বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের (বিএফটিআই) মতে, ভারতের সঙ্গে প্রস্তাবিত সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সিইপিএ) স্বাক্ষর করা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শিল্প, রাজস্ব এবং চাকরির বাজারের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কিন্তু চুক্তিটি স্বাক্ষর করা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ বাংলাদেশ ২০২৬ সালে তার এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করতে যাচ্ছে। তাহলে, এই চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা আসলে কি? বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিএফটিআই সমীক্ষা চালানোর পর জানা গেছে ‘বন্দর-সম্পর্কিত অ্যাক্সেস এবং পর্যাপ্ত শক্ত অবকাঠামোর অভাব, বাণিজ্য সুবিধা-সম্পর্কিত অবকাঠামো এবং শিপিং লাইন বাংলাদেশের বাণিজ্যের জন্য প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।’ এর মানে কি বাংলাদেশের এই ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করা উচিত? উত্তরটি সম্পূর্ণ ‘না’। বরং উভয় দেশেরই কিছু টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য।
ট্রাকের যানজটের কারণে স্থলবন্দরের অচলাবস্থা একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা; যা স্থলবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সমাধান করা প্রয়োজন। বিশেষ করে বাংলাদেশের দিক থেকে। যেমন বেনাপোল বন্দর। যদিও বেনাপোল ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পয়েন্ট হিসেবে রয়ে গেছে, তবে যানজট একটি প্রাথমিক উদ্বেগের বিষয়। বেনাপোলের সাথে সংযোগকারী চার লেনের সড়ক হওয়া জরুরি। একটি দ্বিতীয় কার্গো গেট নির্মাণ দ্রুত কার্গো ক্লিয়ারেন্সে সাহায্য করবে। তুলনামূলকভাবে, আগরতলা-আখাউড়া একটি বাইপাস সড়কের মাধ্যমে এনএইচএইট-এর সাথে সম্পর্কিত আরও ভাল সুবিধা রয়েছে। এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর। প্রতিটি দেশে মহাসড়ক অবকাঠামো দ্বারা ট্রানজিট বাণিজ্য ব্যাপকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পরিবহন যানবাহনগুলোর ‘মূল করিডোরগুলোতে গড়ে ১৯ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিবেগে চলে’। এই গতিবেগ থেকে বোঝা যায় সড়কগুলোতে যানজটে রয়েছে। বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের হ্যান্ডলিং ক্ষমতা অপ্রতিসম। সীমান্ত এলাকায় কর্মরত পার্কিং মাফিয়ারা কার্গো লোড এবং আনলোড করার জন্য কাস্টমস ক্লিয়ার করতে বিলম্বের কারণে লাভবান হয়। অধিকন্তু, বেনাপোল শুধুমাত্র কয়েকটি পণ্যবাহী ট্রাক অপসারণ করতে পারে না। তবে বাংলাদেশ সুতির কাপড় এবং ট্রাক চেসিসের কনটেইনারাইজড কার্গো ছাড়পত্রকে অগ্রাধিকার দেয়।
পরিবহন এবং ট্রানজিটের অদৃশ্যমান বাধা হ্রাস করা : ভারত ও বাংলাদেশকে অবশ্যই দ্বিমুখী বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য পরিবহন এবং ট্রানজিটের বর্তমান অদৃশ্যমান বাধাগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এটি দুটি উপায়ে করা যেতে পারে। প্রথমত, দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন (যেমন সংযোগের অবকাঠামো, রেলপথ এবং নৌপথ, স্থলবন্দর, জলবন্দর) এবং অদৃশ্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন (যেমন সংস্কার করা নীতি, পদ্ধতি এবং প্রবিধান)। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের নীতিনির্ধারক ও গবেষকদের বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকেও অবিলম্বে নজর দেওয়া প্রয়োজন। ভারতের পাশের পেট্রাপোল স্থলবন্দর আধুনিকায়ন করা হলেও বেনাপোলের দিকে নজর দেওয়া দরকার। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আঞ্চলিক সংযোগ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের তিনটি স্থলবন্দর-রামগড়, শেওলা ও বেনাপোল-এ অবকাঠামো উন্নয়ন করা হচ্ছে এবং ভোমরা, বুড়িমারী ও ভোলাগঞ্জ বিবেচনাধীন রয়েছে।
স্থলবন্দরের নীতি সংস্কার এবং দুর্নীতি মোকাবেলা করা : উভয় দেশেরই প্রশাসনিক সংস্কার, শাসন ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়া উচিত। কাস্টমস হল ভারত-বাংলাদেশের পণ্য ও পরিষেবার আন্তঃসীমান্ত চলাচলের একটি অন্তর্নিহিত উপাদান এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। এছাড়াও, কাস্টমস অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন করে যেমন রাজস্ব সংগ্রহ এবং বিপজ্জনক পণ্যগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা। পণ্য ক্লিয়ারেন্সের জন্য সময় লাগে পণ্যের প্রতিযোগিতামূলকতার উপর প্রভাব ফেলে। তাই ভারত-বাংলাদেশের উচিত ভারত ও বাংলাদেশের উভয় দিকেই প্রশাসনিক সংস্কার আনা।
আরও যে ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজন তা হল রপ্তানির উচ্চ লেনদেনের খরচ কমানো এবং ক্রস-বর্ডার ট্রেডিং পদ্ধতির জটিলতা কমানো। আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যে জটিল প্রয়োজনীয়তা দুর্নীতির সম্ভাবনা বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত-ক্রসিং পয়েন্টে, উভয় দিকে প্রায় ১৫০০ ট্রাক সারিবদ্ধ থাকে, ডকুমেন্টেশন সম্পন্ন করার জন্য অপেক্ষার সময় এক থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে পরিবর্তিত হয়। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা শুল্ক কর্মকর্তাদের বিবেচনার ক্ষমতা হ্রাস করে, এইভাবে দুর্নীতির সুযোগ হ্রাস করে। দক্ষ, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং দুর্নীতিমুক্ত কাস্টমস বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের স্থলবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সক্ষমতা বৃদ্ধি সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার জন্য, বাণিজ্য উদারীকরণ একটি প্রয়োজনীয় শর্ত। তবে এছাড়াও আরো অদৃশ্যমান প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ প্রয়োজন। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। উপরন্তু, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে স্থলবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পদ্ধতিগত এবং অপারেশনাল দক্ষতার সাথে পরিপূরক নীতির সংস্কার অপরিহার্য। এই নীতি সংস্কার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে সহজতর করবে।
লেখক : গবেষক
-বাবু/এ.এস