উষ্ণায়ন নিয়ে বিজ্ঞানী কিংবা গবেষকরা অনেক দিন ধরেই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। উষ্ণায়নের অন্যতম প্রভাব হিসেবে বলা হয়েছে, বরফ গলার ফলে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে উপকূলবর্তী এলাকায় যে লক্ষ লক্ষ মানুষ বসবাস করেন, তাদের বিপদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০১৩ সালে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (আইপিসিসি) হুঁশিয়ারি করে দিয়েছিল, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রতলের উচ্চতা বেড়ে যাবে অন্তত ৬০ সেন্টিমিটার। আর এই সমুদ্র স্ফীত হওয়ার কারণে সংকটে পড়বে গোটা পৃথিবীর ৩৬০ মিলিয়ন মানুষ। এই হুঁশিয়ারি নিয়ে অনেকেই দ্বিমত প্রকাশ করেছিলেন। উন্নত দেশগুলোর শিল্পপতিদের একাংশ সমালোচনা করে বলেছিল ‘সিঁদুরে মেঘ দেখছে আইপিসিসি। মানুষের মনের মধ্যে অহেতুক আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে।’ অনেকে তামাশাও করেছিলেন বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে। কিন্তু বর্তমানে গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলার বিষয়ে পরিচালিত বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা চোখ কপালে তুলে দিয়েছে পরিবেশবিদ এবং গবেষকদের। সমীক্ষা জানাচ্ছে, বরফ গলার হার নিয়ে আগে যা আন্দাজ করা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত গলে যাচ্ছে আইসল্যান্ডের বরফ। আর ঠিক সে কারণেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে পূর্বের হিসাবের চেয়ে আরও বেশি মাত্রায়। আর এর জন্য দায়ী জলবায়ুর পরিবর্তন। দুই-একটি পরিসংখ্যান দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, আমরা কেমন বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি!
বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নেচার’ পরিচালিত এক সমীক্ষায় জানানো হয়েছে, ১৯৯২ সাল থেকে গ্রিনল্যান্ডের ৩ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন টন বরফ গলে গিয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় মাটির ওপর প্রায় তিন কিলোমিটার উচ্চতার বরফের স্তর সম্পূর্ণ গলে গিয়েছে। ইতোমধ্যেই যার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ১০ দশমিক ৬ মিলিমিটার। সাধারণ হিসাবে ধরে নেওয়া হয়, প্রতি সেন্টিমিটার সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে অতিরিক্ত ৬০ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া হওয়ার আশঙ্কার মধ্য থাকেন। সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি মানে উপকূলবর্তী এলাকায় সমুদ্রঝড়ের প্রভাব আরও বেশি হবে। সমুদ্রের ঢেউ আরও আগ্রাসী হয়ে তীরে আছড়ে পড়বে। জলমগ্ন হবে আরও বিস্তৃত এলাকা। মানুষকে ঘরছাড়া হতে হবে একইসঙ্গে। ২০১৩ সালে আইপিসিসি যে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে ‘নেচার’ পত্রিকার রিপোর্ট সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। আর যারা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে ‘সিঁদুরে মেঘ’ বলে ব্যঙ্গ করছিলেন দেখা যাচ্ছে তারা নিতান্তই ভুল করেছিলেন।
ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক প্রফেসর অ্যান্ড্রু শেফার্ডের মতে, গোটা পৃথিবীরই উপকূলবর্তী মানুষের সংকট দিনদিন বাড়ছে। এগুলো এমন একটা বিপদ, যার প্রভাব উড়িয়ে দেওয়া বা উপেক্ষা করার মতো নয়। আমরা চোখ বুজে থাকলেও এ ঘটনাগুলো ঘটতেই থাকবে। আর সমুদ্রের ধারে লক্ষ লক্ষ যেসব জনবসতি রয়েছে, সেগুলো একদিন মুছে যাবে। ‘ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভে’ (বিএএস) সংস্থার পরিবেশ বিজ্ঞানী লুইজি সিমে বলেন, ‘আমরা আগে বিপদের চরম সময়সীমা হিসেবে যেগুলো ধার্য করেছিলাম, এখন দেখা যাচ্ছে সেগুলো সবই ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। যে হারে গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলছে, তাতে উপকূলবর্তী মানুষের সমস্যা তীব্র এবং বিপদ এড়ানোর কোনো লক্ষণই আমরা দেখতে পারছি না।’
প্রশ্ন হলো, কেন বিজ্ঞানীরা এমন চরম উদ্বেগ প্রকাশ করছেন? কারণটা স্পষ্ট। গত কয়েক দশকে বরফ গলার হার অনেকটা বেড়েছে। নয়ের দশকে গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলার হার যা ছিল, মাত্র ৩০ বছরের মাথায় সেই বরফ গলার হার বেড়েছে অন্তত দশগুণ। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গলে যাওয়া বরফের পঞ্চাশ শতাংশ ভৃপৃষ্ঠের ওপর জমে থাকা তুষারস্তর। বাকিটা হিমবাহ। এ সমীক্ষায় ব্যবহার করা হয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’র ‘জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি’-এর (জেপিএল) উপগ্রহ চিত্র। নাসার এ কৃত্রিম উপগ্রহগুলো স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে, গ্রিনল্যান্ডের বরফ দেশের কোন অংশে কতটা গলে যাচ্ছে। একই সঙ্গে এটারও ইঙ্গিত দিচ্ছে, কোথায় বরফ গলার হার কেমন? সব মিলিয়ে এটা পরিস্কার যে, অ্যার্ন্টাকটিকা এবং গ্রিনল্যান্ডের চারপাশে ভাসমান হিমবাহগুলোর একটা বড় অংশ গলে যাচ্ছে। আর সেটা হয়ে চলেছে নিরন্তরভাবে, বেশ দ্রুতগতিতে। সমীক্ষক দলের এক সদস্য স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন ‘কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবি থেকে এটা পরিস্কার, গ্রিনল্যান্ড থেকে বিপুল আকারে বরফের চাঁই কীভাবে দিনের-পর-দিন সমুদ্রে মিশে যাচ্ছে। ‘আইস ডিসচার্জ’ আর ‘আইস মেল্টিং’ নিয়ে এখন আর কোনোরকম ধোঁয়াশা নেই এটা এখন বাস্তব।’
আইপিসিসি’র সর্বশেষ গবেষণা থেকে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ বর্তমান সময়ের তুলনায় বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বাড়বে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিশ্বব্যাংকের এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাসস্থান হারাবেন। ১ কোটি মানুষ এরই মধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীর পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিবছর ৪ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছেন। এদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগই জলবায়ু উদ্বাস্তু। এ অবস্থায় সময় থাকতেই আমাদের সচেতন হতে হবে বাঁচাতে হবে বিপন্ন এ পৃথিবীকে।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট
-বাবু/ সাদরিনা