারব বলে আশা করি।

কাতার ইকোনমিক ফোরামের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান বিন জসিম আল থানির সাথে সাক্ষাৎ করেন, যেখানে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করা এবং দু’দেশের মধ্যে জ্বালানি সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়।

কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত কাতার ইকোনমিক ফোরামে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ জ্বালানি সহযোগিতার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কাতারের প্রধানমন্ত্রী থানি তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও জোরদার করার জন্য কাতারের প্রতিশ্রুতির বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেন এবং তাদের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে তাদের মর্যাদার উপর জোর দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা প্রদানে কাতারের সহায়তার প্রশংসা করেন এবং জ্বালানিখাতে তাদের অব্যাহত সহায়তার অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রী আল থানি নিশ্চিত করেছেন যে কাতার তার জ্বালানি চাহিদা পূরণে বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সহায়তা করবে।

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা পূরণে কাতারের সহায়তার গুরুত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চাই আপনি (কাতার) জ্বালানিতে আমাদের সহায়তা করুন। প্রধানমন্ত্রী আল থানি বাংলাদেশকে কাতারের যথাসম্ভব সহায়তার প্রতিশ্রুতির আশ্বাস দেন।

এটি প্রকৃতপক্ষে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, মূল্যবোধ, অভিন্ন ধর্মীয় ভিত্তি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভিত্তিতে দীর্ঘদিনের দ্বিপক্ষীয় বন্ধনে যুক্ত দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে জোরালো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আরেকটি মাইলফলক।’ বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে জ্বালানির চাহিদাও দ্রুত বাড়ছে। বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ২৮৪ মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে।

সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সারাদেশে বিদ্যুৎ কাভারেজ ১০০ ভাগে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তুলনামূলকভাবে পরিচ্ছন্ন জ্বালানির উৎস হিসেবে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এলএনজি একটি অগ্রাধিকার। এলএনজি আমদানি সারাদেশে স্থাপিত জাতীয় গ্যাস গ্রিড নেটওয়র্ক পূরণে সহায়তা করবে।

কাতার থেকে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩.৫ মিলিয়ন টনের বেশি এলএনজি পাবে। এই সরবরাহ বাংলাদেশের মতো মূল্যবান গ্রাহকদের জ্বালানি নিরাপত্তা রক্ষায় এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য তাদের প্রয়োজনীয় নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহে জন্য অবিচল আত্মনিবেদনকে জোরদার করে। কাতার বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে ৩.৫ মিলিয়ন টনের বেশি এলএনজি সরবরাহ করে। কাতারের সাথে বাংলাদেশের একটি ১৫ বছরমেয়াদি এলএনজি চুক্তি রয়েছে যা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে স্বাক্ষরিত হয়। ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে ডেলিভারি শুরুর পর থেকে ৩১ মে ২০২২ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা ১৯১টি এলএনজি কার্গোর মাধ্যমে সফলভাবে ১১.৭৪৬ মিলিয়ন টন এলএনজি পেয়েছে।

২০১৭ সালে কাতার থেকে জ্বালানি নেওয়ার বিষয়ে ১৫ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি করে বাংলাদেশ। সেই চুক্তিটি অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ও বুদ্ধিমানের কাজ ছিল।  ২০১৭ সালে স্বাক্ষরিত একটি ১৫ বছরের চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ এখন প্রায় ৪০টি কনটেইনার জ্বালানি আমদানি করছে।

বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে শ্রম অভিবাসন (৮ লাখ বাংলাদেশী কর্মী এবং ১.৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স), জ্বালানি সহযোগিতা (১৫ বছরের জি-টু-জি এনএলজি চুক্তি), এবং রোহিঙ্গাদের জন্য ক্রমাগত সহায়তাসহ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে অবিরাম সহযোগিতা রয়েছে। এটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে কাতার এবং ওমান থেকে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ক্রয় চালিয়ে যাচ্ছে এবং বছরে প্রায় চার মিলিয়ন টন তরলিকৃত গ্যাস আমদানি করে।

কাতারের সাথে চুক্তির মেয়াদ ২০৩২ সালে শেষ হবে এবং ওমানের সাথে ২০২৯ সালে মেয়াদ শেষ হবে। কাতার অন্যতম শীর্ষ জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে কাতারের সাথে জি-টু-জি ১৫ বছরের জন্য এলএনজি চুক্তি করেছে। তবে ইউক্রেন সংকট, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং পরবর্তীকালে জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট দেখা দেয়। স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন হ্রাস এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির উচ্চমূল্যের কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মোকাবিলায় লড়াই করছে।

কাতার মধ্যপ্রাচ্যের একটি তেলসমৃদ্ধ দেশ। তার অর্থনীতিকে সমর্থন করার জন্য দেশটি মূলত বিদেশি শ্রমের ওপর নির্ভরশীল: কাতারের ৮৯.৫ শতাংশ বাসিন্দা বিদেশি নাগরিক। বিপরীতে, বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম শ্রম রপ্তানিকারক দেশগুলোর একটি। প্রায় ৪,০০,০০০ বাংলাদেশি প্রবাসী সেখানে কাজ করছেন, যা কাতারের মোট বাসিন্দার ১২.৫ শতাংশ। তেলসমৃদ্ধ দেশটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রবাসী ও অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ।

২০১৭ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য বার্ষিক ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি পাওয়ার জন্য কাতারের কোম্পানি রাসগ্যাসের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এটা লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে গত পাঁচ বছরে কাতার থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ মার্কিন ১ বিলিয়ন ছুঁয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু জ্বালানি সংকটে ভুগছে, কাতার তার ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশ-কাতার সম্প্রতি তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করেছে। কাতারের ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জ্বালানি খাত, এলপিজি স্টোরেজ টার্মিনাল, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছেন। এলএনজির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি বাংলাদেশকে জ্বালানি নিরাপত্তায় সহায়তা করবে।

লেখক : গবেষক

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত